আস্তিক ও নাস্তিক্যবাদের দর্শন: পর্ব – ৪/ সৈয়দ রনো

0
1177

পর্ব – ৪:

সৈয়দ রনো

কয়েকটি ধর্মের আলোকে আস্তিক ও নাস্তিকঃ

আস্তিক বলতে সাধারণভাবে বুঝি ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং নাস্তিক বলতে বুঝি ঈশ্বর অবিশ্বাসী। এ বিষয়ে একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- শব্দ দুটি সবসময় একই অর্থ বহন করে না। প্রশ্ন জাগতে পারে বেশ কিছু ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই (জৈন, প্রথম অবস্থায় বৌদ্ধ, বিভিন্ন টোটেমদের ধর্ম) সেগুলোকে নিশ্চয় নাস্তিকধর্ম বা ঐ সব ধর্ম পালনকারীদের সাধারণভাবে নাস্তিক বলার উপায়ন্তর নেই।আবার, দর্শন শাস্ত্রে বিশেষত ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রমতে আস্তিক- নাস্তিকদের সংজ্ঞা অন্যরকম, কিছুটা মজারো বটে। ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়- নাস্তিক ও আস্তিক।

নাস্তিক সম্প্রদায় তিন ভাগে বিভক্তঃ

১। চার্বাক

২। বৌদ্ধ

৩। জৈন

আস্তিক সম্প্রদায় ছয় ভাগে বিভক্তঃ

১। সাংখ্য

২। যোগ

৩। ন্যায়

৪। বৈশেষিক

৫। পূর্ব-মীমাংসা বা মীমাংসা

৬। উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত

এখানে আস্তিক মানে বেদ-বিশ্বাসী, নাস্তিক মানে বেদ-বিরোধী। ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস প্রাসঙ্গিকই নয়। যাঁরা ঈশ্বর মানেন না তাঁরা যদি নাস্তিক হতেন, তবে মীমাংসকাচার্য ও সাংখ্যাচার্য নাস্তিক বলে অভিহিত হতেন। তাঁরা ঈশ্বর মানেন না। ঈশ্বর নেই- ইহা প্রচলিত সাংখ্য-দর্শনে যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যাঁরা ঈশ্বর মানেন না, গীতাতে ভগবান তাঁদেরকে অসুর-সম্পদ-যুক্ত বলে নির্দেশ করেছেন, নাস্তিক বলেননি। মীমাংসকাচার্য ও সাংখ্যাচার্য ঈশ্বর মানেননা, কিন্তু বেদের অনুসারী। তাই তাঁরা নাস্তিক নন, অতিশয় আস্তিক। অপরদিকে, চার্বাক দর্শনে, বৌদ্ধদর্শনে বেদের প্রমান অঙ্গীকৃত হয়নি বলে তারা নাস্তিক।

ইসলাম ধর্মের আলোকে আস্তিক ও নাস্তিকের ব্যাখ্যাঃ

ইসলামে আস্তিক শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে- মু’মিন বা ঈমানদার। এই ঈমান হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহতে বিশ্বাস। আল্লাহর রাসুল হিসাবে মুহাম্মাদ সা. এর উপরও বিশ্বাস (কালেমা তাইয়েবা)। আর নাস্তিক শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে-

১। কুফর

২। শিরক

৩। মোনাফেকি

নাস্তিক শব্দের সবচেয়ে কাছের শব্দটি হলো কুফর। কুফর শব্দটি সাধারণভাবে ঈশ্বরকে নির্দেশ করে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি অনাস্থা/অবিশ্বাস/অংশীদ্বারকে নির্দেশ করে। ‘কুফর’ হচ্ছে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসাবে অস্বীকার করা। এ ক্ষেত্রে আল্লাহকে অস্বীকার করে অন্য কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করলেও সে কাফির। শিরক হচ্ছে অংশীদার করা- অর্থাত আল্লাহর গুনসমূহে অন্য কাউকে অংশীদার করলে তা হয় শিরক। এ বিশ্লেষণে পৌত্তলিকতা বা মূর্তি-পূজা শিরক। এই শিরককে কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসাবে ইসলাম ধর্মে গণ্য করা হয়েছে। অপরদিকে ‘মোনাফেকি’ও আল্লাহকে অবিশ্বাস- কিন্তু এটা হলো তাদের ক্ষেত্রে যারা মুখে বা উপরে-উপরে বিশ্বাস প্রদর্শন করে কিন্তু অন্তরে অবিশ্বাস ধারণ করে। প্রচলিত অর্থে শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। ধর্ম পালনকারীদের সাধারণভাবে নাস্তিক বলা হয় না। (ধর্মে ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হলেও) অনেক সময়ই পৈত্রিক ধর্মকে অস্বীকারকারীকে নাস্তিক বলা হয়। একজন মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কেউ হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুললে বা হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী একজন ইসলামধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুললে, তাকে হয়তো নাস্তিক বলা হয় না। যখন কেউ তার পৈত্রিক ধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাস নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলতে থাকে এবং নতুন কোন ধর্মে নিজেকে সমর্পিতও না করে- তখন তাকে কখনও কখনও নাস্তিক বলে অভিহিত করা হয়। এখন যদি কেউ বলে- সে প্রচলিত কোন ধর্মের অনুশাসন মানে না, বিশ্বাসও করে না, কিন্তু সে জগত-সংসারের সৃষ্টিকর্তা একজন কেউ আছে বলে বিশ্বাস করে- তবে তাকে কি বলে আখ্যায়িত করা হবে? আস্তিক না নাস্তিক?

পর্যালোচনাঃ

প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলেছেন- “তাকে নাস্তিক বলতে হবে”কেউ বলেছেন “আস্তিক “আবার কেউ বলেছেন সংশয়বাদী। সংশয়বাদ নিয়ে অনেকে গঠনমূলক আলোচনাও করেছেন। সংশয়বাদীদের পক্ষে একালের দার্শনিকদের মধ্যে বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা সর্বাগ্রে আসে। তাঁর ‘দি প্রব্লেমস অব ফিলসফি’ গ্রন্থ আরম্ভই করেছেন এভাবে, “এমন কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান কি আছে যাকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনও সন্দেহ করবে না?” দর্শনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “সাধারণ চোখে যাকে জ্ঞান বলে মনে হয়, তার সম্বন্ধে আমাদের মনে সংশয় জাগে এবং এ সংশয়ের উত্তর পাওয়া যেতে পারে কেবল এক বিশেষ ধরণের অনুসন্ধানের ভাবনায়। এ অনুসন্ধানের আমরা নাম দেই দর্শন”। এতো গেল হালের দার্শনিকের কথা। সে আমলে সংশয়বাদী দার্শনিকের কথাও একটু আলোচনা করা যাক। গ্রীক দার্শনিক পাইরো বলেন, “আমরা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ দ্বারা বস্তুর বৈশিষ্ট নয়, এর বাহ্যিক রূপটাকেই শুধু জানতে পারি”। তাঁর মতে, “হয়তো কোন যুক্তির বিপরীত আরও মজবুত প্রামান্য যুক্তি পাওয়াও সম্ভব”। “কোন বস্তুর সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হলে প্রমান দরকার- যা কিনা নিস্ফল তর্ক; আবার তাকে খন্ডানোর জন্য নতুন প্রমান চাই”। এই পাইরো কিন্তু সেকালের স্টোয়িকদের ঈশ্বরবাদকে ক্রমাগত যুক্তি দিয়ে খন্ডন করে গেছেন। সে সময়ে আমাদের দেশের নাগার্জুনও কিন্তু পাইরোর অনুরূপ মত ধারণ করতেন।

এবার তাহলে আমাদের ভারতীয় দর্শনের দিকে একটু তাকাই। অনেকান্তবাদ ও স্যাদবাদ- খুবই চিত্তাকর্ষক ও মজার এই মতকে কি বলবেন? নিরীশ্বরবাদী জৈনধর্মের আধার হলো স্যাদবাদ। তা কিন্তু আবার এসেছে সঞ্জয় বেলঢ্বিপুত্বের অনেকান্তবাদের হাত ধরে। সঞ্জয় পরলোক, দেবতা প্রভৃতি তত্বের নিশ্চয়াত্মক রূপে কিছু বলতে অস্বীকার করেন এবং সেই অস্বীকারকেও চার স্তরে বিভক্ত করেছেন-

১। আছে? – বলা যায় না।

২। নেই? – বলা যায় না।

৩। আছেও আবার নেইও? – বলা যায় না।

৪। আছে নেই আবার নাও নেই? বলা যায় না।

এই চারের সাথে আরও তিন যুক্ত করে জৈনধর্মের সপ্তরূপ তথা তাদের স্যাদবাদঃ

১। আছে? – হতে পারে(স্যাদ আস্তি)।

২। নেই? – নাও হতে পারে( নাস্তি)।

৩। আছেও আবার নেইও? – হতেও পারে নাও পারে।

প্রাচীন ভারতের “আস্তিক” “নাস্তিক” সজ্ঞা অন্য রকম। পরলোক তত্ত্বে বিশ্বাসীদের আস্তিক আর অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হত। পাণিনি রচিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’র নাম সবারই জানা। প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণের সুবিখ্যাত নির্ভুল গ্রন্থ। পাণিনি ব্যাকরণসূত্রে আমরা জানতে পারি ‘অস্তিনাস্তিদিষ্টং মতি:(৪/৪/৬০)। অর্থাৎ পরলোক আছে ধারণায় প্রভাবিত ব্যক্তিকে আস্তিক (দিষ্টং পরলোকো অস্তি) এবং ‘দিষ্টং পরলোকো নাস্তি’ অর্থাৎ পরলোক নেই ধারণায় প্রভাবিত ব্যক্তিকে নাস্তিক বলা হয়েছে। (অস্তিগতিরস্য=আস্তিকঃ পরলোকোঽস্তি ইতি যস্য গতিরস্তি স আস্তিকঃ) পাণিনি সূত্রের ব্যাখ্যাকার ব্যাকরণবিদ্ মহর্ষি পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ গ্রন্থের মতানুসারে ‘অস্তি’ (আছে) ধারণার বশবর্তী ব্যক্তিগণ আস্তিক এবং ‘ন অস্তি’ (নেই) ধারণায় বশবর্তী ব্যক্তিগণ নাস্তিক পদের দ্বারা অভিধেয় (মহাভাষ্য ৪/৪/১)।

মনুসংহিতায় পাই –

অনপেক্ষিতমর্যাদং নাস্তিকং বিপ্রলুম্পকম্‌।

অরক্ষিতারমত্তারং নৃপং বিদ্যাদধোগতিম্‌।।(মনুসংহিতা ৮/৩০৯)

মনুসংহিতার টীকাকার মেধাতিথির শ্লোকে উল্লেখ আছে ‘নাস্তিক’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন “পরলোক বলে কিছু নেই, যাগ-দান-হোম এগুলিও কিছু নয়- এইরকম কথা যিনি বলেন এবং এই বিশ্বাসে যিনি চলেন তিনি নাস্তিক।”

জৈনদের ধারণা প্রাচীন ভারতীয়দের মতই। জৈনদার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়্‌দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে ‘আস্তিকবাদিনাম্’ সূত্রের দেখা পাই। টীকাকার সোমতিলক সূরীর মতে পদটির অর্থ হল- ‘পরলোকগতিপুণ্যপাপাস্তিক্যবাদিনাম্’। অর্থাৎ আস্তিকবাদী বলতে তাঁদেরকেই বোঝায় যাঁদের পরলোক, পুণ্য, পাপ ইত্যাদিতে আস্থা আছে।

অতএব যে কোন নিরীশ্বরবাদীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বেদে বিশ্বাসী এবং বেদে অবিশ্বাসী। সুতরাং খুঁটিয়ে বিচার করলে ভারতীয় ষড়্‌ দর্শন অনুযায়ী সেমেটিকিয় মূল্যবোধে (eschatology) ইংরাজী Atheism শব্দটির ভাষান্তর “নিরীশ্বরবাদ” সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে না। মনে হয় ইংরাজী এথিস্ট শব্দটির সঠিক বাঙ্গালা ভাষান্তর বা অর্থ হওয়া উচিত “বেদে অবিশ্বাসী নিরীশ্বরবাদী”।

নাস্তিকগণ ছ’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। ১. মাধ্যমিক, ২. যোগাচার, ৩. সৌত্রান্তিক, ৪. বৈভাষিক, ৫. চার্বাক ও ৬. দিগম্বর। স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন শ্রেণীর পার্থক্য বোঝানো অসম্ভব।

ভারতীয় ষড়্‌ দর্শন যারা একটু পড়ার চেষ্টা করেছেন বা ভাল ভাবে পড়েছেন তাঁরা জানেন কি ভাবে নাস্তিকত্বর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার করা হয়েছে।

ভারতীয় ষড়্‌ দর্শন অনুযায়ী নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিলে তার নাস্তিকত্বর সঠিক পরিচয় বা নাস্তিকত্বর শ্রেণী বিভাগ দিয়ে বোঝাতে হবে।

আমরা তা হলে “আস্তিক” এবং “নাস্তিক” শব্দদুটির সজ্ঞা তিনটি পেলাম।

১। পরলোক তত্ত্বে বিশ্বাসীরা আস্তিক আর অবিশ্বাসীরা নাস্তিক।

২। বেদে বিশ্বাসীগণ আস্তিক আর অবিশ্বাসীগণ নাস্তিক।

৩। যাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁরা “আস্তিক” এবং যাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না তাঁরা “নাস্তিক”।

আলোকিত প্রতিদিন/১৮ অক্টোবর’২০/এসএএইচ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here