ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন সুস্থ থাকুন
ডা: মোহাম্মদ আহাদ হোসাইন
আমাদের শরীরকে সুস্থ সুন্দর ও রোগমুক্ত রাখার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অতিরিক্ত ওজন শরীরের জন্য যেমন বিভিন্ন রোগের আবির্ভাব ঘটাতে পারে তেমনি আমাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদী রোগগুলো মূলত ওজন নিয়ন্ত্রণ না করার ফলেই হয়ে থাকে। যারা উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস অথবা থাইরয়েড এর সমস্যায় আক্রান্ত আছেন তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রথম যে পরামর্শটি তারা দিয়ে থাকেন সেটি হচ্ছে ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ওজন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো? এই প্রশ্নটি সমাধান যেমন এক কথায় দেয়া সম্ভব না। আবার এটাও সত্য যে প্রেস্ক্রিপশন আকারে এটি দেওয়া কঠিন। আজকে আমি ওজন নিয়ন্ত্রণ এর জন্য খুবই সংক্ষিপ্ত একটি নির্দেশনা দিবো। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন সেটার কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না তাদের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ওজন বাড়ার মূল উপাদান :
আমাদের শরীরের ওজন বাড়ার মূল উপাদান হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা শুধু নিজেই ওজন বাড়ায় না বরং এটি শরীরে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এক গ্রাম কার্বোহাইড্রেট প্রায় তিন গ্রাম পানি ধরে রাখতে পারে। যে কারণে আমরা যদি বেশি বেশি কার্বোহাইড্রেট খাই সেক্ষেত্রে শরীর ফুলে যায় এবং ওজন বাড়তে থাকে। এইজন্য বলা যায় আমাদের শরীরের ওজন বাড়ার জন্য মূল ভূমিকা এই কার্বোহাইড্রেটের।
কার্বোহাইড্রেট এর প্রয়োজনীয়তা :
কার্বোহাইড্রেট যেমন আমাদের শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয় আবার একই সাথে পরিমিত কার্বোহাইড্রেট আমাদের শরীরের জন্য দরকার। শরীরের সকল ধরনের বায়োকেমিক্যাল রিয়েকশন সঠিকভাবে করার জন্য পরিমিত কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন আছে। আমাদের শরীরে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ যদি শূন্য করে দেয়া দেয়া হয় তাহলে শরীর একটি স্ট্রেসফুল কন্ডিশনে চলে যায়। আর স্ট্রেসফুল কন্ডিশনে স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন বেশি নিঃসৃত হয়, যা আমাদের শরীরের জন্য ভালো নয়। তাই পরিমিত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন আছে।
কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ কীভাবে কমিয়ে আনা যায় :
আমাদের দেশে সাধারণত সবাই কার্বোহাইড্রেট বা ভাতের উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই তিন বেলা খেয়ে অভ্যস্ত।তাই হঠাৎ করে যদি কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ শূন্য করে দেয়া হয় তাহলে এটা অনেকের জন্যই কষ্টকর হতে পারে। তবে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনলে এটা শরীরের জন্য সহনীয় হয় এবং ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হতে পারে।
প্রথমত আমরা যেটা করতে পারি সেটা হচ্ছে আমরা প্রথম সপ্তাহে আমাদের তিন বেলা যা খাই তা ৫০ ভাগ করে নিতে পারি। তার মানে হচ্ছে আমি যদি ভাত খাই তাহলে ৫০ ভাগ কমিয়ে ফেলবো তিন বেলায়। আবার আমি যদি রুটি খাই সেটাও ৫০ ভাগ কমিয়ে ফেলবো ৩ বেলাতে। দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা খাবারের বেলায় পরিমাণ কমাতে পারি। সেটা এরকম হতে পারে যে দ্বিতীয় সপ্তাহে তিন বেলার জায়গায় দুইবেলা খেলাম। এরপর তৃতীয় সপ্তাহে এক বেলা খাবো। এভাবে তৃতীয় সপ্তাহে খাবারের পরিমান অর্ধেক হয়ে গেল এবং এক বেলার জন্য। এই এক বেলা সাধারণত আমরা সকালেই খেয়ে থাকি।সকালে আমি যে পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট বা ভাত বা রুটি আমি খাবো সেটি আমার সারা দিনের জন্য কার্বোহাইড্রেট এর ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম হবে।
অন্যান্য খাবার কীভাবে খাবো :
পূর্বে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম কীভাবে আমাদের কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ কমাতে পারি। কার্বোহাইড্রেট এখন শুধুমাত্র এক বেলা সকাল বেলায় খাবো।
এরপর দুপুর ও রাতে কী খাবো :
দুপুরবেলা আমরা আর কোনো কার্বোহাইড্রেট বা ভাত বা রুটি খাবো না। আমরা দুপুরে সবজি, সালাদ, মাছ অথবা মাংস অথবা ডিম পরিমিত পরিমানে খেতে পারি। আমাদের ক্ষুধা নিবারন করার জন্য এই খাবারগুলো যথেষ্ট। এই খাবারগুলোর মাধ্যমে আমাদের পেট ভরার যে বিষয়টি থাকে সেটি হয়ে যাবে। আমরা ক্ষুধা মুক্ত থাকতে পারবো। রাতের বেলা আমরা শুধু সবজি অথবা সালাদ খেতে পারি। সেই সাথে সকল মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং চা বা অন্যান্য খাবারের সাথে চিনি পরিহার করতে হবে।
রাত এবং দুপুরের মাঝামাঝি একটি সময় বা বিকালবেলা অনেকেরই নাস্তার অভ্যাস থাকে। এই সময় চিনি ছাড়া চা বা দেশী ফল যেটা খুব বেশি মিষ্টি নয় সেটা খাওয়া যেতে পারে। তবে না খেতে পারলেই ভালো। খাবার এই অভ্যাসগুলো যদি নিয়মিতভাবে করা যায় তাহলে আশা করা যায় আমাদের শরীরে কার্বোহাইড্রেট বা ভাত বা চিনি জাতীয় খাবারের চাহিদা কমে যাবে। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের শুধুমাত্র দেহের জন্য প্রয়োজনীয় শর্করা খাবার খাওয়া হবে। এই পদ্ধতি যদি আমরা তিন মাস চালিয়ে যেতে পারি তাহলে আমাদের শরীর এই খাদ্যাভ্যাসের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং আমাদের ওজন কমতে থাকবে। আপনার শরীরের এই খাদ্যাভ্যাস পরবর্তীতে ধরে রাখতে হবে এবং নিয়মিতভাবে এই খাদ্যাভ্যাসটি পালন করতে হবে। সাথে কিছু হালকা এক্সারসাইজ বা হাঁটার অভ্যাস আমরা করতে পারি। হাঁটার ক্ষেত্রে আমরা যদি দৈনিক ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করি তাহলে আমাদের দেহের খাদ্যগুলো হজম প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হবে যথাযথভাবে এবং আমাদের ক্ষুধা লাগবে। সেই সাথে নতুন খাদ্যাভ্যাস আমাদের শরীরের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করবে।
পরিশেষে বলতে চাই অতিরিক্ত ওজনের কারণে আমাদের শরীরের ভেতরে এবং বাইরে বেশকিছু সমস্যায় আমরা পরতে পারি। তাই সুস্থ থাকার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শুরু করা হচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিন- আজ, এখনই, এই মুহূর্তে। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
লেখাটির সাথে ভিডিও দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
(লেখক : কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।
চেম্বার : বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, কাটাবন, ঢাকা।)
আলোকিত প্রতিদিন/৬ ডিসেম্বর-২০২০/জেডএন