পর্ব : ৮
সৈয়দ রনো
তাওরাত (তোরাহ) হচ্ছে হিব্রু ভাষায় রচিত ইহুদীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। হিব্রু ভাষায় এর নাম তোরাহ্ । তোরাহ্ শব্দের অর্থ “আইন”, “নিয়ম”, বা “শিক্ষণীয় উপদেশ”। তাওরাত ৫ টি পুস্তকের সমন্বয়ে গঠিত। তাই তাওরাতকে অনেকে মুসা নবীর “পঞ্চ পুস্তক” বলে থাকেন। ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসীরা মনে করেন তাওরাত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্ববর্তী নবী মুসা (আঃ) উপর অবতীর্ণ একটি আসমানি কিতাব। ইসলাম ধর্মের আলোকে কোরআন নাযিল হওয়ার মধ্যে দিয়ে এ কিতাবকে রদ রহিত করা হয়েছে। তাওরাত ইহুদীদের ধর্মীয় রীতি-নীতির মূল ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তাওরাত একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ “শিক্ষা”। তাওরাত মূলত তাদের ধর্মগ্রন্থ তানাখের প্রথম অংশকে বোঝালেও, সার্বিকভাবে তোরাহ বলতে ইহুদিদের লিখিত ও মৌখিক শিক্ষা, যেমন – মিশনাহ, তালমুদ, মিদ্রাশ, ইত্যাদি ধর্মীয় অনুশাসনমূলক গ্রন্থকে একসাথে ইঙ্গিত করে। ইহুদীরা মনে করেন তাওরাত(তোরাহ) হলো মুসা নবীর নিকট ঈশ্বরের সরাসরি প্রদত্ত বাণী। এ রূপ নিদর্শন হচ্ছে আস্তিক্যবাদের মুল বক্তব্য।
পন্ডিত জনেরা অন্যভাবে বিশ্লেষণ করে বলেছেন- হিব্রু শব্দ “তোরাহ” মূল শব্দ (ইউরহা) থেকে এসেছে, যার অর্থ দাড়ায় “নির্দেশনা/শিক্ষার জন্য”। এছাড়াও বিভিন্ন অনুবাদে তোরাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষা, উপদেশমালা, নির্দেশাবলী, সর্বজন গ্রাহ্য নিয়মনীতি, ব্যাবস্থাপনা ইত্যাদি। রাব্বাইয়ানিক ইহুদীবাদের লিখিত নিয়মনীতি ও মৌখিক নিয়মনীতি বোঝানোর জন্য “তোরাহ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইহুদী ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে “তোরাহ” মূলগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বিকল্প নামসমূহ সম্পাদনা-
খ্রিস্টান পন্ডিতরা “তোরাহ” কে হিব্রু বাইবেলের প্রথম পাচ গ্রন্থ পুরাতন বাইবেল হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইসলাম ধর্মেও “তোরাহ”র অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় মূসা (আঃ) এর উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব “তাওরাত” হিসেবে।তাওরাত এ এক ঈশ্বরের বিশ্বাস বর্ণিত হয়েছে বলে, দর্শন তত্ত্বের আলোকে আস্তিকবাদী গ্রন্থ বলে পন্ডিত জনেরা মনে করেন।
মহান সৃষ্টিকর্তা প্রভুর দ্বারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিবরণ দিয়ে তোরাহ শুরু হযেছে। সৃষ্টিকর্তা আছেন এ ধারণাই হচ্ছে আস্তিক্যবাদ। আদম (আঃ) থেকে নূহ নবী পর্যন্ত বংশ-তালিকা ও মহা প্লাবনের ঘটনাক্রম বর্ণীত হয়েছে এ আসমানী কিতাবে। আরো যুক্ত করা হয়েছে ইব্রাহিম বা আব্রাহাম নবীর বংশের বিবরণ এবং ইসরাইল জাতির সুচনালগ্ন। প্রাচীন মিশর দেশে পুনর্বাসনের কাহিনী এবং সিনাই উপত্যকায় তোরাহ নাযিলের কাহিনী। মিশর দেশ থেকে মুক্ত হয়ে কানান দেশে ইসরাইল জাতির ফিরে আসা এবং মুসা নবীর মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দিয়ে তোরাহ গ্রন্থটির উপসংহার টানা হয়। হিব্রু ভাষায় তোরাহ’র পাঁচটি বইয়ের নিজস্ব নাম দিয়ে শুরু হয়েছে- ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি নাম প্রাচীন গ্রিসের ভাষা থেকে এসেছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন। তাওরাত-এর মধ্যে হিব্রু বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই পড়ে। এই পঞ্চ পুস্তকের নাম নিম্নরূপঃ যথা –
১। বেরেসিট,অর্থ (“সব কিছুর শুরুতে”)- আদি পুস্তক।
২। শিমট (অর্থ “নামসমূহ”)- যাত্রাপুস্তক।
৩। ভাইকরা অর্থ “তিনি ডেকেছেন”)- লেবীয় পুস্তক।
৪। বেমিদবার (অর্থ “মরুভুমির মাঝে”)- গণনাপুস্তক।
৫। ডেভারিম (অর্থ “বাণী বা আদেশনামা)-
বিবরণঃ
১।আদি পুস্তক :
মৌলিক সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে আদিগ্রন্থের শুরু হয়। প্রথম মানব আদম থেকে শুরু করে নুহ নবী পর্যন্ত বংশতালিকা ও ঘটনার বিবরণ এখানে উল্লেখ করা হয় (অধ্যায় ১-১১)। এছাড়াও এক-ইশ্বরবাদের তিন পিতৃপ্রজন্ম যথাক্রমে ইব্রাহিম, ইসহাক এবং ইয়াকুব (ইসরাইল), এবং চার মাতৃপ্রজন্ম যথাক্রমে ঃ সারাহ, রেবেকা এবং লেহ ও রাখেল এর সময়কার ঘটনাবলি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে । এখানে সৃষ্টিকর্তা প্রভু এই প্রজন্মকে কানান দেশের অধিকারী করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেন। জেনেসিসের শেষের দিকে ইয়াকুব পুত্র ইউসুফ মিশর দেশে বসবাস করতে থাকেন এবং মিশরীয় জাতিকে মহা দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেন। তিনি সেখানকার রাজ সভায় গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন ও করেন। (অধ্যায় ১২-৫০)।
২। যাত্রাপুস্তক :
মুসা নবী কর্তৃক ইসরাইলী জাতিকে মিশর দেশের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে সিনাই উপত্যকা পর্যন্ত নিয়ে আসার ঘটনা দিয়ে যাত্রাগ্রন্থের শুরু হয়। (অধ্যায় ১-১৮)। কিভাবে ইসরাইলের লোকেরা ইশ্বরের আদেশ মেনে নেয়। নিজেদেরকে শত্রু থেকে রক্ষা করে। মুসা নবী সরাসরি প্রভুর কাছ থেকে তোরাহ লাভ করেন ( আস্তিক্যবাদের নিদর্শন হিসেবে) এবং নিজ জাতিকে এর নিয়মনীতি শিক্ষা দেন এ বিষয়ে বিষদ বর্ণনা করা হয় (অধ্যায় ১৯-২৪)। এছাড়াও ইসরাইলের জাতি স্বর্ণ দিয়ে গোবাছুর তৈরি করে সর্বপ্রথম তোরাহ-র নিয়ম ভঙ্গ করে এ বিষয়ে এখানে উল্লেখ আছে (অধ্যায় ৩২-৩৪)। ইহুদী ধর্মের জন্য কিভাবে পবিত্র উপাসনার স্থান নির্মাণ করতে হবে এ বিষয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে এক্সোডাস বা যাত্রাগ্রন্থ শেষ হয় (অধ্যায় ২৫-৩১;৩৫-৪০)
৩।লেবীয় পুস্তক :
ইসরাইলের জাতি কিভাবে পবিত্র উপাসনার স্থান ব্যবহার করবে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে লেবীয়-গ্রন্থ শুরু হয় (অধ্যায় ১-১০)। পবিত্র-অপবিত্র বস্তু সম্পর্কে ধারণা প্রদান (অধ্যায় ১১-১৫), যার মধ্যে আছে কিভাবে পশু উতসর্গ করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত করার নিয়মাবলি (অধ্যায় ১৬), এবং বিভিন্ন মানবিক নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করার নিয়মনীতি বর্ণনা করা হয় (অধ্যায় ১৭-২৬)।
৪। গণনাপুস্তক :
ইসরাইলের জাতি সিনাই উপত্যকায় নিজেদেরকে জাতি হিসেবে দৃঢ় ও সংঘবধ্য করার কাহিনী (অধ্যায় ১-৯)। সিনাই উপত্যকা থেকে কেনান দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কাহিনী গণনাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয় (অধ্যায় ১০-১৩)। মিশর দেশ থেকে মুক্ত হয়ে প্রায় ৪০ বছর মরু প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ইসরাইল জাতির নিজেদের মধ্যে নানারকম অবিশ্বাস জন্ম নেয়। কারণ তারা তখন পর্যন্ত কেনান দেশে প্রবেশ করতে পারেনি। মুসা নবীর জীবদ্দশায় তারা কানান দেশ লাভ করতে পারেন না। পরবর্তীকালে তারা কেনান দেশে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে (অধ্যায় ১৪-৩৫)।
৫। দ্বিতীয় বিবরণ :
দ্বিতীয় বিবরণ গ্রন্থ হচ্ছে মুসা নবী কর্তৃক বর্ণীত নির্দেশনা সমূহ। এখানে বলা হয়-ইসরাইলের জাতি যেন কখনো মূর্তি পূজা না করেন। কানান দেশের রাস্তা যেন অনুসরণ না করে এবং ইশ্বরের নাম যেন উতখাত না করে। অর্থাৎ আস্তিক্যবাদের মুল দর্শন হলো এক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্হাপন করা। মুসা নবী ইসরাইলের জাতিকে সৎ পথে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন আদেশ ও নিয়মনীতি প্রণয়ন করে (অধায় ১-২৮)। ড্যুটারনমি বা নির্দেশনা-গ্রন্থ এর শেষভাগে মুসা নবী পর্বত থেকে প্রতিশ্রুত ভুমি দেখতে পান ও ইন্তেকাল করেন । জীবনের শেষ ভাগে এসে মুসা নবী জশুয়া কে ইসরাইলের নেতৃত্ব প্রদান করেন, যাতে তারা কানান দেশের অধিকারী হতে পারে (অধায় ২৯-৩৪)।
ইসলামের ইতিহাস এখানে বিবর্তন ঘটে, সঠিক সত্য উদঘাটিতি হয়নি । প্রকৃত সত্য হলো আসমানি কিতাব তাওরাত বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের পুরনো নিয়মের প্রথম পাঁচ পুস্তক (আদিপুস্তক, যাত্রাপুস্তক, গণনাপুস্তক, লেবীয় পুস্তক ও দ্বিতীয় বিবরণ অথবা অন্য শব্দে পয়দায়েশ, হিজরত, লেবীয়, শুমারী ও দ্বিতীয় বিবরণ) নয়; বরং তাওরাত হচ্ছে সেই কিতাব, যা ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে দান করেছিলেন।
বসবাস শুরু :
বর্তমানে বেশিরভাগ ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্রে( অবৈধ ভাবে দখলকৃত) বসবাস করছে। জাতিসংঘের বেশিরভাগ রাষ্ট্র এই দেশকে দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে জানে। মুসলিম দেশ হিশাবে মিশর প্রথম এই রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। তবে বেশিরভাগ মুসলিম দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় নাই। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের দেশ দখল করে আজ তাদেরই উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
বাহাই লিপির আলোকে আস্তিক্যবাদ :
বাহাই লিপি একজন একেশ্বরবাদী, অগম্য, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, অক্ষয়, এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বর্ণনা দেয় যিনি মহাবিশ্বের সকল কিছুর স্রষ্টা। ঈশ্বর এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে শাশ্বত বলে মনে করা হয়, যার কোন শুরু বা শেষ নেই। এর তাত্বিক বিশ্লেষণই হচ্ছে আস্তিক্যবাদ।
সৃষ্টি প্রার্থনা, প্রতিফলন, এবং মানবজাতির সেবায় নিয়োজিত হয়ে, তাঁর স্রষ্টা সম্পর্কে জানার এবং তাকে ভালোবাসার ক্ষমতা অর্জন করবে। ঈশ্বর মানবজাতির প্রতি তার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করেন। মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে, যারা ঈশ্বরের প্রকাশ হিসেবে পরিচিত, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ধর্মের বর্তমান কাল পর্যন্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করা নবী ও রাসূলগণ।
নবীগণের চরিত্রে ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রতিফলন হয়। যাদেরকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন মানবকূলের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানদানের জন্য।বাহাই মতে, সমস্ত জীবিত স্বত্তা এই বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্তত একটি এবং মানুষের আত্মা সম্ভাব্য তাদের সবকয়টি প্রতিফলিত করতে পারে।বাহাই মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ, নরত্বারোপ, এবং পুনর্বিভাব বিশ্বাস অস্বীকার করে। কাজে কাজেই বাহাই লিপি হলো আস্তিক্যবাদের ধারক বাহক।
আলোকিত প্রতিদিন/২ নভেম্বর’২০/এসএএইচ