পর্ব- ৬
সৈয়দ রনো
ইহুদি ধর্মের আলোকে আস্তিক্যবাদ:
প্রায় ২০০০ বছরের ইতিহাসে ইহুদি জনগণ এবং ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিক ছিল এর অভিযোজন এবং অবিচ্ছিন্নতা। প্রাচীন মিশর বা ব্যাবিলনিয়া সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আধুনিক পশ্চিমা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী এবং আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সাথে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে ইহুদিবাদকে। প্রতিটি গোষ্ঠী এবং মতাদর্শ থেকে বেশ কিছু জিনিস ইহুদি সমাজ-ধর্মীয় কাঠামোতে যুক্ত হয়েছে। এতে করে প্রাচীন ঐতিহ্যও কখনও ক্ষূণ্ন হয়নি। এভাবেই একদিকে অভিযোজিত হয়েছে এ ধর্মটিকে নিয়ে। অন্যদিকে ধর্ম তার মৌলিক ঐতিহ্যকে অটুট রেখেছে। এ কারণে যেকোন সময়ের ইহুদি ঐতিহ্য তার পূর্বের সকল ইহুদি ঐতিহ্যের সমন্বয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। যত অভিনবত্ব বা বিবর্তনই আসুক না সকল ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে সবসময়ে প্রাচীনত্ব বজায় রেখেছে ইহুদিরা। ইহুদি ধর্মের মূল শিক্ষা প্রায় সবসময়ই একেশ্বরবাদকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, যে চিন্তাকে আমরা আস্তিকবাদ হিসেবে মুল্যায়ন করতে পারি। ইহুদিদের মধ্যে অনেক শ্রেণী-উপশ্রেণী থাকলেও এক ঈশ্বর ( আস্তিক্যবাদ) বিষয়ে কারও মধ্যে দ্বিমত নেই। সবাই এক বাক্যে কেবল এক ঈশ্বরকে মেনে নেয়। একেশ্বরবাদ প্রকৃতপক্ষে সার্বজনীন ধর্মের ধারণা দেয় যদিও এর সাথে কিছুটা স্বাতন্ত্র্য্যবাদ (particularism) যুক্ত রয়েছে। প্রাচীন ইসরায়েলে এই স্বাতন্ত্র্য্যবাদ নির্বাচনে রূপ নিয়েছিল। নির্বাচন বলতে ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের মধ্য থেকে কাউকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করাকে বোঝায়। সেই তখন থেকেই ইহুদিরা মনে করতো, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে একটি পূর্বপরিকল্পিত চুক্তিপত্র (কোভেন্যান্ট) থাকতে বাধ্য। সবাইকে এই চুক্তিপত্র মেনে চলতে হবে। এ চিন্তা থেকে সরে গেলে পরকালে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ইহুদিদের এই চিন্তাধারার সাথে messianism এর সুন্দর সমন্বয় ঘটেছিল। পরিশেষে বলা যায়, যেহেতু এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী কাজেই ইহুদীদের আস্তিক বলা যায়।
খ্রিস্টান ধর্মের আলোকে ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা:
ইহুদী, খ্রিস্টান ধর্মকে কখনো কখনো ইব্রাহিমীয় ধর্ম বলা হয়। কারণ তারা সকলেই এই মতবাদ গ্রহণ করেন যে, ঈশ্বর হযরত ইব্রাহীমকে তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। একইভাবে ইব্রাহিমীয় ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদগুলো হিব্রু বাইবেলের ইসরায়েলীয় ঈশ্বর এবং একেশ্বরবাদ মতবাদের সাথে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। এই অর্থে ইব্রাহিমীয় ঈশ্বর হচ্ছে ঈশ্বর সম্পর্কে এমন একটি ধারণা যা সাধারণ বৈশিষ্ট্যে( ইসলাম)সহ মোট তিনটি ধর্মেই বজায় আছে। ঈশ্বরকে অনন্ত, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং মহাবিশ্বের স্রষ্টা হিসেবে ভাবা হয় বলেই অনেক মতো পার্থক্য থাকার পরেও এ সকল ধর্মাবলম্বীদের আস্তিক বলা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের পবিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়াশীলতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য আছে বলে ধর্মগ্রন্হে উল্লেখ আছে। ইব্রাহিমীয় ধর্মের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের নিয়মের বাইরে, যার অর্থ তিনি স্থান এবং সময়ের পরিধির বাইরে এবং সেইজন্য তার সৃষ্টির কোনকিছুর সাথে তুলনা করার বিষয় নন। একই সময় তিনি তাঁর সমস্ত সৃষ্টির প্রার্থনা শোনেন এবং কৃতকর্ম দেখেন। এ আলোচনা যৌক্তিক ভাবে আস্তিকবাদে সমর্থন করে। ইহুদীধর্ম কঠোর একেশ্বরবাদের উপর ভিত্তি করে তৈরি। একটি দ্বৈত বা ত্রি-স্বত্তা হিসাবে ঈশ্বরের ধারণা ইহুদীধর্ম মতবিরোধী – এটা শিরক সদৃশ বলে মনে করা হয়। এরূপ ধারণাই হলো আস্তিক্যবাদের পরিচায়ক। সবকিছুর মূল এক। এর মানে এই নয় যে তিনি কোন শ্রেণির এক, অথবা কোন একটি প্রজাতির মত, বা একটি বস্তু যা অনেক উপাদান নিয়ে গঠিত, কিংবা একটি একক বস্তু যা অসীম বিভাজ্য। বরং, ঈশ্বর একটি ঐক্য যা অন্য কোন সম্ভাব্য ঐক্যের সাদৃশ নয়।” তাওরাতে এ এরূপ উল্লেখ আছে: “শোন বনি ইসরায়েল, প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু এক”। ঈশ্বরকে অনন্ত, বিশ্বজগতের স্রষ্টা, আর নৈতিকতার উৎস হিসেবে ভাবা হয়। ঈশ্বরের ক্ষমতা রয়েছে জগতে হস্তক্ষেপ করার। ঈশ্বর শব্দটি এইভাবে একটি প্রকৃত সত্তাতাত্ত্বিক বাস্তবতা। নিছক মানুষের কল্পনাপ্রসূত নয়। মাইমোনাইডস এইরূপে ঈশ্বর বর্ণনা করেন: “সব বুনিয়াদের মূল এবং জ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে এটা জানা যে একটি আদি স্বত্তা আছে যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। স্বর্গ, পৃথিবী, এবং এদের মধ্যবর্তী যা কিছু আছে, সব সৃষ্টির মূলে রয়েছে তাঁর অস্তিত্বের সত্যতা।” যা আস্তিক্যবাদের মতোবাদের ধারক বাহক।
খ্রিস্টান ধর্মের আলোকে আস্তিক্যবাদ:
সেকন্ড টেম্পল ইহুদীধর্মের সময়টাতে খ্রিস্টধর্মের শুরু হয়েছিল। তাই এ ধর্মের অনুসারীরা ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা, সর্বজ্ঞতা, সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, ব্যক্তিত্ব, সর্বেশ্বরবাদ, উৎকর্ষ, চূড়ান্ত ঐক্য ও আধিপত্যসহ অধিকাংশ বিষয়ে ইহুদিধর্ম বিশ্বাসের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে । এক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্হাপনই হচ্ছে আস্তিক। এ ধর্মের নতুনত্ব যীশুখৃষ্টকে বিবেচনা করা হয় প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা ধারকবাহক হিসেবে। অর্থাৎ ইসরাইলের নবীদের বিধানের সম্পূর্ণতা হিসেবে সর্বাধিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলি বিশ্বাস করে যিশু একজন মানুষ হিসেবে ঈশ্বরের পুনর্বিভাব, যা ইহুদীধর্ম এবং ইসলাম থেকে খ্রীষ্টধর্মের প্রধান পার্থক্য। যদিও ব্যক্তিগত পরিত্রাণ সম্পর্কে ইহুদীধর্মে পরোক্ষভাবে বিবৃত করা হয়েছে, অনুগ্রহ ও সঠিক বিশ্বাসের জোরে ব্যক্তিগত পরিত্রাণের কথা খ্রিস্টানধর্মেই বলা হয়েছে। মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে মধ্যবর্তী কারো অস্তিত্বে বিশ্বাস নূহ আইনের সাথে বিরোধ করে এবং একেশ্বরবাদে অস্বীকার করে। অধিকাংশ খ্রিস্টানের জন্যই, ঈশ্বর সম্পর্কে বিশ্বাস ত্রি-স্বত্তা মতবাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যাতে বলা হয় যে তিনজন ঈশ্বর একসঙ্গে একজন একক ঈশ্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই মতবাদ মূলত নিসিয়া কাউন্সিলে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং নিসিয়ান ধর্মমতে সন্নিবেশিত রয়েছে। ত্রি-স্বত্তা মতবাদ এ বিশ্বাসের উপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে , ঈশ্বরের একটি ইচ্ছা আছে, এবং ঈশ্বরপুত্রের দুইটি ইচ্ছা আছে- ঐশ্বরিক ও মানবিক এবং এরা কখনোই পরস্পর সংঘাতী নয়, বরং হাইপোস্ট্যাটিক সংঘে মিলিত। খ্রিস্টানদের একটি ছোট সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যারা একত্ব মতবাদের অধীনে এসেছেন। তারা ত্রি-স্বত্তা মতবাদ বিশ্বাস করেন না।
মর্মনিজম সম্পাদনা:
মর্মন সম্প্রদায়ের অধিকাংশ (পরবর্তী দিনের সাধুদের যীশু খ্রীষ্টের চার্চ সহ) প্রতিনিধিত্ব মর্মনিজমে, ঈশ্বর মানে। এলোহিম (পিতা), আর গডহেড হচ্ছে তিনজন পৃথক ঈশ্বরের একটি কাউন্সিল; এলোহিম, যিহোবা (পুত্র বা যীশু), এবং পবিত্র আত্মা। পিতা ও পুত্রের শরীর আছে এবং পবিত্র আত্মা একটি আত্মা যার কোন শরীর নেই। এই ধারণা প্রচলিত খ্রিস্টান ট্রিনিটি থেকে পৃথক। মর্মনিজম মতে ঈশ্বর তিনজন শারীরিকভাবে আলাদা স্বত্তা, বা ব্যক্তিবর্গ, কিন্তু ইচ্ছায় ও উদ্দেশ্যে একতাবদ্ধ। মর্মনিজমে গডহেডের সংজ্ঞা প্রচলিত খ্রিষ্টধর্ম থেকে পৃথক। ঈশ্বরের এরূপ বর্ণনা ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী দিনের সাধুদের যীশু খ্রীষ্টের চার্চ (এলডিএস চার্চ) এ দৃঢ় বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে।
আলোকিত প্রতিদিন/২০ অক্টোবর’২০/এসএএইচ