৩১ জানুয়ারী আন্তর্জাতিক কুষ্ঠ দিবস

0
410

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি: কালিয়কৈরের বান্দাবাড়ী আশ্রয়ন প্রকল্প, কুষ্ঠ রোগীরা ভিক্ষাবৃত্তি থেকে প্রতিষ্ঠিত জীবনে।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বান্দাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০ কুষ্ঠ রোগীর পরিবার এখন প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ সময় রোগ ভোগের পর তারা সহায় সম্বল হারিয়ে ভিক্ষা বৃত্তিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। ২০০০ সনে তাদের প্রত্যেক পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি উদ্যোগে ৭০টি বসতঘর নির্মাণ করে দেন। এক সময় কুষ্ঠ রোগ সামাজিক অভিশাপ হলেও ভুক্তভোগীরা এখন সামাজিক মর্যাদায় জীবনযাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সহায়তায় তারা ভিক্ষাবৃত্তি থেকে জীবিকার পথ পরিবর্তন করেছেন। কুষ্ঠ রোগে ভুগেছেন এমন ব্যাক্তিদের চিহ্নিত করে ৬০জনকে সপরিবারে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয় দেয়া হয়। যারা রোগী ছিলেন তাদের ৬০ জনের মধ্যে বার্ধক্যজনিত ও অন্যান্য কারণে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে তাদের মধ্যে ২০ জন বেঁচে আছেন। তবে তারা সুস্থ হয়ে উঠার পর প্রকল্পে নতুন কোনো কুষ্ঠ রোগী নেই। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের প্রত্যেক পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য কুষ্ঠ রোগে ভুগেছেন। তারা বিতাড়িত হয়েছেন তাদের সমাজ থেকে কেউ বা পরিবার থেকে। পরিবার ও সমাজের লোকজন এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদেরকে এড়িয়ে চলতো। তারা রাজধানী ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, শাহবাগের মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতেন। এখন তারা স্বজন, সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। সপরিবারে মৌলিক অধিকার ফিরে পেয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তাদের সহায়তায় সরকারি, বেসরকারী এবং দাতা সংস্থাসমূহ এগিয়ে এসেছেন। তাঁরাও স্বনির্ভর হয়েছেন, নিজে অথবা পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করছেন। সমাজ ও পরিবার থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা একেকজনের ক্ষেত্রে আজ থেকে ৫০ বা ৩০ বছর আগের। তাদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলায়। কুড়িগ্রাম জেলার উলিরপুর এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান (৬৫) বলেন, স্বাধীনতার আগে শৈশবকালেই তার হাত পায়ের আঙুলে হঠাৎ করেই পচন দেখা দেয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা বাড়তে থাকে। স্থানীয়দের পরামর্শে তিনি নীলফামারী জেলা সদর হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে তাকে জানানো হয় তার কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। তার কুষ্ঠ রোগের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে তার দুই হাতের আঙ্গুল ও দুই পা চিকিৎসকের পরামর্শে কেটে ফেলতে হয়। আর তখন থেকেই সমাজ এমনকি পরিবারের সদস্যরা তাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। জীবিকার তাগিদে তিনি চলে যান রাজধানী ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখানে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ ও পরে বিয়ে করেন। তার সাথে কুষ্ঠ রোগে অঙ্গ হারানো আরও অনেক নারী-পুরুষ, শিশু স্টেশনে ভিক্ষাবৃত্তি করতো। আশ্রয়নের ইতিহাস জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরেন তখন ভিক্ষিাবৃত্তিতে জড়িত কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের সাথে যোগাযোগ করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে তাদেরকে পুনর্বাসন করার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে ২০০০ সনে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লোক পাঠিয়ে কুষ্ঠ রোগে ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করেন। পরে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে ডেকে নিয়ে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরীর আশ^াস দেন। একই বছরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বান্দাবাড়ী আশ্রয়ন প্রকল্পে বসতঘর নির্মাণ করে তারেদকে সেখানে নেয়া হয়।

নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার খালিকা চাপানি গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে হাফিজুর রহমান (৫২) বলেন, কিশোর বয়সে তাঁর পায়ে প্রথম ফুসকা পড়ে। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কুষ্ঠ রোগী হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপত্র দেন। কুষ্ঠ রোগে তার দুই পায়ের আঙ্গুলে পঁচে যায়। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলা হয়। সমাজ ও স্বজনেরা কুষ্ঠ রোগী হিসেবে এড়িয়ে চলে। জীবিকার তাগিদে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করেন। পরে বান্দাবাড়ী আশ্রয়ন প্রকল্পে আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করেন। তাঁর তিন কন্যার মধ্যে দু’জন মাধ্যমিক পাশ করেছে ও একজন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার মৈশ গ্রামের জুলেখা (৫০) জানান, তাঁর স্বামী আব্দুল গফুর কুষ্ঠ রোগে ভুগে অঙ্গ হারিয়েছেন। কুষ্ঠ রোগী হিসেবে আশ্রয়ন প্রকল্পে একটি থাকার ঘর পেয়েছেন। তাদের একটিমাত্র ছেলে জুয়েল রানা এখন বিশ^বিদ্যালয়ে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। মতিয়ার রহমানের স্ত্রী জুলেখা বেগম (৬০) বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাত পায়ের আঙ্গুল হারিয়েছেন। গ্রামের মানুষ কুষ্ঠ রোগের কারণে তাকে ঘৃণা করেছেন। পরে ঢাকায় এসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে আর গ্রামে ফিরে যাননি। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় ভিক্ষা করেছেন। আশ্রয়ন প্রকল্পে ঠাঁই হওয়ার পর ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। ছেলে মেয়রা লেখাপাড়া করে শিল্প কারখানায় চাকুরী করছেন। কুড়িগ্রাম জেলা সদরের কুড়িগ্রাম এলাকার বাসিন্দা নূরুল হক (৫৭) বলেন, কুষ্ঠ রোগের কারণে এলাকার মানুষ আমাদের ছোট করে দেখত, অবজ্ঞা করত। চিকিৎসা করতে ঢাকায় এসে সহায় সম্বল সব শেষ করেছি। পরে বাঁচার তাগিদে ভিক্ষা করেছি। এখনও পর্যন্ত কুষ্ঠ রোগে যারা অঙ্গ হারিয়েছেন তারা কেউ সচল হতে পারেননি। অন্যের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। আশ্রয়ন প্রকল্পে জায়গা পেয়ে বেশ ভাল আছি। ছেলে-মেয়ে মানুষ হচ্ছে। নীলফামারী জেলা সদরের নটখানা গ্রামের আজিজার রহমানের ছেলে নূরুল ইসলাম (৫৮) বলেন, তিনি ১৯৮০ সনের দিকে তার হাতের আঙ্গুল বাঁকা ও নরম হয়ে যায়। নীলফামারী জেলা সদর হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কুষ্ঠ রোগী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ রোগের কথা শোনে তাঁর স্ত্রী এক পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে তাকে ফেলে চলে যান। পরে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হন। কিন্তু এলাকা থেকে অনেকটা বিতাড়িত হয়ে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে মানুষের কাছে চেয়ে জীবকিা নির্বাহ করেন। সেখানে তার মতো কুষ্ঠ রোগে ক্ষতিগ্রস্তÍ আরো অনেককে দেখতে পান। পরে আবার দ্বিতীয় বিয়ে করে আশ্রয়ণ প্রকল্পে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করছেন। বড় কন্যাকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন এবং ছোট কন্যা ১০ম শ্রেণীতে পড়ছে। আশ্রয়ন প্রকল্পে ৬০জন কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত নর-নারীকে ২০০০ সনে সপরিবারের আশ্রয় দেয়া হয়। তাদের সাথে তাকেও বসতঘর দেয়া হয়। মোট ৮ একর ৭০ শতক জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক সদস্যকে ১০ শতক জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) ডা: আল বেলাল জানান, বান্দাবাড়ী আশ্রয়ন প্রকল্পের জন্য একজন ডাক্তার নিয়োজিত আছে। সে নিয়মিত ওই আশ্রয়ন প্রকল্পে গিয়ে তাদেরকে পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী হাফিজুল আমিন বলেন, প্রচলিত ভাতা ছাড়াও তাদের জন্য সরকাারিভাবে নিয়মিত বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। নিরাপদ পানির জন্য সাব মার্সিবল পাম্প, গোসলখানা, শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। একটি সুদৃশ্য পুকুর ও তাতে দুটি ঘাট নির্মাণের কাজ চলছে। প্রত্যেকের বসতঘরের মেঝে পাকা করে দেয়া হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারে চিকিৎসকেরা নিয়মিত তাদের সাধারণ সেবা ও কুষ্ঠ রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ব্যাক্তিদের প্রতি মাসে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের আর্থিক সহায়তায় উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বোপরি তারা এখন ভিক্ষাবৃত্তি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারসহ উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে।

 

আলোকিত প্রতিদিন/৩০ জানুয়ারি’২১/এম.জে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here