সমৃদ্ধ বাংলা‌দেশ ও শিশুর নিরাপদ ভ‌বিষ‌্যৎ গঠনই হোক অঙ্গীকার: রেজাউল ক‌রিম

0
443

প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: 

মার্চ মাস বাঙা‌লি জাতীয় জীব‌নে অ‌বিস্মরণীয় অধ‌্যায়। মার্চ এ‌লেই বাঙা‌লি মনপ্রাণে লা‌গে এক  অন‌্য রকম দোলা, জা‌গে চ‌্যা‌লেঞ্জ মোকা‌বেলার রোমাঞ্চ। গা‌য়ে লা‌গে যেন উদ্দীপ্ত মশা‌লের উত্তাপ। স্ব‌দেশ প্রেমের উজ্জীবনী শ‌ক্তি‌তে বলিয়ান ক‌রে কেউ যেন ডে‌কে নি‌য়ে যে‌তে চায় মশাল জ্বলা আ‌লোর মি‌ছি‌লের পা‌নে।

দীর্ঘ শোষন, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরু‌দ্ধে দ্রো‌হের আগুনে জ্বলসে ওঠা বাঙা‌লি

পরাধীনতার নাগ পাশ ছি‌ড়ে স্বাধীনতার সূর্য আন‌তে চূড়ান্ত পথ ধ‌রে‌ছিল ১৯৭১ এর মা‌র্চেই। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মু‌ক্তিযু‌দ্ধে। বিষাদ বেদনার পথ পে‌রি‌য়ে সুচিত হয় বাঙা‌লির অ‌গ্নিঝরা ই‌তিহাসের। বজ্র কঠিন শপ‌থে স্বাধীনতার প‌থে সশস্ত্র যু‌দ্ধে অবতীর্ণ হয় জা‌তি।

নয় মাস মরনপণ যু‌দ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহী‌দের রক্ত, দুই লক্ষ মা বো‌নের সম্ভ্রম আর অগ‌ণিত মু‌ক্তি‌যোদ্ধার বিকলাঙ্গতা বরণের মধ‌্য দি‌য়ে ডিসেম্ব‌রে বিজয়ের গৌরব গাথা রচনা ক‌রে‌ছিল বাঙা‌লি। যার ম‌ন্ত্রে এক‌টি শা‌ন্তি প্রিয় ‌নিরস্ত্র জা‌তি‌ প্রতিবাদ মূখর, সংগ্রামী জা‌তি‌তে প‌রিনত হ‌য়েছিল সেই সর্বকা‌লের সর্ব‌শ্রেষ্ট বাঙা‌লি, বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জি‌বের এক‌টি মহাকা‌ব্যিক ভাষ‌নে জা‌তি শে‌ষে প‌রিনত হয় সশস্ত্র বীর যোদ্ধায়। রমনার রেস‌কোর্স ময়দা‌নে ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ গণসমু‌দ্রের গণমঞ্চ কাঁ‌পি‌য়ে যে অনবদ‌্য ভাষন রে‌খে‌ছি‌লেন তি‌নি, তা ছিল যু‌দ্ধে যাবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহ‌নের নি‌র্দেশনা, যুদ্ধ জ‌য়ের মন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর ১৮মি‌নি‌টের অলিখিত সেই ভাষন‌টি এখন বিশ্ব ঐ‌তিহ‌্য, আন্তর্জা‌তিক ভা‌বে স্বীকৃত ঐতিহাসিক এক দ‌লিল।

শতাব্দীর মহানায়ক, বাঙা‌লি জা‌তির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জিবর রহমা‌নের জন্মের একশত বছর পূর্ণ হল আজ। ১৯২০ সা‌লের ১৭মার্চ গোপালগ‌ঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতু‌নের ঘ‌রে জন্ম গ্রহন ক‌রেন খোকা মু‌জিব। সবুজ শ‌্যাম‌লিমায় ভরা প্রকৃ‌তির কো‌লে বে‌ড়ে ওঠা মু‌জি‌বের মান‌বিক গুনাবলী, মানু‌ষের প্রতি মমত্ববোধ তা‌ঁকে নেতৃ‌ত্বের আস‌নে আসীন ক‌রে‌ছিল শৈশ‌বেই। ক্রমে বিক‌শিত সে নেতৃত্ব জা‌তি‌কে দে‌খি‌য়ে‌ছিল মু‌ক্তি দিশা। জা‌তি‌কে মু‌ক্তির পথ দেখা‌তে নি‌জেই জ্ব‌লে‌ছেন। পা‌কিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর রোষান‌লে পড়ে যৌব‌নের ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাগারের অন্ধ প্রকো‌ষ্টে কাটা‌তে হ‌য়ে‌ছিল। এছাড়া মানু‌ষের কথা বল‌তে গি‌য়ে ব্রিটিশ শাসনকা‌লে স্কুল ছাত্রাবস্থায় ৭ দিন কারা ভোগ ক‌রে‌ছি‌লেন তি‌নি। কারাগারের অভ‌্যন্তরে থে‌কেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। যে ভাষা আ‌ন্দোল‌নের মাধ‌্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ অঙ্কু‌রিত হ‌য়ে‌ছিল, মু‌জিব ছি‌লেন তার অন‌্যতম পু‌রোধা।

১৯৪৭ সা‌লে ব্রিটিশ‌দের বিতাড়‌নের মাধ‌্যমে  ভারত ও পা‌কিস্তা‌নের জ‌ন্মের পর পরই পা‌কিস্তান গঠ‌নে করনীয় নির্ধারন কর‌তে পূর্ব পা‌কিস্তা‌নের কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটে‌লে সমবেত হয়ে ছিলেন। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদাযায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত গৃ‌হিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাস‌রি সম্পৃক্ত ছিলেন। ঐ স‌নেরই ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়।

প্রস্তাবগুলো পাঠ করে‌ছি‌লেন সেদিনের ছাত্রনেতার ও প্রতিশ্রু‌তিশীল যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। এরপর ভাষা আ‌ন্দোল‌নে তাঁর নেতৃত্ব ও ত‌্যাগ সর্বজন বি‌দিত।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মু‌জি‌বের নেতৃ‌ত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন ১০ দফা দাবির মধ্যে অন‌্যতম প্রধান দাবী ছিল বাংলা‌কে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মু‌জিব নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। এ‌টি ছিল তাঁর রাজ‌নৈ‌তিক জীব‌নের এক‌টি টা‌র্ণিং প‌য়েন্ট।

১৯৫২ সা‌লের ফেব্রুয়ারীর ভাষা আ‌ন্দোল‌নের সময় কারাগা‌রে থে‌কে ছাত্রলী‌গ ও ছাত্র সংগ্রাম প‌রিষ‌দের নেতা কর্মী‌দের চিরকুট পা‌ঠি‌য়ে দিক নি‌র্দেশনা দি‌তেন শেখ মু‌জিবর রহমান।

১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকীতে আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপ‌তির বক্ত‌ব্যে তি‌নি একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

এরপর ৫৪ সা‌লের যুক্তফ্রন্টের হ‌য়ে অংশ নি‌য়ে বিজয়ী হ‌ওয়া, মন্ত্রী প‌রিষ‌দের সদস‌্য নির্বা‌চিত হওয়া, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৬ সা‌লে ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থা‌নের মাধ‌্যমে শেখ মু‌জিবর রহমান হ‌য়ে ও‌ঠেন সারাবাংলার অ‌বিসংবা‌দিত নেতা বঙ্গবন্ধু। সারা‌দে‌শের সমস্ত রাজপ‌থ এ‌সে মি‌শে গি‌য়ে‌ছি‌ল তাঁর ৩২ ধানম‌ন্ডির বাসায়। তারপর সত্ত‌রে নির্বাচন হল, নিরঙ্কুশ বিজয় লা‌ভের পরও প‌শ্চিম পা‌কিস্তানীরা পূর্ববাংলার জনপ্রতি‌নি‌ধির হা‌তে ক্ষমতা হস্তান্তর ক‌রে‌নি। ১৯৭১ এর ১মার্চ অ‌ধি‌বেশন ডাকার কথা ব‌লে ইয়া‌হিয়া খান শেষ পর্যন্ত অ‌ধি‌বেশন‌টি স্থ‌গিত ক‌রে দেয়। বি‌ক্ষো‌ভে ফে‌টে প‌ড়ে সারা বাংলা। তারপর ৭ই মা‌র্চের ঐ‌তিহা‌সিক ভাষন, অসহ‌যোগ আ‌ন্দোলন, ২৫ মা‌র্চের কালোরাত্রিতে পা‌কিস্তানী‌দের বর্বর বাঙা‌লি নিধন যজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষনা, পা‌কিস্তানী মি‌লিটা‌রির হা‌তে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়া ও পা‌কিস্তা‌নের জেলে বন্দী থাকা, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান তু‌লে বীর বাঙা‌লির অস্ত্রহা‌তে পাক হানাদা‌রের বিরু‌দ্ধে মরনপন লড়াই‌য়ে অবতীর্ণ হওয়া এবং নয় মা‌সের রক্তক্ষয়ী যু‌দ্ধ শে‌ষে ডি‌সেম্ব‌রের ১৬ তা‌রি‌খে বিজয় লাভ।

২০২১ সা‌লে এ‌সে আমরা আজ আছি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী‌তে। বাংলা‌দে‌শের অভ্যুদ‌য়ের এ ই‌তিহাস আর বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস এক। বঙ্গবন্ধু ও বাংলা‌দেশ একটি সু‌তোয় গাঁথা এক‌টি অ‌বি‌চ্ছেদ‌্য মালা। বঙ্গবন্ধুর জ‌ন্মের মধ‌্য দি‌য়েই মূলত বাংলা‌দে‌শের জন্মের বীজ ব‌পিত হ‌য়ে‌ছিল, ৫২’র ভাষা আ‌ন্দোল‌নের মধ‌্য দি‌য়ে সে বীজ অঙ্কু‌রিত হয়। আর অঙ্কু‌রিত সে চারা গাছ‌টি‌তে প‌রিচর্যার মধ‌্য দি‌য়ে মহীরু‌হে প‌রিনত ক‌রে‌ছি‌লেন স্বয়ং মু‌জিব।

তাই জা‌তির জনক বঙ্গবন্ধুর জ‌ন্মের ক্ষন‌টির চে‌য়ে বড় আন‌ন্দের ক্ষন বাঙা‌লি জাতির আর নেই। অসীম আন‌ন্দের এই দিন‌টি‌কে জাতীয় শিশু দিবস হি‌সে‌বে পাল‌নের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯৬ সা‌লে গ‌ঠিত বঙ্গবন্ধু কন‌্যা জন‌নেত্রী শেখ হা‌সিনার সরকার। হিমালয়সম ব‌্যক্তি‌ত্বের অ‌ধিকারী বঙ্গবন্ধুর মা‌ঝে একজন সহজ সরল শিশুর বসবাস সবসময়ই ছিল। বাংলা মা‌য়ের প্রতি ভালবাসা, বাংলার গরীব দুখী মানু‌ষের পতি মমত্ব বোধের ব‌হিঃপ্রকা‌শে ও আ‌বে‌গে শিশুসুলভ সারল‌্যতা বঙ্গবন্ধুর চো‌খে মু‌খে ফু‌টে ওঠত। তি‌নি যখন শিশু‌দের কা‌ছে যে‌তেন, তখন নিজেই শিশু হ‌য়ে যে‌তেন। সহ‌জেই মি‌শে যে‌তেন শিশু‌দের মা‌ঝে। শিশু‌দের মাঝেই তি‌নি দেখ‌তেন স্ব‌প্নের সোনার বাংলা গঠ‌নের সেনানী। শিশুদের প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু শিশুদেরই কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন ‘জাতীয় শিশু আইন’ জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।

গণমানু‌ষের কল‌্যান ও শোষনমু‌ক্তির জন‌্য যার জন্ম নিজের জন্মদিন বা মৃত্যু নিয়ে ভাববার সময় তাঁর ছিল না।

জনগণই ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল তাঁর ৫২তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে জনতা ও সাংবা‌দিক‌দের সেদিন তিনি বলেছিলেন-তাঁর জীবনটাই জনগণের জন্য। তাই তাঁর জীবন-মৃত্যু জনগণের জন্যই উৎসর্গীকৃত। জনগণের মুক্তিই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।

বঙ্গবন্ধু কন‌্যা জন‌নেত্রী শেখ হা‌সিনা বাংলা‌দেশ‌কে জা‌তির পিতার স্ব‌প্নের ক্ষুধা ও দা‌রিদ্রতামুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার কা‌জে দেশ‌কে নেতৃত্ব দি‌চ্ছেন। আজ‌কের শিশুদের ম‌ধ্যেই র‌য়ে‌ছে আগামীর বাংলা‌দেশের নেতৃত্ব। প্রতি‌টি শিশুর নিরাপদ ভ‌বিষ‌্যৎ গঠন ও  ক্ষুধামুক্ত, দা‌রিদ্রতামুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠ‌নে নিরলস কাজ করার অঙ্গীকা‌রে পা‌লিত হোক বঙ্গবন্ধুর জন্ম‌দিন ও জাতীয় শিশু দিব‌স। সকল‌‌কে ধন‌্যবাদ।

আলোকিত প্রতিদিন/ ১৬ মার্চ-২১/ দ ম দ 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here