টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে টাকা ছাড়া সন্তান প্রসব হয় না

0
761

সবুজ সরকার, টাঙ্গাইলঃ টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে টাকা ছাড়া সন্তান প্রসব হয় না। সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে ভূক্তভোগীদের সাথে কথা বলে এমনই সব তথ্য পাওয়া গেছে। ভূক্তভোগী ১- বাসাইল থেকে আসা গর্ভবতী মহিলা। টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়েছে। ভর্তির ২৪ ঘন্টা পার হলেও কোন ডাক্তার তাকে দেখতে আসেনি। সেসময় এক বয়স্ক আয়া এসে তাদের সাথে কথা বলেন। তিনি তাদের বলেন, ডেলিভারি করতে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। আপনার বাড়িতে খাওয়ার ওষুধসহ দিয়ে দেয়া হবে। পরে তিন হাজার টাকায় রফা হয়। এসময় তিনি ওই প্রসুতি মহিলার স্বামীকে একজন সিনিয়র নার্সের কাছে নিয়ে যান। সিনিয়র নার্স বলেন, আর কারো সাথে কোন কথা বলার প্রয়োজন নাই। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমার লোক আছে। ভূক্তভোগী ২- ঘাটাইল থেকে আসা আরেক গর্ভবতী মহিলার সাথে ঘটেছে একটু ভিন্ন ঘটনা। তিনিও চুক্তিতে উনার স্ত্রীর সন্তান প্রসব করিয়েছেন। কিন্তু অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে আয়া বাচ্চাটিকে তার বাবার কোলে দেয়ার সময় বকশিস দাবি করে বসলেন। সেসময় ওই বাবা ২০০ টাকা বের করে দিলেন। তখন আয়া উনার কাছে এক হাজার টাকা দাবি করে বলেন, আমরা এক হাজার টাকার নিচে বকশিস নেই না। সেখানে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির করে ৫০০ টাকা নিয়ে তবেই সন্তানকে তার বাবার কোলে দেয়া হয়। এরপর গত ১২ অক্টোবর রাতে প্রতিবেদক নিজেই রোগীর অভিভাবক সেজে হাসপাতালে যান। সেসময় তিনি তার বোন গর্ভবতী তাকে ভর্তি করতে হবে ২/১ দিনের মধ্যে। এজন্য পরিবারের চাপে তিনি বিস্তারিত জানতে এসেছেন। প্রতিবেদক ওই আয়ার কাছে তার গল্পটি বলেন। আয়া বিশ্বাস করে তার ফাঁদে পা দিয়ে বলেন, আপনার তিন হাজার টাকা লাগবে। এক টাকাও কম হবে না। কিন্তু অন্য কাউকে এই কথা বলতে পারবেন না। পরে তিনি সিনিয়র স্টাফ নার্স রাশেদার কাছে নিয়ে যান। নার্স রাশেদাও একই ভাবে বলতে থাকেন। সেসময় নার্স রাশেদ নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দিয়ে বলেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন হাসপাতালে আপনার লোক আছে। পরের দিন ১৩ অক্টোবরের ঘটনাঃ ভূক্তভোগী ৩- টাঙ্গাইল সদর উপজেলা হুগড়া গ্রামের এক রোগীর অভিভাবক চাকরী করেন চৌধুরী মালঞ্চ উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, আমার এক আত্মীয় অন্য ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স। তিনি বলে দিয়েছেন, তাই আমার টাকা লাগে নাই। কিন্তু আমার এক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। আর বাচ্চা প্রসব হওয়ার পর আমার কোলে দেয়ার সময় আয়া পাঁচশ’ টাকার কম নিবে না। অনেক কথা বলে তিনশ’ টাকা দিয়েছি। ভূক্তভোগী ৪- হুগড়া গ্রামের ওই স্কুল মাস্টারের বাড়ির কয়েক ঘর পশ্চিমের আরো এক ব্যক্তির স্ত্রীরও বাচ্চা হওয়ার তারিখ তার পরের দিনই। আনতে একটু দেরি হওয়ায় প্রসব ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আনার ৪০ মিনিটের মধ্যেই স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চা জন্মনেয়। তারপরও তাকে এক হাজার টাকা বকশিস দিতে হয়েছে আয়াদের। অনেকটা জোর করেই নিয়েছে। আর ওয়ার্ডের নার্সরা নিয়েছে ১৫শ’ টাকা। ভূক্তভোগী ৫- গালা থেকে এক বড় ভাই তার গর্ভবতী ছোট বোনকে বেলা ১১টায় ভর্তি করেছেন। পরের দিন সকালে নরমাল ডেলেভারি হয়েছে। এর মধ্যে এক লিটার করে ৭টি স্যালাইন নিয়েছেন দায়িত্বে থাকা নার্স বা ডাক্তাররা। উনার বিষ্ময়কর প্রশ্ন, একজন গর্ভবতী মহিলাকে ২৪ ঘন্টায় কয়টা স্যালাইন দেয়া যায় ভাই? তারপরে ডেলেভারি হওয়ার পর আয়াদের বকশিস পাঁচশ’ আর সিস্টারদের দিতে হয়েছে সাতশ’ টাকা। অন্যদিকে যে ওষুধ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য ব্যবহার করা কথা সেই ওষুধ চলে যাচ্ছে রোগীদের বাড়িতে। বিনা পয়সার চিকিৎসা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক হাসপাতালের ওষুধ দেয়ার শর্তে। এছাড়া ভূক্তভোগীদের আরো অভিযোগ, ডাক্তাররা হাসপাতালের আসেন ২/১টা সিজার করেন, আর কোনরকমভাবে ওয়ার্ডে একটু ঘুরে যান। রোগীদের সাথে ভালোভাবে কথাও বলেন না কোন ডাক্তার। টানা তিন দিন হাসপাতালে গিয়ে কোন ডাক্তারের সাথে কথা বলা যায়নি। এরকম কাহিনীর শেষ নাই হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে। সবকিছু জেনেও না জানার বাহানা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের না কি অন্যকিছু? এমন প্রশ্ন তুলেছেন সতেচন নাগরিক ফোরাম বাংলাদেশ টাঙ্গাইল জেলা শাখার চেয়ারম্যান বিপ্লব দত্ত পল্টন। আর এটাকে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের নিরব চাঁদাবাজি বলে অভিহিত করেছেন সতেচন নাগরিক ফোরাম বাংলাদেশ টাঙ্গাইল জেলা শাখার এই চেয়ারম্যান। তিনি আরো বলেন, টাঙ্গাইলের গরীব রোগীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই, তাই তারা বাধ্য হয়ে সদর হাসপাতালে যায়। হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে বাচ্চা প্রসব করাতে কত টাকা লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. সদর উদ্দিন বলেন, হাসপাতালের গাইনি বিভাগ কেন, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে কোন টাকা লাগে না। আর যারা টাকা নিচ্ছে তাদের বিরূদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে? প্রশ্নের জবারে টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) শফিকুল ইসলাম সজিব ও তত্ত্বাবধায়ক মো. সদর উদ্দিন একই সুরে কথা বললেন। তারা বলেন, ভ‚ক্তভোগীরা আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করব। অভিযোগ না করলে তো আর কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। অন্যান্য অভিযোগের বিষয় আমলেই নেননি এই তত্ত্বাবধায়ক হাসপাতালের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত অভিযোগ লাগে এরকম কথার প্রেক্ষিতে টাঙ্গাইলের নাগরিক কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক কর্মী মীর মেহেদী বলেন, যিনি সকল কিছু তত্ত¡াবধান করবেন, তিনিই তত্ত্বাবধায়ক। হাসপাতালের এই অনিয়ম বা দূর্নীতিগুলো দেখার দায়িত্ব যাদের, তাদের আমি দেখাব কেন? আমি তাদের অবগত করেছি, তারা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি নিজেও কয়েকবার এইসব বিষয়ে অভিযোগ করেছি। কোন পরিবর্তন হয় নাই। তিনি আরো বলেন, টাঙ্গাইল হাসপাতালের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তারা কোন প্রকার দায়িত্ব পালন করেন না বা দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা নাই। আমি টাঙ্গাইলের সাধারণ ভূক্তভোগী মানুষের পক্ষে তাদের অপসারণ চাই। সেই সাথে বিভাগীয় তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক।

আলোকিত প্রতিদিন/১৪ অক্টোবর’২০/এসএএইচ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here