নাস্তিক্যবাদ উস্কে দেবার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের দায় ও দায়িত্ব/ সৈয়দ রনো

0
483

পর্ব -৫ :

গণতন্ত্র কুক্ষিগত করে পুঁজিবাদ (ক্যাপিটালিজম) বিশ্বময় ভয়ানক ভোগবাদী জীবনধারা ও জীবনবোধ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব৷ পশ্চিমা প্রজন্মের বিশাল অংশ এখন বিশ্বাস করে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক, দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মধ্যখানে বেজায় ফাঁক’। এ উক্তির পর ধর্ম, মহাপুরুষ ও ধর্মগ্রন্থের জায়গাও নেই, দরকারও নেই– স্রেফ আনন্দ করে গেলেই জীবন সার্থক৷ পশ্চিমা দেশগুলোর আইনও এ বিষয়কে সমর্থন করে– তারা ভাবে ‘একটাই জীবন তোমার, নিজ কর্মের দায়িত্ব নিয়ে অন্যের অধিকার খর্ব না করে বা অন্যকে কষ্ট না দিয়ে জীবন উপভোগ করে যাও’৷ এ ধারণাই হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ।
এর মধ্যে নারী-পুরুষের অবাধ সংসর্গও অন্তর্ভুক্ত৷ যৌবন এক পরাক্রান্ত শক্তি৷ জীবনের ষড়রিপু – কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্য– তার প্রথমটাই হল কাম যা মানুষকে প্রবলভাবে তাড়িত করে৷ পরস্পরের সম্মতি থাকলে সাবালক নরনারীর মিলন অবৈধ নয়, পশ্চিমা দেশগুলোর এ আইনের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে প্রজন্ম৷ ধর্মীয় মুল্যবোধ বিয়ের বাইরে দৈহিক সংসর্গের বিরোধী এবং পশ্চিমা প্রজন্মের অবাধ যৌনতায় বড় বাধা৷ এই আইনি অধিকার পশ্চিমা প্রজন্ম পেয়েছে সেটা আঁকড়ে ধরে আছে। দরকার হলে ধৰ্মই ছেড়ে দিয়ে নাস্তিক্যবাদের আশ্রয় নিচ্ছে , এ প্রবণতাও লক্ষনীয় ৷ পশ্চিমা প্রজন্মের এ প্রবণতা আমাদের দেশগুলোতেও বাড়ছে৷
‘ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন’। জীবনের স্রোত প্রয়োজনের তাড়নায় প্রবাহিত হয়৷ খাদ্যের পাশাপাশি মানুষের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন আছে, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের বিকল্প নেই৷ এই আধ্যাত্মিক প্রয়োজনটাই হারিয়েছে এ প্রজন্মের বিশাল অংশ৷ এখন তাদের প্রয়োজন প্রধানত পার্থিব, অর্থাৎ দুনিয়াদারি৷ তাদের চাই টেকনোলজির সর্বশেষ সংস্করণ, চাই পার্টি, নূতন মডেলের গাড়ি, বাড়ি, আরও ভালো চাকরি বা নিজের ব্যবসা– তারা চায় দেশে দেশে ভ্রমণ করতে, ইত্যাদি৷
ধর্মই নৈতিকতার ভিত্তি, এ দাবিও অসার প্রমাণিত করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ ধর্মহীন বা ধর্মে উদাসীন অথচ প্রবলভাবে আধ্যাত্মিক, উদার ও মানবিক গুণাবলীতে আলোকিত মানুষের অজস্র উদাহরণ চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে৷ তারা কারও ক্ষতি করেন না ও বিপদে-আপদে সর্বশক্তি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান৷ হিন্দু সমাজে বিধবা-বিবাহ প্রতিষ্ঠার নায়ক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র কিংবা আফ্রিকাতে প্রধানত মুসলিম সমাজে ইসলামের নামে ভয়ংকর বর্বর প্রথা নারীর খৎনা উচ্ছেদে সর্বাত্মক চেষ্টাকারী রুডিজার নেহবার্গ দুজনেই ধৰ্মহীন৷ দুর্ভাগ্যক্রমে, গির্জা, মন্দির ও মসজিদ-মাদ্রাসা ইত্যাদির অনেক ধর্মগুরুর ব্যক্তিগত হিংস্রতা, হানাহানি ও অশ্লীলতার খবরও প্রজন্ম জানতে পেরেছে। যেহেতু ধর্মগুরুদের ভাবমূর্তির উপর ধর্মের ভাবমূর্তি অনেকটাই নির্ভর করে, তাই এটাও ধর্মের প্রতি প্রজন্মের বিতৃষ্ণার বড় কারণ। এসব যৌবিক চাহিদা মেটাতে ধর্মের সায় পাচ্ছে না বলেই নাস্তিকতার উদ্ভব ঘটেছে বলে পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করে। বুঝতে চায় না ওটা ধর্মের কাজই নয়৷ ধর্মের কাজ হেদায়েত করা এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা। যার ধারও ধারছে না এ প্রজন্মের বিশাল অংশ৷ যা প্রয়োজন মেটাতে পারে না তা প্রাকৃতিক নিয়মেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে ও শেষ পর্য্যন্ত পরিত্যক্ত হয়৷ প্রজন্মের বিশাল অংশ ধর্মের মাধুর্য কী জানে না, ধর্মের আবেদন তাদের কাছে নেই৷
অভিজ্ঞতা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না৷ পশ্চিমা প্রজন্ম সম্প্রতি দেখছে ধর্মের উৎস থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ গণহত্যা, গণধর্ষণ, ব্যাপক হিংস্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞ৷ ইতিহাস ঘেঁটে তারা দেখেছে অন্য ধর্মের উৎস থেকেও অতীতে প্রবাহিত হয়েছে অগণিত নিরপরাধীর রক্ত ও অশ্রুস্রোত৷ হিংস্রতা, যুদ্ধ, রক্তক্ষয় অন্যান্য কারণেও হয় এবং তার ব্যাখ্যা সম্ভব৷ কিন্তু সেটা যখন স্রষ্টার নামে হয় তখন তা ব্যাখ্যার অতীত হয়ে দাঁড়ায়৷ প্রজন্ম জানে না কোনো ধর্মই হিংস্রতা শেখায় না৷ জানে না যে ওগুলো ধর্মের অপব্যবহার মাত্র– কতিপয় শক্তিশালী ধর্মগুরুর হিংস্রতা মাত্র৷ তাদের অপকর্মের দায় গিয়ে পড়ে ধর্মের উপর। ইসলামের কথাই যদি বলি, কোরানে আছে ব্যভিচার বর্জন করার নির্দেশ, ব্যাভিচারের শাস্তি আজীবন ঘরবন্দি অথবা আল্লাহ অন্য কোনো পথ নির্দেশ না করা পর্যন্ত, আছে ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে একশ করে চাবুক (সুরা বনি ইসরাইল ৩২, মুমতাহানা ১২, নিসা ১৫, নূর ২ ইত্যাদি)। কিন্তু শরিয়া আইনে ব্যাভিচারের শাস্তি বিবাহিতদের মৃত্যুদণ্ড ও অবিবাহিতদের চাবুক (হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৭৮, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড, ধারা ১২৯, পাকিস্তানের হুদুদ আইন ৭-১৯৭৯, অর্ডিন্যান্স ২০-১৯৮০ দ্বারা পরিবর্তিত, আইন নম্বর ৫ (২)-এর ‘অ’ ইত্যাদি)। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় অনুশাসনকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করার মানুষিকতা থেকেও নাস্তিক বাদ বিস্তার লাভ করেছে পশ্চিমা বিশ্বে।

উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় পশ্চিমা বিশ্বের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব মুল্যবোধে বিশ্বাসী হওয়া উচিত। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব সন্তান জন্ম দেবার পর পিতার পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করায় অনেক নারীই মাতৃত্ব হারাচ্ছেন। বৈবাহিক বন্ধনে আবব্ধ হতে পারছেন না। যুবক যুবতীরা আনন্দে দিন অতিবাহীত করলেও বৃদ্ধ বয়সে এসে অসহায়ত্ব বোধ করছেন। পারিবারিক মায়া মমতা নেই বললেই চলে।
তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে মানব জীবনে ধর্ম প্রয়োজনীয়তা কতটুকু ?সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণভাবে জীবন পরিচালনার জন্য অবশ্যই ধর্মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ধর্মের প্রধান প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ হল পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ চিরকাল ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এখনও ধর্মে বিশ্বাসী আছেন। ধর্ম ছাড়া মানুষ চলতে পারে না৷ এটা খুবই সত্য যে: বিভিন্ন ধর্মের
ধর্মগুরুগন ধর্ম প্রচার করেছেন। পাশাপাশা ধর্মীয় নীতিবাক্য প্রচার করেছেন অজস্র। আর তাতে কাজও হয়েছে যথেষ্ট। অসংখ্য নরনারী অসৎকাজ ত্যাগ করে সৎকাজে ব্রতী হয়েছেন এবং হচ্ছেনও।মূলত পশুবৃত্তি বা স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে মানুষকে সুসভ্য, সৎ, ন্যায় নিষ্ঠাবান করে গড়ে তুলবার ব্যাপারে ধর্মীয় বিধান পালন করা অপরিহার্য। সুন্দর সমাও ও জীবন গঠনের জন্য ধর্মগুরু বনাম ধর্মের আদেশ নিষেধ এর গুরুত্ব অপরিসীম।

আলোকিত প্রতিদিন/১৬ অক্টোবর ‘২০/এসএএইচ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here