বঙ্গবন্ধু: অবদান ও দর্শন

0
2256

বিশেষ প্রতিনিধি:

প্রাককথন:

মুজিব ধ্বনি মধুর লাগে
দোলা লাগে এই মনে,
প্রতি দিবস মুজিব দিবস
ফুল ফুটে রয় ঐ বনে।

কোটি বছর মুজিব ধ্বনি
বয়ে যাবে ওই স্রোতে,
পাহাড় বুকে পাখির ডাকে
মুজিব ধ্বনি ঐ পথে।

মেঘে মেঘে মুজিব ধ্বনি
মুজিব ধ্বনি বাতাসে,
মুজিব ধ্বনি বাঙাল হৃদে
মুজিব ধ্বনি আকাশে।

মুজিব ধ্বনি ঘাটে মাঠে
মুজিব ধ্বনি বিদেশে,
মুজিব ধ্বনি শান্তির ধ্বনি
ঐ শুভ্র পাখির বেশে। (দ্বীন মোহাম্মাদ দুখু , ছড়াগ্রন্থ-সবুজ দ্বীপে রাঙা সূর্যের হাসি)

কিংবদন্তি, অকুতোভয় মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্তাকারে শেখ মুজিব বা মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাঙালির স্বাধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের ‘জাতির জনক’ বা ‘জাতির পিতা’ বলা হয়। তিনি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং শেখ সাহেব হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। তার উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’। তাকে এ নামে ভূষিত করেন বর্তমান আওয়ামী লীগ লিডার তোফায়েল আহমেদ। রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্বের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী এবং এদেশের প্রধানমন্ত্রী।

জন্ম: শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। লুৎফর- সায়েরা দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।

বংশ পরিচয়: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ জাতির ইতিহাসে অবিসংবাদিত মহানায়কের রয়েছে সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তার মাঝে আশৈশব ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটে। সমৃদ্ধ বংশ পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে। ইসলাম ধর্মেও বংশ পরিচয়ের মূল্যায়নে শিক্ষণীয় নির্দেশনা দেয়া আছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। মূলত ইসলাম বংশ পরিচয়ের আভিজাত্যকে গৌণ রেখে যোগ্যতা, বিশ্বাস ও ন্যায়নীতি-নিষ্ঠাকে ব্যক্তির মর্যাদার মানদণ্ড নির্ধারণ করে। এ সার্বজনীন ও মানবিক বিধান মেনে বলা যায়-ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় ও বংশীয় ঐতিহ্য অনেক সময় ব্যক্তির রুচিবোধ, স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক বা সম্পূরক ভূমিকা পালন করে। ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ব্যক্তি ঐতিহ্যগতভাবেই সাধারণত উন্নত মানসিকতা ও সমৃদ্ধ রুচিবোধের পরিচয় বহন করেন। মুজিবুর রহমান সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারক। তিনি ‘শেখ’ বংশীয় উত্তরাধিকার বহন করেন। ‘শেখ’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে, যার অর্থ শক্তিশালী, বলবান, বিপুল ক্ষমতাধরসম্পন্ন। এটি সম্মানসূচক আরবি অভিধা বা পদবী হিসেবেও পরিচিত। বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাবান শাসকদের উপাধি হিসেবেও শেখ-এর ব্যবহার রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও মানুষের নামের পূর্বে এটি ব্যবহৃত হয়। ল্যাটিন শব্দ ‘সেনেক্স’-এর বাংলা ‘বয়োবৃদ্ধ বা সম্মানিত’। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘শেখ’। তবে বর্তমানে এ পদবীতে পরিচিত ও সংশ্লিষ্টদের নেপথ্যে রয়েছে অনবদ্য তাৎপর্য। ইসলামের মহান নবী, মানবতার পরম বন্ধু, মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.) ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অনেককে সরাসরি মুসলিম করেন। ইতিহাসে তারা ‘শেখ’ অভিধায় ভূষিত। আমাদের এ প্রাচীন বঙ্গীয় জনপদে অসংখ্য ব্যক্তি ইসলামের শাশ্বত বাণী নিয়ে আসেন। তাদের অধিকাংশই আরব ও পারস্য থেকে কালের নানা সন্ধিক্ষণে এ ভূখণ্ডে আগমন করেন। তন্মধ্যে অনেকে ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবী। পরবর্তী কালে আরো আসেন সুফি, দরবেশ, গাউস, কুতুব, অলি ও বুজুর্গ। একদা মহামতি শেখ আউয়াল নামে এমন দরবেশের আগমন ঘটে এ বঙ্গে। আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু তারই বংশের সৌভাগ্যবান অধস্তন বংশধর। তাকে খোকা বলে ডাকতেন বাবা লুৎফর ও মা সায়েরা। তাদের ধারণকৃত ভিডিও দলিলের বরাত দিয়ে বলা যায়, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আজীবন অকুতোভয়, সৎ সাহসী, আপোষহীন সচ্চরিত্র, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দৃঢ়চেতা, স্বাধীনতাপ্রিয়, নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন, দরিদ্রের প্রতি দয়ালু, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ সম্পন্ন এবং বাবা-মায়ের কথা পালনে অন্যরকম বাধ্য ছিলেন বলে উল্লিখিত দলিলে পাওয়া যায়। শেখ আউয়াল ব্যাবিলনীয় সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে বিশ্বখ্যাত অলি হযরত বায়েজিদ বোস্তামির (রাহ.) সফর সঙ্গী হয়ে বঙ্গে আগমন করেন। ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত ছিল তাদের। এ মহান অলি সমুদ্রপথে জাহাজে করে আসেন। প্রথমে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে আস্তানা গাড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ আউয়াল দরবেশেরই সপ্তম অধস্তন বংশধর ছিলেন। তার বংশীয় ঊর্ধ্বতনদের খ্যাতনামা আরেক ব্যক্তি হলেন শেখ বোরহান উদ্দিন। তিনি আউয়ালের ছেলে শেখ জহির উদ্দিনের দৌহিত্র ছিলেন। বোরহান উদ্দিনের বাবা ছিলেন শেখ জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি। বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প গ্রন্থের বরাত দিয়ে বলা যায়, অলিকুল শিরোমণি বায়েজিদ বোস্তামির (র.) নির্দেশে মেঘনা পাড়ে গমন করেন শেখ আউয়াল। এতদঞ্চলের অধিবাসীদের মাঝে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেন তিনি। পরে এ দরবেশ চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও এলাকায়। সেই সুবাদে শেখ আউয়ালের সন্তান শেখ জহির উদ্দিনও এ অঞ্চলেই বসবাস করেন। পরে জহির উদ্দিনের ছেলে তেকড়ি শেখ খুলনার দিকে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা। একসময় তেকড়ির ছেলে শেখ বোরহান উদ্দিন জনৈক বন্ধুর কাছে মধুমতি ও ঘাঘোর নদীদ্বয়ের মাঝখানে গড়ে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামের কথা জানতে পারেন। পরে বন্ধুকে নিয়ে রূপসা নদী অতিক্রম করে সেখানে চলে আসেন। একপর্যায়ে কাজি পরিবারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বাকিজীবন এখানেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। আর এভাবেই বিখ্যাত শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন হয় ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে। বোরহান উদ্দিনের ছেলে শেখ আকরাম হলেন বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের দাদা। আর শেখ লুৎফর রহমান হলেন শেখ আব্দুল হামিদের সন্তান। কালক্রমে উত্থান-পতন ঘটেছে শেখ পরিবারের। নাম-যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ, বিত্ত-বৈভব হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তার সুমহান ঐতিহ্য ও পরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাস কখনই বিস্মৃত হয়নি। বরং সময়ের বিবর্তনে সেই পরিবার সুকীর্তির শীর্ষে উপনীত হয়েছে। এমন আলোর বিচ্ছিরণ ঘটিয়েছে যা আর কখনই ম্রিয়মান হওয়ার নয়।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন :

প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বঙ্গবন্ধু লেখাপড়া করেন টুঙ্গিপাড়া গিমাডাঙ্গা এমই স্কুল, গোপালগঞ্জ সীতানাথ একাডেমি, মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তাঁর স্কুল জীবন আরম্ভ করেন। ৯ বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই বছরে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় :

১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ তরুণ ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে বিশ্বদ্যিালয় থেকে বহিস্কার ও জরিমানা করা হয়। বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫২ সালের শেষ পর্যন্ত বন্দিজীবন কাটান। বহিস্কারের শর্ত ছিল ১৫ টাকা জরিমানা দিয়ে অভিভাবক এসে মুচলেকা দিলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাদে বাকি চারজন শর্ত মেনে ছাত্রত্ব ফিরে পান। পরাজয় যাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি, সেই মানুষটি জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পাবেন? তা কি হয়! মাথা উঁচু করেই ক্যাম্পাস ছেড়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ছাত্রত্ব ফিরে পেতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো দেনদরবারও করেননি তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল দুর্বলতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার কথা ছিল। বহিষ্কৃত ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবর্ধিত হওয়ার কথা ছিল। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ ঘোষণার সিদ্ধান্তও ছিল। ক্যাম্পাসের মঞ্চও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ঘাতকেরা তাঁকে ক্যম্পাসের রঙিন মঞ্চে ওঠার আর সুযোগ দেয়নি। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে সপরিবারে নিহত হওয়ায় তাঁর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি।তবে ২০১০ সালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল ও বহিস্কার আদেশ বাতিল করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

রাজনৈতিক জীবন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই দেশ ও দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। ছাত্রজীবনেই তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সুভাষচন্দ্র বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। ওই বছরই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়। প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে ছাত্রসমাজ। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। তৎকালীন যেসব ছাত্র ও তরুণের প্রচেষ্টায় এ পরিষদ গঠিত হয় তাদের অন্যতম ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হলে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অধিকাংশ ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। দীর্ঘদিন বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেন বঙ্গবন্ধু। ফলে তাকে বারবার জেল খাটতে হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতি চলছিল তখন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে কারাবন্দি তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে করা হয় দলের যুগ্ম সম্পাদক। মুক্তি পেয়ে তিনি দল গঠনের কাজে ব্রতী হন। ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অসামান্য। এটি শাসকগোষ্ঠীও বুঝতে পারে। তাই ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এবার তাকে দীর্ঘ সময় আটক রাখা হয়। জেলে থাকাকালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি অনশন পালন করেন। দুই বছরেরও বেশি সময় কারাগারে থাকার পরে তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে বের হয়ে আবার তিনি সারাদেশে দলকে সংগঠিত করার কাজে মনোযোগ দেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ করলে শেখ মুজিব মন্ত্রী হন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। তখন তাকে পুনরায় কিছুদিনের জন্য জেলে যেতে হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৬ সালে তিনি পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী হন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে সময় দেবেন বলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। ১৯৫৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালির সব ধরনের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করতে পাকিস্তানি শাসকরা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে মামলা করে, যা ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এ মামলায় পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দকে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া। এভাবে নেতৃত্বশূন্য করে আন্দোলন থামিয়ে দেয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন টিকে থাকতে পারেনি। ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান এ মামলা প্রত্যাহার করে সব রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হন। কারামুক্ত শেখ মুজিবকে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বিশাল গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের শতকরা ৮০ ভাগ আসনে বিজয়ী হয়। কিন্তু তাকে সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ: ১৯৭১ সালের ২ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৭ই মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় দশ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি বাঙালির বিজয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে আহ্বান করেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ এক অভিন্ন ইতিহাস। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ। দীর্ঘ নয়মাসের যুদ্ধ শেষে ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালির বিজয়। জীবনের বিনিময়ে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে ফিরে আসেন। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় দেশগড়ার নতুন সংগ্রাম।

শেখ মুজিবের শাসনামল: বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। বাংলার মহান ও অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার (অস্থায়ী) গঠিত হয় এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধানের আদেশ জারি করেন। তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীনতার ১০ মাসের মাথায় সংবিধান দিতে সমর্থ হন। তিনিই প্রথম বাংলায় জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে শুধু বাঙালি জাতিকে নয়, বাংলা ভাষার মর্যাদাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। তিনি ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-এ-খুদাকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৪০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে।

বঙ্গবন্ধুর দর্শন : বাঙালির স্বাধীনতা ও সংবিধান:

মুজিব মানেই মুক্তি
মুজিব মানেই স্বাধীনতা
মুজিব মানেই আমার ৭২ এর সংবিধান।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তুমি
তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
পিতা তুমি ঘুমাও
জেগে আছি আমরা।’

অথবা বলা যায়-
‘জন্মেছিলে তুমি, তাই জন্মেছে এই দেশ।
মুজিব তোমার আরেকটি নাম স্বাধীন বাংলাদেশ।’

বঙ্গবন্ধু আজীবন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বারবার কারাবরণ করেছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, মামলা-হামলা সবকিছু উপেক্ষা করে নিজ আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনও আপস করেননি। কখনও মাথা নত করেননি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বাঙালির অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।’ বঙ্গবন্ধু কখনও ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি। কোনো লোভ-লালসা, পদের মোহ তাকে আকৃষ্ট করেনি। তার প্রমাণ আমরা পাই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। দৃপ্ত উচ্চারণে তিনি বলেছেন- ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’ ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তার এক অঙ্গুলি হেলনে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।’

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সংবিধান: বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন দেশ, লাল-সবুজ পতাকা ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরের দিন, ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু Provisional Constitution of Bangladesh Order, 1972 প্রণয়ন করেন। সেখানে গণপরিষদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু Constituent Assembly of Bangladesh Order, 1972 ঘোষণা করেন ও গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভোটে ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি ও পূর্ব পাকিস্তান প্রভিনশিয়াল অ্যাসেমব্লিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা গণপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের বিশেষ গুরুত্ব জাতির পিতা গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বলেন- ‘শাসনতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ- তার অর্থ হল- মাঝিবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও থাকবে।’ ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধান কার্যকর হয়। ওই দিন গণপরিষদে ভাষণে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের পূর্ণ বিবরণ পাই। বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যে মৌলিক বিষয়গুলো, যে দর্শন, যার ওপর ভিত্তি করে আমাদের সংবিধান রচনা করা হয়, সেই মূলনীতিসমূহ এই ভাষণে বিবৃত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের দীর্ঘ ২৩ বছরের ইতিহাস এই ভাষণে বিবৃত করেন, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রেক্ষাপট ও ভিত রচনা করে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনঃ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন নিপীড়িত, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে আজন্ম লড়াই-সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি জনগণের জন্য কল্যাণকর গণতন্ত্র চর্চা করে গেছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোনার বাংলা উপহার দেওয়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল দর্শন।
তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব-মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ড লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের এদেশীয় মৌলবাদী দলগুলো ইসলামের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখবার জন্য নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জনপদ ধ্বংসসহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানা থাকবে না। এভাবেই তারা ইসলামকে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসের সমার্থক শব্দে পরিণত করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন– রোজা রাখেন, তারা জামায়াতের গণহত্যা ও নারীনির্যাতনের ইসলামকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাকিস্তানের ৯০ হাজারেরও বেশি নৃশংস সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়েও জামায়াতিরা তাদের প্রাণপ্রিয় পাকিস্তান রক্ষা করতে পারে নি। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের নিকট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির আত্মসমর্পণের আগেই জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের– অনেকে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন, অন্যরা দেশের ভেতর আত্মগোপন করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ী জামায়াতিদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছিল। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তার জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধি– দুজনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন– ‘আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি।… শেখ সাহেব তার দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন – তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।’এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কীসের এত মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধিও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য…।’ সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের এই চার মূলনীতিকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, যা অর্জিত হয়েছে তিরিশ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে। এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।৪ নভেম্বর (১৯৭২) গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু এক অনন্যসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন, যেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা পশ্চিমের সংজ্ঞার সঙ্গে মেলে না। গণতন্ত্র সম্পর্কে এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন– ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা আছে এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যে সব দেশে চলেছে, দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্রের ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো– আমার দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সাথে অন্যের পার্থক্য আছে।’সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ৪ নভেম্বরের ভাষণে বলেছেন– ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্র গাছের ফল নয়– অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছা যায়। এবং সেজন্য পহেলা স্টেপ- যাকে প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি – শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কী আবহাওয়া, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে, এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। …’অনেকে বলেন, ১৯৭২-এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র যুক্ত করেছেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের প্রভাবে। কমিউনিস্ট না হয়েও যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করা যায় এটি বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের ভাষণে স্পষ্ট। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন– ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।’বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে প্রদত্ত ৪ নভেম্বরের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেছেন¬– ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। … মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিষ। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।’ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের শুধু সামরিক পরাজয়ই হয়নি, তাদের ধর্মের নামে রাজনীতি, হানাহানি, হত্যা ও ধ্বংসের দর্শনেরও পরাজয় ঘটেছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল সকল ধর্মীয় বিভাজনের উর্ধ্বে উঠে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনায় জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালিত্বের এই চেতনার প্রধান রূপকার, যার ভিত নির্মাণ করেছিল হাজার বছরের বাঙালি সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক, মানবিকতার ঐতিহ্য। বাঙালির এই ঐক্য পাকিস্তান ভেঙেছে, ধর্মের নামে রাজনীতির অমানবিক ধারণা ভেঙেছে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসররা বাঙালির এই ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য প্রথমে বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগীদের হত্যা করে পাকিস্তানের সেবকদের ক্ষমতায় বসিয়েছে, ’৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে বাঙালিত্বের চেতনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ধর্মকে, যা তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা থেকেই করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি ও সন্ত্রাসের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির জনক জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য জাতিকে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি-বাংলাদেশি, ধর্মনিরপেক্ষতা-ইসলাম (রাজনৈতিক), সমরতন্ত্র-গণতন্ত্র প্রভৃতি দ্বন্দ্বে বিভক্ত করেছেন। ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ানস’¬– এই ঘোষণা দিয়ে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বলে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক আদর্শকে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিনাশ ঘটানোর পাশাপাশি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির এই বিভাজন ঘটানো হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে অধিকাংশ সময় এ দেশটি শাসন করেছে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে পাকিস্তানিকরণ/মৌলবাদীকরণ/সাম্প্রদায়িকীকরণ আরম্ভ হয়েছে– বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি প্রায় এক যুগ একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা ’৭১-এর চেতনায় ফিরে যেতে পারিনি, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে দেশ ও সমাজ গড়তে পারিনি। ’৭২-এর সংবিধানে জেনারেল জিয়া কর্তৃক বাতিলকৃত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হলেও এখনও সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক থেকে সংবিধানকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যায়নি। সেখানেও বাধা হচ্ছে সমাজে বিভাজনের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির প্রাবল্য।’৭২-এর সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে ধর্মের নামে এত নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের ৪৯ বছর এবং পাকিস্তানের ৭৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সমগোত্রীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলি, যা তারা করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে। ’৭২-এর সংবিধান এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শ মান্য করতে হলে ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত রাখতে হবে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও হত্যা বন্ধের পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য। বাংলাদেশ যদি একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, যদি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চায়, যদি যুদ্ধ-জিহাদ-সন্ত্রাস-গণহত্যা বিধ্বস্ত বিশ্বে মানবকল্যাণ ও শান্তির আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চায় তাহলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও বাস্তবতাঃ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিংশ শতাব্দীতে এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের নাম। আমরা যারা তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছি, তাঁর বক্তব্য ও নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়েছি, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের মধ্যে সেই অমর ও অমোঘ প্রভাব অটুট রয়েছে। সেই ষাটের দশক থেকেই আমার মতো অনেককে তিনি স্বাধিকারের পথ ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমরা তখনই নিশ্চিত ছিলাম, হাজার বছরের বঞ্চিত বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা এসে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও কৃষি দর্শনঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য সারা জীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের জন্য শুরু করেন সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, এ দেশের অবহেলিত দরিদ্র কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।বঙ্গবন্ধু প্রথমে কৃষকদের অধিকারের কথা সাংবিধানিক রূপ দিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো মেহনতি মানুষ-কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি এবং জনগণের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দেয়া। সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ধাপে ধাপে দূর করার উদ্দেশ্যে- কৃষি বিপ্লবের বিকাশ ঘটাতে হবে, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলের আমূল পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে ”এছাড়া সংবিধানের ১৮ক নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,”রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্যে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।”বঙ্গবন্ধু সঠিক ও সার্বিক পরিকল্পনাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি সেচ সুবিধায় বেশি বিনিয়োগ ধরা হয়েছিলো। ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। খাদ্য ঘাটতি সংকুলানে বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর ২ বছর খাদ্যে ভর্তুকি প্রদান করেছে।খাদ্যে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের সাথে কৃষিকে সম্পৃক্ত করলেন। এর জন্যে দরকার পড়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও সেচ ব্যবস্থার। এইসব উপাদানকে সহজলভ্য করার জন্যে তিনি সরকারি আদলে গড়ে তুললেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালে ১০নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ধান ছাড়া অন্যান্য ফসলের গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সোনালী আঁশের সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, হর্টিকালচার বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ গবেষণা সমন্বয়ের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান (রাষ্ট্রীয়করণ) আদেশের ১০ নং অনুচ্ছেদের আওতায় (রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ নং-২৭) বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল করপোরেশন (বিটিএমসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ১লা জুলাই থেকে জাতীয়করণকৃত ৭৪ টি মিল নিয়ে বিটিএমসি আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করে। স্বাধীনতার পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলা দিয়ে মিলগুলো পরিচালিত হতো। স্বাধীনতার পর কাচা তুলার অভাবে বস্ত্র মিলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।তুলার ঘাটতি পূরণের জন্য, দেশে তুলাচাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১4 ডিসেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করেন তুলা উন্নয়ন বোর্ড। তিনি বোর্ড গঠন করার পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ এলাকায় ৭৯৬ একর জমি তুলা উৎপাদনের জন্য ৩২৫টি পরিবারকে দিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবারপ্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনেন এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-১৩৫ এর মাধ্যমে নদী কিংবা সাগরগর্ভে জেগে ওঠা চরের জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টন করেন। গরিব কৃষকদের রক্ষাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। তিনি হাট বাজারে ইজারা প্রথার বিলোপ করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় কৃষি ব্যাংক, যাতে কৃষক সহজেই কৃষি ঋণ নিতে পারে; গঠন করা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কার তহবিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান করেন। এ জন্য প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারীকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে কৃষি খাতের উন্নয়নের সঙ্গে । দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪৩ শতাংশের উৎস আমাদের কৃষি খাত। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি খাতে উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উত্পাদন হয় এক কোটি ১০ লাখ টন। এর মধ্যে ধান উত্পাদন হয় ৯৩ লাখ টন। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্যে ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। ৪৮ বছরের ব্যবধানে আজ দেশের মানুষ বেড়ে দ্বিগুণের ও বেশী হয়েছে। আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। বর্তমানে ৩.৩৮ কোটি টন ধানসহ খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দানা জাতীয় খাদ্যশস্য, আলু ও শাক-সবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ফল উত্পাদনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ ও গবাদি পশুর বাণিজ্যিক উত্পাদনের ক্ষেত্রেও অনেক দূর এগিয়েছে। উৎপাদন খরচ কমানোর জন্যে বীজ, সার, সেচসহ কৃষি উপকরণে ভর্তুকি সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য গুদামের ধারণক্ষমতা বাড়ানো এবং কৃষি গবেষণা, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক প্রকৌশল ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা খরা, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, খরা, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধান, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য শস্যে বিশ্বের গড় উৎপাদন অতিক্রম করে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় ৩ টন, আর বাংলাদেশে তা প্রায় ৪ দশমিক ১৫ টন। দেশে এখন খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৪কোটি মেট্রিক টন। কৃষিবিদদের মর্যাদা নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে শেখ হাসিনা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে জমি বরাদ্দসহ দিক নির্দেশনা দেন কৃষিবিদ ও কৃষকের মর্যাদার প্রতীক পেশাজীবী সংগঠনের প্রাণকেন্দ্র কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন বাংলাদেশ-এর নান্দনিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায়। কৃষক-কৃষিবিদ-সহায়ক নীতি ও প্রণোদনায় ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৪র্থ, সবজি উৎপাদনে ৩য়; আলু উৎপাদনে ৮ম; মৎস্য উৎপাদনে ৪র্থ। কৃষিতে তাক লাগানো সাফল্যের নেপথ্যের প্রেরণা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক, ইতিহাসের রাখাল রাজা, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর গবেষণা ভাবনা ও দর্শন :
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে সব সময় ভেবেছেন। এ ভাবনার মধ্যে মৌলিকত্ব ছিল, নতুন চিন্তাশীলতা ছিল। দেশে মেধাচর্চাকে এগিয়ে নেয়ার ব্রত ছিল। মানুষকে জীবনসম্পৃক্ত স্বশিক্ষায় প্রভাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত করার কৌশল ছিল।কেবল ভাবনার মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার দর্শনতত্ত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং সেখানে আধুনিক ও অগ্রসরমান চিন্তাধারার প্রতিফলন ছিল। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ও গবেষণার ভাবনায় শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে মানবিক ও নৈতিক সম্পর্কের সমীকরণগত মনস্তত্ত্বের প্রভাব ছিল। শিক্ষার সর্বজনীনতার মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিকে ব্যবহার করে ভেতরের চিন্তাবোধ ও কল্পনাশক্তিকে বের করে আনার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে দেশের দায়বদ্ধতার যোগসূত্র তৈরি করে দেশপ্রেমের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে পেরেছেন। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে শিক্ষার সঙ্গে গবেষণার বন্ধন সৃষ্টি করা দরকার বলে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন। এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সে দেশে পাঠিয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও গবেষণার অভিজ্ঞতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন, যার সুফল আজও আমাদের দেশ পাচ্ছে।পরমাণু গবেষণার মাধ্যমে দেশ যাতে উপকৃত হয়, সেটি বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে ভেবেছেন। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে উন্নত গবেষণার ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি সোনার বাংলা গড়ার বিশ্বাসকে ধারণ করেছেন। গবেষণায় গর্ব করার মতো অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। কারণ তিনি জানতেন, আমাদের মেধাবী তরুণদের গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে পারলে যে কোনো অসাধ্যকে জয় করা সম্ভব।আমাদের মেধা ও সম্পদ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পরমাণু গবেষণা থেকে পরমাণু চুল্লি নির্মাণ করেছে, তা বঙ্গবন্ধু ভুলে যাননি; কিন্তু গবেষণার অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি জান্তারা আমাদের দেশকে বঞ্চিত করেছে। এ বঞ্চনা, শোষণ ও অবহেলার কথা বঙ্গবন্ধু মনে রেখেছেন।এ প্রেক্ষাপটে তিনি আত্মশক্তি ও স্বনির্ভরতা অর্জনের মানসিক শক্তিকে ধারণ করে বিজ্ঞান গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। তবে পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করার আগে বঙ্গবন্ধু গবেষণামনস্ক দক্ষ জনগোষ্ঠী গঠনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মেধাবী ও গবেষণামনস্ক কয়েকজন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীকে ভারতের ভাবা পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার উদ্দেশে পাঠান। পরবর্তী সময়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করেন।সেসময় আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এম ইন্নাস আলী। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার উৎসাহ ও আগ্রহে এবং বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাভারে ২৬৫ একর জমি পরমাণু গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেখানে দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর গবেষণাসমৃদ্ধ এ স্বপ্ন ও বিশ্বাসের মূল্যবোধ ও দর্শনকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে চলেছে। দেশ গড়তে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার বিকল্প যে নেই, তা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন। গবেষণা যে একটি দেশের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে, তা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ভাবনায় প্রভাব ফেলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে মানবিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণার যে নিবিড় মেলবন্ধন দরকার, তা বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির উন্নয়নে গবেষণার বিকল্প যে আর কিছু হতে পারে না, তা বঙ্গবন্ধুর গবেষণামনস্ক পরিকল্পনা ও চিন্তাধারায় প্রতিফলন ঘটেছে। কৃষির প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতটা টান ছিল, তা একটি ঘটনা থেকেই ধারণা করা যায়। ১৯৭৪ সালে ফার্মগেটের খামারবাড়িতে পাঁচতারকা হোটেল তৈরির সব ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও খামারের এ জমিতে হোটেল নির্মাণের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছিল। কাজী এম বদরুদ্দোজা বিষয়টি জানতে পেয়ে ছুটে গেলেন প্রাণের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। তিনি অনেকটা অভিমান নিয়ে বললেন, কৃষি গবেষণার জমিতে হোটেল বানানোটা তিনি মানতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধু এর কারণ জানতে চাইলেন। কাজী বদরুদ্দোজা বললেন, ‘এটা হলে কৃষির মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এ জমিতে হতে হবে কৃষি গবেষণার জন্য প্রশাসনিক সমন্বয়ের প্রধান কার্যালয়।’ বঙ্গবন্ধু কথাটা শুনে আনন্দিত হলেন। এমন একটা আবেদনের অপেক্ষায় তিনি যেন বসেছিলেন। কৃষির গবেষণা বলে কথা। কাজী বদরুদ্দোজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই ঠিক কী চাস, আমার কাছে লিখে নিয়ে আয়।’ বঙ্গবন্ধুর সহকারীর কক্ষে গিয়ে কাজী বদরুদ্দোজা ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’-এর গঠন কাঠামো ও কার্যপরিধি এবং এর প্রস্তাব লিখে নিয়ে এলেন।বঙ্গবন্ধু প্রসন্নচিত্তে তাতেই স্বাক্ষর করে অনুমোদন দিয়ে দিলেন। মুহূর্ত্বেই জন্ম নিল বাংলাদেশের কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’। গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না; বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বোঝায়।’এর মাধ্যমে তিনি গবেষকদের কৃষির উন্নয়নে সুষম ও সমন্বিত খাদ্য গবেষণার নতুন ধারণা দ্বারা প্রভাবিত করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে গবেষণার উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় নিজেদের আত্মনিয়োগে প্রেরণা জুগিয়েছেন। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। এগুলো তৈরির পেছনে বঙ্গবন্ধুর গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের দর্শন ও চিন্তা কাজ করেছে। দেশে ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং ধানের ওপর নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা তখন থেকেই শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর গবেষণার ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গবেষকরা ১৯৭৫ সালে বিনাশাইল, ইরাটম ২৪ এবং ইরাটম ৩৮সহ নতুন নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবন করেন।এর আগে ১৯৭৪ সালে গমের উচ্চফলনশীল জাতের নতুন নতুন গম উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল হন। এর মধ্যে সোনালিকা জাতটি এদেশে গম উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তুলার ৩টি উন্নতমানের জাত বঙ্গবন্ধুর সময়েই উদ্ভাবিত হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন নতুন জাতের খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা আজও গবেষকদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে।বঙ্গবন্ধু পাটের সম্ভাবনা নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন, তা বিশ্বের আর কেউ সেসময়ে ভাবতে পারেনি। এ ভাবনাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি থেকে উত্থিত গবেষণা ভাবনা। সে ভাবনা যে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, তা এখন আমরা বুঝতে পারছি। বর্তমানে পাটের ফাইবার বা আঁশ নিয়ে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। পাটের ফাইবার ব্যবহার করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালসহ নানা গবেষণালব্ধ উপাদান পৃথিবীর প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধু দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি রফতানিমুখী শিল্পধারণা সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর গবেষণা ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেসময়ে ড. কুদরাত-ই-খুদাসহ অন্য গবেষকরা দেশীয় উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে নতুন ধারার গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এ কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু গবেষণামনস্ক ও উন্নত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত শিক্ষানীতি প্রণয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় বিশ্বাস করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু শিক্ষাদানের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন না; বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কর্মমুখী শিক্ষার উন্নয়নে গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন না; বরং বহুমাত্রিক নতুন ধারণা উদ্ভাবনের মাধ্যমে সর্বজনীন দর্শন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল শক্তিও ছিলেন। তিনি নিজে বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞান ও গবেষণার নতুন ধারণা সৃষ্টিতে যেমন নিজের ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন, তেমনি তার গবেষণার ভাবনা দ্বারা মানুষকে তাড়িত করে নতুন নতুন গবেষক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর এ গবেষণা দর্শনকে ধারণ করে যদি আমরা নিজেদের গড়ে তুলতে পারি, তবেই দেশ এগিয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধুর দর্শন- সমবায় উন্নয়নঃ
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জনে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। শতাব্দী প্রাচীন এ আন্দোলন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সমবায়ের চেতনাকে প্রবল ও অর্থবহ করে তুলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্মলালিত স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ। তিনি দরিদ্র-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে গণমুখী সমবায় আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

অর্থনীতি পুননির্মাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দর্শনঃ

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়নের যে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ, তার বেশকিছু ধাপ এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ জনপ্রতি আয়ের বিবেচনায় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে মনে রাখা দরকার, আজকের অর্জনের বীজ রোপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সময়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে তত্কালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে ওঠে অর্থনীতিকে দাঁড় করানো এবং এর পুনর্গঠন। মহান স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তোলার নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর পরই এক কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। সে পরিস্থিতিতে তার গৃহীত অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো আলোচনা করতে গেলে এর পরিপ্রেক্ষিত অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ১৯৭১ সালের পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতি। বেশির ভাগ সড়ক, সেতু ও অবকাঠামো বিনষ্ট করা হয়েছিল। আবুল কাশেম লিখেছেন, ব্যাংকে টাকা নেই, ট্রেজারি খালি, টাকা-পয়সা সোনাদানা কিছুই নেই। সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে পাকিস্তানের লুটেরা বাহিনী। আত্মসমর্পণের আগে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট; পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, দোকানপাট। সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেললাইন সবই ধ্বংস। বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আহত হয়েছেন কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অগণিত মানুষ। ভারতে উদ্বাস্তু এক কোটি মানুষ ফিরে এসেছেন শূন্য হাতে পোড়ামাটির ভিটায়। দেশে বিপুল খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সমুদ্রবন্দরে যেসব জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, এগুলো অপসারণ না করলে বিদেশী জাহাজ তীরে ভিড়তে পারছে না। দেশের কলকারখানায় পাকিস্তান আমলে তৈরি পণ্য বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না। কাঁচামালও আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ সময় বিশ্ব পরিস্থিতিও চরম প্রতিকূল ছিল। সাইদুজ্জামানের বর্ণনানুসারে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৭২-৭৩ সালে বহির্বিশ্বের পরিস্থিতিও ছিল চরম প্রতিকূল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই মার্কিন প্রশাসন ‘স্মিথসোনিয়ান এগ্রিমেন্ট’ বাস্তবায়ন করে, অর্থাৎ স্বর্ণ থেকে ডলারকে পরিবর্তন করার যে সমীকরণ ছিল, তা রহিত করা হয় এবং ফলে পুরো বিশ্বে এবং উন্নত অর্থনীতিগুলোর অনেকগুলোয় আন্তর্জাতিকভাবে নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। এ সময়ে বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ছিল অস্থিতিশীল এবং আমদানি ব্যয়ও ছিল অত্যধিক। বিশ্ববাজারে শস্য ও সারের মূল্য তিন গুণে উন্নীত হয় এবং প্রায় সারা বিশ্বে নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। যুদ্ধের বছরে প্রায় কোনো ফসলই ফলেনি। আর স্বাধীনতার পরের বছরও পূর্ণাঙ্গ চাষাবাদ শুরু করা সম্ভব হয়নি। জমিতে পাকিস্তানি সেনাদের বসানো ভয়ংকর মাইনগুলো কৃষকদের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কৃষি খাতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী দুই বছর কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। শিল্প-কারখানা ছিল বিধ্বস্ত অথবা উৎপাদনের অযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আর্থিক এবং অবকাঠামো ধ্বংসের বিবেচনায় নিরূপণ করা সম্ভব নয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ জীবন হারিয়েছেন, পরিবার ও সামাজিক কাঠামো বিনষ্ট হয়েছে এবং দেশকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে। এ অবস্থায় দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নতুন মাত্রা যোগ করে। এমন এক অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন ভিত্তি রচনার কাজ শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের বাস্তবায়ন শুরু হয় তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রণীত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মাঝে। কেমন বাংলাদেশ চাই প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরনো সমাজ ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’ এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পরিস্থিতিগত নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। এ মহাপরিকল্পনা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে প্রোথিত ‘সমতা ও সামাজিক বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ লক্ষ্য অর্জনের সুসংহত দলিল এবং বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের পথে সুদৃঢ় পদক্ষেপ। মুক্তিযুদ্ধের মূল চার নীতির ভিত্তিতে এ সময় শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করা হয়। এ সময়ের উন্নয়নমুখী সিদ্ধান্তগুলোর যৌক্তিকতা নিরূপণে তত্কালীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতি পুনর্গঠন ও মৌলিক প্রয়োজনের দিকগুলোকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করাই ছিল সরকারের মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নকেও যথাযথভাবে গুরুত্ব না দেয়ার অবকাশ ছিল না। তত্কালীন সময়ের সম্পদের স্বল্পতা এবং আর্থিক সক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে কলকারখানা এবং বড় বড় অবকাঠামো সরকারীকরণ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ছিল। সময় ও বাস্তবতার বিবেচনায় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকারি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল বাজেটের ৮৮ শতাংশ এবং প্রায় ১২ শতাংশ বেসরকারি খাতে। পরিকল্পনায় কৃষির ওপর নির্ভরতা স্পষ্ট এবং শিল্প উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সরকার ও তত্কালীন পরিকল্পনা কমিশন খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য ও কৌশল নির্ধারণে নিয়োজিত হয়। তত্কালীন সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় স্বনির্ভরতা মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। পর্যালোচনা করলে সহজে বোঝা যায়, সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারি ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিলেও বেসরকারি খাতকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। কৃষি খাতের পাশাপাশি শিল্প খাতের উন্নতির লক্ষ্যে সারা দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্পোদ্যোগ ছড়িয়ে দিতে প্রয়াস নিয়েছিলেন। মেগা শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ছাড়া শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়, তা বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় প্রকাশ পেয়েছে। তার বড় শিল্পের জাতীয়করণের পাশাপাশি মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ প্রদান এক্ষেত্রে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কুটির শিল্প, পল্লীর শিল্প এবং ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়নে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন এবং বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। যদিও ওই পরিস্থিতিতে তত্কালীন সরকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছিল, তার পরও পরবর্তী দুই বছরে অর্থনীতির গতি সচল হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় বঙ্গবন্ধুর ‘জাতীয়করণের নীতি’ বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক আদর্শ এবং ‘পরিস্থিতিগত নেতৃত্ব’ বা ‘সিচুয়েশনাল লিডারশিপ’-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ ও সংগতিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শোষণবিরোধী ছিলেন। তিনি শ্রমিকশ্রেণী ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। অনুপার্জিত আয়বিরোধী ছিলেন এবং তিনি জনকল্যাণের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, গৃহ, কর্ম ও নিরাপত্তাকে বাজারের পণ্য নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ১৯৬৯-এর ১১ দফা এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে এসব কথা বারবার এসেছে। তবে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফার মাঝে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির রূপরেখা নিহিত ছিল। এর তিনটি দফা—তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দফা—সরাসরি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলমন্ত্র উপস্থাপন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের শুরু থেকে বিভিন্ন ধারায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন। সংবিধানের প্রস্তাবনায় শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক এক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, নাগরিকদের মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাপূর্ব এবং পরবর্তী বিভিন্ন পদক্ষেপ বলিষ্ঠভাবে ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশের জাতির জনক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির শোষণমুক্ত ব্যবস্থাকে ধারণ করেছেন এবং কল্যাণমুখী গণতন্ত্রের মাঝে এক শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। এমএম আকাশ বর্ণনা করেছেন, “তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন ছিল সোস্যাল ডেমোক্রেসি বা কল্যাণ ধনতন্ত্রের দর্শন। তাঁর এই দর্শন বাংলাদেশের সংবিধানের আদি অসংশোধিত রূপের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই ’৭২-এর সংবিধান কার্যকরী করা সম্ভব হলে তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন কার্যকরী হবে। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা চিরসবুজ আছে এবং থাকবে।” প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় প্রত্যয় ও তার অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে এবং দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের মাঝেই শোষণমুক্ত-সমতাবাদী সমাজ ও অর্থনীতির বীজ সুপ্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির প্রেক্ষাপটে সাজিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে। দারিদ্র্য বিমোচন ও সমতাকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষি ও শিল্প উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ নির্ধারণ করেছেন। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করেছেন বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যের নিরিখে। তার সুচিন্তিত পদক্ষেপ স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে শুরু করেছিল। সে পথ ধরে এরই মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর, সাফল্য পেয়েছে অনেক।

বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
নারী ও শিশু: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু সমাজসংস্কার, বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষায় তাঁর বিশাল ভূমিকা খুব একটা আলোচিত নয়। অথচ নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পথ দেখিয়েছিলেন। ছয় দফা আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়ার আগে আমেনা বেগমকে (১৯২৫-১৯৮৯) দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদে মনোনয়ন দেন বঙ্গবন্ধু। এই সময় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো প্রবীণ পুরুষ নেতা আপত্তি তুলেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ যেমন অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, তেমনি নরনারীর সমান অধিকারেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগেও নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার।” বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রামী রাজনীতিতে নিজের সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকেও জড়িয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী থাকার সময় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সংকটে বেগম মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু ছেলেদেরই নয়, নিজের দুই মেয়েকেও পিতার আদর্শে, সামাজিক-সাংস্কৃতি-রাজনৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী অধ্যক্ষ বদরুন্নেসা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অধ্যাপিকা নুরজাহান মোরশেদ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সরকারি চাকরি ও কর্মে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়াও সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট আনুপাতিক সংখ্যক পদ (১০ ভাগ কোটা) নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান অসমতায় নারীকে সহযোগিতার স্বীকৃতি দেয় সংবিধান যেখানে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অবদান রযেছে। জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য ৬৫ নম্বর ধারার মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণ আসনের নির্বাচনেও নারীদের প্রতি করায় কোনো বাধা রাখা হয়নি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে সমাজের দুস্থ মানুষের পাশাপাশি বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের কথা সংরক্ষিত করা হয়েছে। একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক এবং বালিকার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। রাষ্ট্র কর্তৃক পতিতাবৃত্তি বন্ধ করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ইতিহাস শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাঁদের দিয়েছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে এসে বীরাঙ্গনারা মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের বিশেষ স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির কলঙ্ক মোচনের আরেকটি ধাপ সম্পন্ন করেন নিজের স্বভাবজাত আন্তরিকতায়। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন বাংলাদেশ পুনর্বাসন বোর্ড। ঢাকার ধানমন্ডিতে যে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ছিল তা পরিচালনা করতেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তাঁদের জন্য আশ্রয় ও ভাতার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, নারীদের উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বৃত্তিপ্রথা চালুসহ নানাবিধ কাজ করার জন্য ঢাকার বেইলি রোডে চালু করা হয় সেক্রেটারিয়াল কোর্স, মোহাম্মদপুরে ব্যবস্থা করা হয় এবং সেলাই ও কারুশিল্প প্রশিক্ষণের, সাভারে খোলা হয় পোলট্রি ফার্ম।পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের ফলে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গর্ভধারণ করা মায়েদের অনেকে গর্ভপাতের আশ্রয় নেন। তারপরও ১৯৭২ জুড়ে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য ১৯৭২ সালেবঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩ -১৯৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। কিন্তু ঘাতকের হাতে অকালে জীবন দিতে হওয়ায় তাঁর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থমকে দাঁড়ায়। ক্রমশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী শাসকদের হাতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে বাংলাদেশের নারীর উন্নয়নের রূপরেখা। ফলে নারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হবে কি না, নারীর সামর্থ্য রাষ্ট্র কতটুকু কাজে লাগাবে বা আদৌ লাগাবে কি না, নারীর অবস্থান পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটুকু নির্ধারিত করবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তা নিয়ে এক বিভ্রান্ত সমাজ গড়ে ওঠে ক্রমশ।

শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ছিল অপরিসীম। শিশু ও কিশোরীদের গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনকে ঢেলে সাজান এবং পুনর্গঠিত করেন। শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন ‘জাতীয় শিশু আইন’ (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারির মাধ্যমে শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করেন।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের ‘জাতীয় শিশু দিবস’ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষের আয়োজনে। জাতি জাতির পিতার প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

মুজিব বর্ষে নারী-পুরুষ সমতাকে সুসংহত করার জন্য এবং দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী শিশুদের গড়ে তুলতে সবাইকে একযোগে কাজ করার মানসিকতা ধারণ করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারী ও শিশুর জন্য যে অবদান রেখেছিলেন, তাকে নির্দেশনা হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আদর্শ এক সমাজ গঠনের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জীবন দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ আরো অনেক ভাষা সংগ্রামী। পরবর্তীকালে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিও পেয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ অনন্য মর্যাদা। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০০০ সাল থেকে দিনটিকে বিশ্বের সব দেশেই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের সংগ্রাম ও অবদানের কথা স্মরণ করে বিশ্ববাসী। এর কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার ভাষা থাকলেও মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যতটা সংগ্রাম করেছে ততটা সংগ্রাম আর দেখা যায় না। সে কারণে একুশের চেতনায় এবং এর অন্তর্গত তাৎপর্যে বিশ্বের সব দেশের মানুষই এখন আন্দোলিত হয়, উজ্জীবিত হয়। তারাও নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার তাগিদ ও দায়িত্ব বোধ করে। এখানেই ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ তাৎপর্য ও অতুলনীয় সফলতা।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ববাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ফলে শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরপর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলাহ হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষা বীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।’ ওই পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দি ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৫০ সালে গ্রেফতার হন। বন্দি থাকা অবস্থায়ও ছাত্রদের সাথে সবসময় তাঁর যোগাযোগ ছিল। জেলে থেকেই তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্র নেতাদের গোপনে দিক-নির্দেশনা দিতেন। তিনি ‘জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি পুরান ঢাকার কে এল জুবলি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমাদের ক্লাশ শিক্ষক ছিলেন কামরুজ্জামান স্যার। তিনি পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়েছিলেন। হয়েছিলেন কে এল জুবলি স্কুলের প্রিন্সিপাল। পরবর্তীতে কে এল জুবলি স্কুল কলেজে রূপান্তরিত হলে তিনি কলেজেরও প্রিন্সিপাল হন। তিনি সারাদেশের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। কামরুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমি ক্লাশ ক্যাপ্টেন হওয়ায় স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য ছিলো। স্যারের নেতৃত্বে আমরা একাধিকবার মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও আমরা মিছিল সহকারের ভাষা আন্দোলনের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম।

 

কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান…। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার গর্বিত নাগরিক আমরা। ত্রিশ লাখ জীবনের বিনিময়ে প্রাপ্ত এ বাংলাদেশকে সোনালি ফসলে ভরপুর দেখতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই স্বাধীনতার পর তিনি ডাক দিয়েছেন সবুজ বিপ্লবের। তার প্রণীত এ পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সবুজায়িত হবে সারা বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়িত হলে আমরা অনেকটুকু এগিয়ে যেতে পারব কৃষি উন্নয়নে সমৃদ্ধিতে সফলতায়। আর কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের দেশও উন্নত হবে, হবে স্বনির্ভর।

সার্বিক কৃষিকে কীভাবে বঙ্গবন্ধু দেখতেন এবং এর সমৃদ্ধির জন্য তার মনোভাব কেমন ছিল এ কথার জবাবে বলা যায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনির্ভরতা। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব এখন আমাদের সবার। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করাই হোক আমাদের চলমান অঙ্গীকার। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কৃষিই হচ্ছে আমাদের এ অঙ্গীকার পূরণের প্রধান বাহন।
১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যখন বেগবান হবে তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সম্মুখপানে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মানসে জাতির পিতা এসময় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল যে কোনো উপায়ে কৃষকের স্বার্থরক্ষা করা। কেননা কৃষকই এ দেশের আসল নায়ক যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের সবার অন্ন জোগায়। কৃষকের চলমান, চাহিদা যথোপযুক্তভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক অনেক আগ্রহে স্বতঃস্ফূর্ততায় কৃষিতে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারবে, উন্নয়নের জোয়ার বইবে। কৃষকের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন এত দিন আমরা শোষণে নিষ্পেষণে আমাদের মেধা প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারিনি, এখন সময় এসেছে নিজেদের দেশে নিজেদের জ্ঞান মেধা দক্ষতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। আমরা তখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারব এই তো আমার স্বনির্ভর সোনার বাংলাদেশ।
সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন সবার আগে দরকার আমাদের টোটাল জরিপ। জরিপ ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। সেজন্য সব কাজ করার আগে আমাদের সুষ্ঠু জরিপ করতে হবে। জরিপের ওপর ভিত্তি করে আমাদের সার্বিক পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক কারণে দেশে দিন দিন জমির বিভাজন বেড়ে চলছে। যদি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলা না যায় তাহলে আমাদের কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হবে, আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব না। আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। কোঅপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে আগাতে পারলে আমাদের কৃষির উৎপাদন এবং সার্বিক উন্নয়ন দুটিই মাত্রা পাবে। অধিক শস্য উৎপাদনের জন্য আমাদের সবার সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মাঠের ফসল, গবাদিপশু, মাছ পরিবেশ সব কিছুর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করেত হবে। তা না হলে আমরা কাক্সিক্ষতভাবে এগোতে পারব না। মানুষকে অধিক মাত্রায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিশেষ করে কৃষিশিক্ষা কৃষি অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শিক্ষিত করতে হবে। তখন এমনিতেই আমাদের উন্নয়ন বেগবান হবে। আরেকটি কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু গ্রামের কৃষক অনেক অভিজ্ঞ অনেক দক্ষ। তাদের সাথে শেয়ার করে সমন্বয় করে আধুনিক কৃষিতে এগোতে হবে। তবেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত সফলতা পাবো অনায়াসে।
মানুুষের ওপর জোর করে কিছুই চাপিয়ে দেয়া যাবে না এটি খুব ভালো করে জানতেন বঙ্গবন্ধু। তাই তো তিনি বলেছেন করে দেখাতে হবে, এতে কৃষক নিজে নিজে শিখে নিজের আঙিনায় বাস্তবায়ন করবে। এক গ্রামের ২০ জনকে একসাথে ক্ষেতখামারে হাতে কলমে কাজ দেখালে পাশের অন্য কৃষক দেখে দেখে নিজের জমিতে বাস্তবায়ন করলে উৎপাদন বেড়ে যাবে। তখন সারা বাংলার অন্যরা এগিয়ে আসবে সম্পৃক্ত হবে উন্নয়নের মূলধারায়। কেননা আমাদের কৃষক দেখে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত। তিনি কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা যারা কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন আপনাদের গ্রামে গিয়ে কৃষকের সাথে মিশে যেতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে তাদের চাহিদা আর কর্মের ওপর, তবেই তারা সাহসী হবে, আগ্রহী হবে, উন্নতি করবে। ফলবে সোনার ফসল ক্ষেত ভরে। আপনারা এখন শহরমুখো হওয়ার কথা ভুলে যান। গ্রাম উন্নত হলে দেশ উন্নত হবে, তখন আপনারা আপনা-আপনি উন্নত হয়ে যাবেন। গ্রামভিত্তিক বাংলার উন্নতি মানে দেশের উন্নতি, আর আপনাদের উন্নতি তখন সময়ের ব্যাপার। শহরের ভদ্রলোকদের দিকে তাকিয়ে আপনাদের চিন্তা বা আফসোস করার কোনো কারণ নেই। কেননা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের দিকে আমাদের সবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কৃষক বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা নাহলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না।
অনেকের আগ্রহ থাকতে পারে কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অর্থ বরাদ্দ কেমন ছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ৭৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন…খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বুঝায়। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন উন্নতি করতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। এতে তখন থেকেই কৃষির প্রতি, কৃষি সম্প্রসারণের প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। সুতরাং নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে হবে। সবুজ বিপ্লবের কথা বঙ্গবন্ধু বলতেন। কিন্তু তিনি এও বলতেন, সবুজ বিপ্লবের কথা শুধু মুখে বললেই চলবে না। এর সাথে যেসব সমস্যা আছে সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। তবেই সবুজ বিপ্লব সফল হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষি এবং কৃষকের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষির দূরদর্শিতাকে অসামান্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এ কারণেই তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুনঃসংস্করণ, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। কৃষি বিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তি চর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জাতির জনক বলেছেন খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। আরেকটি কথা বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের উৎপাদন আমাদের সুখশান্তি সব বিপন্ন হবে। সুতরাং যে করেই হোক আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
কৃষি উপকরণে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা যা ছিল আজ এত বছর পরেও আশ্চর্য হতে হয়। কৃষিশিক্ষা, মানসস্মত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ, সুষ্ঠু সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে ভর্তুকি, বালাই ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা, খামারভিত্তিক ফসল ব্যবস্থাপনা, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি পুনর্গঠন, মিল্কভিটা পুনর্গঠন, সার, সেচ, বীজ বিষয়ক কার্যক্রম এসবের ওপর সর্বাত্মক জোর দিয়েছেন। কেননা তিনি জানতেন এগুলো যথাযথভাবে না করতে পারলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাবো। বিশেষ করে রাসায়নিক সারের বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমাদের যে সার কারখানাগুলো আছে এগুলোকে নিশ্চিত উৎপাদনমুখী করতে হবে বেশি করে। প্রয়োজনে আরও নতুন নতুন সারের কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য। সুতরাং আমরাও একান্তভাবে বিশ্বাস করি আমাদের উন্নয়নের কর্মসূচি পরিকল্পনা গ্রহণ করার আগে সুষ্ঠু সমন্বিত বাস্তব অবস্থাভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সর্বোচ্চ শ্রম, মেধা, বিনিয়োগ করে এগিয়ে গেলে আমরা নিশ্চিত সফল হবোই।
গবাদিপশুর কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। গরু দিয়ে হাল চাষ, গরুর গোবর জমিতে প্রয়োগ করে জমির উর্বরতা বাড়ানোর তাগিদ তিনি তখনই দিয়েছেন। বালাই ও বালাইনাশকের কথাও তিনি বলেছেন। নিজেদের বালাইনাশক কারখানা তৈরি ও এর সুষ্ঠু ব্যবহারের প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিজেরা বীজ উৎপাদন করতে হবে। প্রয়োজনে শুরুতে বিদেশ থেকে মানসম্মত বীজ আমদানি করে দেশের বীজের চাহিদা মেটাতে হবে। পরে আমরা নিজেরাই মানসম্মত উন্নত বীজ উদ্ভাবন করব। শীতকালীন ফসল উৎপাদনে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন শীতকাল আমাদের ফসল উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি নির্ভেজাল এবং নিশ্চিত মৌসুম। তাছাড়া অন্য দুই মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে বেশি সংখ্যক বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়। সেজন্য শীতকালে ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে আমাদের শস্যভা-ার টইটুম্বুর করতে হবে।
কৃষিবিদদের তিনি শহরে অবস্থান না করে গ্রামেগঞ্জে চলে গিয়ে কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে বলেছেন। কেননা বঙ্গবন্ধু জানতেন গ্রাম এবং কৃষকই কৃষি উন্নয়নই আমাদের সব উন্নয়নের মূলভিত্তি। গ্রাম এবং কৃষককে উন্নত করতে পারলে কৃষি তথা দেশ এমনিতেই উন্নত হয়ে যাবে। জমির খ-ায়ন বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন সবাই মিলে একসাথে সমবায়ের ভিত্তিতে জমিকে বিভক্ত না করে বড় জমিতে কৃষি কাজ করা। এতে খরচ কমে যাবে লাভ বেশি হবে।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব সীমাহীন। আমাদের রয়েছে উর্বর মাটি, প্রকৃতি প্রদত্ত অফুরন্ত সম্পদ, আর পরিশ্রমী জনগণ। এগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারি। গড়তে পারব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ, সুখে থাকবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল এদেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো, তাই তিনি সার্বিক কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের সৈনিক কৃষিবিদদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। দরকার আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু একটি নতুন মানচিত্র চেয়েছিলেন, নতুন ভূখ- চেয়েছিলেন, নতুন জাতিসত্তা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি স্বনির্ভর সুখী মানুষের সোনার দেশ।
আমাদের সবার সম্মিলিত আন্তরিক এবং কার্যকরী প্রচেষ্টায় আমাদের নিয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সর্বোচ্চ সীমায়। অদূর ভবিষ্যতে আমরা বিনির্মাণ করতে পারব স্বনির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। একটি কথা শুধু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বা শ্রদ্ধা করেই স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলোকে তিল তিল করে কাজে লাগাতে হবে, কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন। তবেই আমরা তার কথা রেখেছি সে কথা বলতে পারব গর্বের সাথে। কথার চেয়ে কাজ বেশি, পরিকল্পনার চেয়ে বাস্তবায়ন বেশিই হোক আমাদের আন্তরিক অঙ্গীকার। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক আমাদের হৃদয়ের মন মানসিকতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আমরা যেন তখন মাথা উঁচু করে বলতে পারি সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এ দেশে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অবদান :
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা তার অন্যতম রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিভূমি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৮টি শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন পেশ করে। সব কমিশন ছিল এ দেশের মানুষের মৌলচেতনা, সমাজ-সংস্কৃতি ও কৃষ্টিবিরোধী। ১৯৭০ সালে নির্বাচনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলে অভিহিত করেন। সে আলোকে ১৯৭৪ সালে একটি সুদূরপ্রসারী শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে তিনি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন জাতিকে উপহার দিয়েছেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত অধ্যাদেশ বাতিল করে ১৯৭৩ সালে উচ্চশিক্ষা প্রসারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন পেশা ও বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন।

১৯৭৪ সালে প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম হতে পারে না। তিনি শিল্পী-সাহিত্যিকদের খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ ১৯৭৪ সালে প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে প্রধান অতিথির পদ অলঙ্কৃত করার আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি তার পরিবর্তে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। ওই সময়ে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে আসেন। ১৯৪১ সালে নিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা শাখার সম্মেলনে তিনি অতিথি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির ও অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশের মাটিতে পা রেখে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। তাতে আবৃত্তি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃতি দিয়ে; এমনকি তিনি বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। তিনি ভাষা আন্দোলনে রাজপথের লড়াকু সৈনিক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় অনশনসহ ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচির দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনা অনুসারীদের কাছে পাঠিয়েছিলেন।

শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নোয়াখালী জেলায় এক জনসভায় গিয়েছিলেন। সেখানে সার্কিট হাউসে অবস্থানরত অবস্থায় একজন বৃদ্ধ শিক্ষক পরিচয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চায়। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছামাত্র বঙ্গবন্ধু শিক্ষককে তার কাছে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শিক্ষকের সেবায় বাদশাহ আলমগীরের চেয়েও বিরাট উদারতার পরিচয় দেন তিনি।

স্বাধীনতার আগে প্রাথমিক শিক্ষকরা স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন। গভর্নর মোনায়েম খাঁর আমলে প্রাথমিক শিক্ষকরা বঙ্গভবন ঘেরাও করে বেতন স্কেলপ্রাপ্ত হয়। স্বাধীনতার পর জাতীয়করণের আগ পর্যন্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ছিল ১২০/-, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ছিল ২/-, প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল ছিল ১৩০/-, ইনক্রিমেন্ট ৩/- টাকা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছিল। সব পেশাজীবীর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকরা সর্বাধিকসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক শিক্ষকরা তাদের স্বল্প বেতন জেলা বোর্ড থেকে পেয়ে থাকতেন।

এ বেতন পোস্ট অফিসের পিওনের মাধ্যমে হাটবারে ভেঙে ভেঙে দেয়া হতো। কী দুর্বিষহ ছিল প্রাথমিক শিক্ষকদের সে সময়ের জীবন! যে হাটবারে পোস্ট অফিসের পিওন টাকা দিত না; সেদিন প্রাথমিক শিক্ষকদের পরিবারে নেমে আসত ঘোর অমানিশা। সে অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষকদের পরনে ছিল লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষক জুতা ছাড়া খালি পায়ে স্কুলে যেত। সে করুণ দৃশ্য আজও মনের মাঝে উঁকি দেয়।

 

শিল্প সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল এ রকম ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তি ৬-দফায় সন্নিবেশিত বাংলার মাটিতে জাতীয় একাডেমি হইবেই।’ ২৪ জানুয়ারি সংগীত শিল্পীদের সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ ঘোষণা করেন এবং কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের যথোচিত ভ‚মিকা পালনের আহ্বান জানান। স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, শিল্প-সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা, সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে, লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে। তাঁর অভিমত ছিল জনগণই সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। তিনি নিজে সারাজীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সংগ্রাম করেছেন। এই জনগণ কেবল শহরে থাকে না, গ্রামে এক বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের বিষয়েও তিনি মনোযোগ দিতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণ সচেতন শিল্পী-সাহিত্যিককে উদ্বেলিত করেছিল। আর তিনি নিজে নিবিড় জনসংযোগের মধ্য দিয়ে ‘রাজনীতির কবি’ হয়েছিলেন বলেই তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আলোড়িত হয়েছে। জীবদ্দশায় যেমন তেমনি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার পর তিনিই হয়ে ওঠেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রেরণার উৎস। কারণ তিনি নিজেই সেই সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন। মানুষকে তিনি বড় বেশি বিশ্বাস করতেন; বড় বেশি সারল্যে মাখা ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবন। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা অন্যদিকে দেশের উন্নয়নে, মানুষের অগ্রগতির চিন্তায় উন্মুখ বঙ্গবন্ধুর দিনগুলো এক একটি কবিতা, তাঁর পুরো জীবন এক একটি উপন্যাস আর তাঁর হাসি-কান্নার মুহূর্তগুলো এক এটি ছোটগল্পের প্রেরণা। তাঁর তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণ দেয়া, পাইপ ও চশমার অনন্য মুখোচ্ছবি চিত্রকলার বিশিষ্ট উদ্দীপনা। আর তাঁর প্রকৃতি, পশুপাখি ও শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ শিশু-কিশোর সাহিত্যের উৎস।
হত্যাকাণ্ডের পর ভীতসন্ত্রস্ত খুনিরা রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তাকে মুছে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় কবরস্থ করে। বত্রিশ নম্বর থেকে জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় তাঁকে পাঠান হলো ঠিকই কিন্তু জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরো বেশি প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়ে উঠলেন। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ সব সুকৃতি। এসবই প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, রং-রেখা-ভাষা-ছন্দ-সুরে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁকে কেন্দ্র করে গান রচিত হয়েছে, রাজনৈতিক পোস্টারে মুদ্রিত তাঁর প্রতিকৃতি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। একাত্তরে গণসংগীতের মূল স্তম্ভ ছিলেন তিনি। ১৫ আগস্টের পর চিত্রকলার অজস্র তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো আর মুখাবয়বের পেলবতা। ডাকটিকেট-ম্যুরাল-ভাস্কর্য এবং নাটক-চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। মূলত শিল্পী-সাহিত্যিকরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আত্মত্যাগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। মানব-মানবতা ও মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিককে উৎসাহী করেছেন স্বাভাবিকভাবেই। কারণ মানবমুক্তির গান শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রধান অবলম্বন। এজন্য মহামানবের মাঝে প্রেরণা অন্বেষণ করে বাঙালি জাতি ও সাধারণ জনতাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে সৃজনশীল স্রষ্টাদের কর্মে।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশে তিনি লিখেছেন “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি।’ কাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সব ভাষায়ই পাবেন, সব জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সব রকম গুণ থাকা সত্তেবও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, পৃ. ৪৭-৪৮)
মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ধর্ম ছিল ইসলাম এবং হজরত মুহম্মদ (দ.) তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় পয়গম্বর ছিলেন। কিন্তু অন্য সব ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে একজন একনিষ্ঠ মানব পূজারি। সব ধর্মই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত সেই কল্যাণধর্মের তিনি ছিলেন উপাসক। একজন মুসলমান হয়েও এই কল্যাণধর্মের উপাসক হওয়া যায় এতে তাঁর কোনো মানসিক বিরোধ ঘটেনি। কেননা তাঁর মতে, ইসলাম মানব-কল্যাণ চেতনার উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ কারণেই একজন যথার্থ বাঙালি এবং একজন মুসলমান হওয়ার পথে কোনোদিন তিনি কোনো বিরোধের সম্মুখীন হননি। (দ্রষ্টব্য : ড. সুনীল কান্তি দে [সম্পা.], ২০১০, বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র, অঙ্কুর প্রকাশনী) তিনি যে বাঙালি এজন্য গর্বিত, আবার তিনি যে মুসলমান এজন্যও তাঁর গর্ব কম ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনে-প্রাণে বাঙালি। রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পর্বে দলের বিশ্বাস ও নিজের জীবন দর্শনকে একীভ‚ত করে নিয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের অপব্যবহার ও সমাজে ধর্মের নামে হানাহানির ঘটনা দেখেছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মকে সামনে রেখেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে শাসন ও শোষণ করেছে। এজন্য সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মকে মেনে নিয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। সব ধর্মের সহাবস্থান এবং বদ্ধ চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়। ভারতজুড়ে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় তাঁর ভ‚মিকার কথা আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৬৩ থেকে ৭৫ পৃষ্ঠায়। প্রথাবদ্ধ, ধর্ম-শাসিত সংস্কারাছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ধর্মের গÐি ভেঙে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল তাঁর নীতি আদর্শ। বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি তাঁর রাষ্ট্র পরিকল্পনায়, সংবিধান প্রণয়নে। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩)
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্বদিন পর্যন্ত দেশের গণমানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তিনি সবসময় শোষিতের মুক্তি কামনা করেছেন। আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সব অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ভ‚মিকা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচিতেও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন।

ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের এমন কোনো বিষয় নেই যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ছিলেন। তিনি মানুষের চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছে। ভারতীয় সাহিত্যে মাহাত্মা গান্ধী যেমন মানুষের কাছে লেখার উৎস ও প্রেরণায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু অনেক লেখককে কেবল নয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে উন্মোচিত হয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা-মননে অব্যক্ত বেদনার নির্ঝর নিঃসরণ হয়েছে। আবার বাংলা শিল্প-সাহিত্যে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দুঃখ বাংলাদেশের সাহিত্যে জন্মশতবর্ষেও ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ নাম দিয়ে একটি সময়-পর্ব এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে ‘গান্ধী-যুগ’ বলে একটি কালপর্ব নির্দিষ্ট হয়েছে। বিশেষত ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের দুই যুগের বেশি সময় ‘গান্ধী-যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত। কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে। মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মিতা, বক্তব্য, তাঁর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুরই দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মিতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য সামাজিক মানুষের হৃদয়ে প্রবেশে তাঁর কষ্ট করতে হয়নি। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ-সরল মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; তাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। গান্ধীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রভাব জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, চেতনাকে করেছিল পরিশুদ্ধ, ধারণা দিয়েছিল পাল্টে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কবিতার মুখ্য উপাদান। ১৯৮২ সালে নির্মিত Richard Attenborough-এর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রটি পৃথিবীব্যাপী মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ইংরেজিতে লেখা মুলক রাজ আনন্দ্, রাজা রাও, আর কে নারায়ণের উপন্যাস পড়ে এ ছবির নির্মাতা গল্পের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ ধরনের ছবি বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তবে গান্ধী যেমন ভারতের ভাষা-সাহিত্যকে নতুন উদ্দীপনায় মুখরিত করেছিলেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তা ও জীবনযাপন দিয়ে সচকিত করে তুলেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা গল্পের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত পরিস্থিতি, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের জন্য ত্যাগের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁর মৃত্যু ছিল হাহাকারের; সেই অবস্থা তুলে ধরেছেন সাহিত্যিকরা। যদিও কোনো গল্প-উপন্যাসে ‘মুজিববাদে’র অনুপুঙ্খ রূপায়ণ নেই তবু একটি ‘আদর্শ বাঙালি রাজনৈতিক’ জীবনকে কেন্দ্র করে প্রভ‚ত আখ্যান গড়ে উঠেছে। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে লোকায়ত মানসে মুজিব চিরন্তন হয়ে ওঠার কাহিনীও তৈরি হয়েছে। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাঁকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। সাধারণ জনতার কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাঁর জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে তাঁরা ১৯৭৭ সালের পর সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে।
উল্লেখ্য, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আর আবুল ফজল ও ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্প অন্যদিকে ভুবনখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের চিত্রকলা প্রথম থেকেই আমাদের অন্তর ছুঁয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সে সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সংগোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদগম হয়েছে।
মূলত বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, তাঁর অতি সাধারণ জীবন-যাপন তাঁকে লেখকদের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। তিনি যদিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাঁর সম্পর্কে কিংবদন্তির প্রয়োজন ছিল না যদিও তাঁকে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নানান রহস্যময় ঘটনার প্রসঙ্গ। রাজা রাও, মুলক রাজ আনন্দ এবং আর কে নারায়ণের গল্প-উপন্যাসে গান্ধীকে যেমন কাহিনী বর্ণনায় নানা ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তাঁর আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের গুপ্ত কমিউনিস্ট সর্বহারাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং সর্বহারারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের হত্যা করেছিল তার চিত্র রয়েছে কয়েকটি গল্পে। সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা ও ভালোবাসায় সবাইকে কাছে টানা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশিষ্টতা। অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেয়া, সৎ ও নীতিপরায়ণ থাকা এবং ভণ্ডমি না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেয়া, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা না করা তাঁর সমগ্র জীবনের মুখ্য আদর্শ। বর্তমান বাংলা শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর সেই চেতনা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্রই। মূলত তাঁর চেতনার প্রভাব শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রসারিত হয়েছে এবং আগামীতে তা বহাল থাকবে জন্মশতবর্ষে এই প্রত্যাশা আমাদের।

 

গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য থাকাকালে ৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৭৩ সালে গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু গ্রন্থাগারের উন্নয়নে দুই কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি এনাম কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর নামে যাত্রা করে। এদেশে গ্রন্থাগার আন্দোলন বেগবানকরণ ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবদান।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, সভ্যতার অন্যতম বাহন হচ্ছে গ্রন্থ। গ্রন্থের ওপর ভর করেই এগিয়েছে মানব সভ্যতা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থকেন্দ্র সাত পাহাড়ের দেশ রোমে এবং গ্রীসে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই। ১৮৫০ সালে ইংল্যান্ডে গণগ্রন্থাগার আইন পাসের পরই ইংরেজ শাসক ও দেশীয় এলিটদের সহযোগিতায় পূর্ববঙ্গে গ্রন্থাগার আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৮৫৪ সালে যশোরে প্রতিষ্ঠিত হয় পাবলিক লাইব্রেরি। এর ধারাবাহিকতায় বগুড়ার উডবার্ন, নাটোরে ডিক্টোরিয়া লাইব্রেরিসহ পূর্ববঙ্গে ডজনখানেক গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে।

 

বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
নতুন প্রজন্মের কাছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আদর্শকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তার অবদানকে গুরুত্বসহকারে গণমাধ্যমে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্বনেতাদের এ পদকে ভূষিত করা হয়।

এতে আরো বলা হয়, বিশ্ব শান্তি পরিষদের শান্তি পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। এ মহান অর্জনের ফলে জাতির পিতা পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে। তাই আজকের তারিখটি বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির ৪৭তম বার্ষিকী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসরণ করে নভেল করোনাভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনসমাগম এড়িয়ে দিবসটি উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

 

স্বাস্থ্যখাতে বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবনা ছিল—একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে চাই স্বাস্থ্যবান জাতি। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতকে শুধু গুরুত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, ব্যাপক সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুই তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই লক্ষ্যে গৃহীত ১০ শয্যার থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিশ্বে আজও সমাদৃত মডেল। চিকিত্সক এবং চিকিত্সা খাতে বঙ্গবন্ধুর অবদান ১. সংবিধানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা পাওয়াকে মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ২. আইপিজিএমআর (সাবেক পিজি) হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হিসেবে স্থাপন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিত্সকরা পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করে থাকেন। এই সঙ্গে প্রতিবছর লাখ লাখ রোগীকে উচ্চ মানসম্পন্ন চিকিত্সা প্রদান করা হয়। ৩. বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিত্সকদের ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। ৪. স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। ৫. ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান। ৬. ১৯৭৪ সালে জনস্বাস্থ্য পুষ্টিপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা। ৭. ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ পুষ্টি পরিষদ’ গঠনের আদেশে স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮. বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা। ৯. চিকিত্সকদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান। আগে যা দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় ছিল। ১০. নার্সিংসেবা ও টেকনোলজির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। ১১. উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল নীতি হলো, ‘Prevention is better then cure’—এ নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিপসম’ নামের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে রোগ, রোগতত্ত্ব এবং রোগের প্রতিকারবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ১২. বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) প্রতিষ্ঠা। ১৩. ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। ১৪. জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান স্থাপন। ওষুধশিল্পে বঙ্গবন্ধুর অবদান স্বাধীন বাংলাদেশে ওষুধশিল্প ছিল অত্যন্ত নাজুক অবস্থায়। দেশে ৮০ শতাংশের বেশি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হতো। দেশে যে সামান্য পরিমাণ ওষুধ উত্পাদন হতো, তা-ও বিদেশি ওষুধ কম্পানির নিয়ন্ত্রাধীন ছিল। তা ছাড়া ওষুধশিল্পে সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ‘ড্রাগ কন্ট্রোলার অফিস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের মানুষ যেন প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা যায় সে লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে দেশের কয়েকজন প্রখ্যাত চিকিত্সককে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি কমিটি গঠন করান। এই কমিটিকে এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন, বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ওষুধের মান যাচাই-বাছাই, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। গঠন করা হয় টিসিবির অধীনে একটি ‘ড্রাগ সেল’। মূলত এসব কর্মকাণ্ডই ‘ছায়া ওষুধ নীতি’ হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওষুধের আমদানি কমিয়ে দেশে ওষুধ উত্পাদন বৃদ্ধি এবং ওষুধশিল্পকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য ‘ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তর’ গঠন করেন। এ ছাড়া ওষুধের আমদানি কমিয়ে আনতে আগেই গঠিত ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’কে নির্দেশ দেন নতুন ওষুধশিল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে। একজন রাষ্ট্রনায়ক কতটা দূরদর্শী হলে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন এবং জীবন রক্ষাকারী অত্যাবশ্যকীয় একটি অনুষঙ্গের সরবরাহ নিশ্চিতের এত বড় উদ্যোগ নিতে পারেন! শুধু তা-ই নয়, জনস্বার্থ রক্ষার্থে বিদেশি কম্পানির পেটেন্টকৃত ওষুধও দেশীয় ওষুধ কম্পানি কর্তৃক উত্পাদনের জন্য গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পেটেন্ট আইনের বাইরে রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তখন বলা হয়েছিল—আন্তর্জাতিক ওষুধ কম্পানিগুলোর পেটেন্ট আইন না মানলে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হতে পারে। অকুতোভয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি সারাজীবন বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। সারাজীবন ঘরসংসার ফেলে জেল খেটেছি। না হয় বাংলার মানুষের ওষুধের অধিকার আদায়ের জন্য কিছুদিন জেল খাটব।’ দেশের মানুষের জন্য কতটা মমত্ব থাকলে এতটা নিঃস্বার্থ সাহস দেখাতে পারেন একজন নেতা। একজন জনগণের প্রিয় মানুষ। এমন একজন অভিভাবকই তো জাতির পিতা হবেন। ফার্মাসিস্টদের জন্য অধ্যাপক আ ব ম ফারুক স্যারের লেখা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানের ফার্মাসিস্টদের পেশাগত রেজিস্ট্রেশন প্রদানের জন্য ফার্মেসি কাউন্সিল ছিল না। এতে দেশের ফার্মাসিস্টরা বিদেশে কাজ করতে গেলে সমস্যায় পড়তেন, যেহেতু তাঁদের কোনো সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। ১৯৭৪ সালে ফার্মাসিস্টদের পেশাগত রেজিস্ট্রেশন প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

* নার্সিং ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবদানঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’ এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘একটি স্বাধীন, সার্বভৌম সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।’

বাংলার মানুষের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে। তাই তিনি প্রজ্ঞার আলোকে গঠিত ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৫ (ক)অনুচ্ছেদ জীবনধারণের সকল মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকরণ রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব এবং ১৮ (১) অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থের উন্নতিসাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

মৌলিক বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি গ্রহণ করেছিলেন রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে, চাই একটি স্বাস্থ্যবান জাতি। এজন্য তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি গ্রহণ করেছেন সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো রেখে গেছেন যার ওপরে গড়ে উঠেছে আজকের বিশ্বনন্দিত অনেক কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধুর তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসা সেবার জন্য থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প আজও বিশ্বে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার এক সমাদৃত মডেল।

বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রয়েছে-
১. আইপিজিএমআর (পিজি হাসপাতাল)-কে শাহবাগে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হিসেবে স্থাপন।
২. বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) প্রতিষ্ঠা।
৩. বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান এ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা।
৪. স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন।
৫. ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান।
৬. চিকিৎসকদের সরকারি চাকরিতে ১ম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান।
৭. নার্সিং সেবা এবং টেকনোলজির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ।
৮.কম উন্নয়শীল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলনীতি হলো- Prevention is better than cure-এ নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে নিপসম-১৯৭৮ সালে চালু করা হয়।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সুদীর্ঘ ২১ বছর চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় পাকিস্তানী ভাবধারা অনুসরণ করে। যে কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল উন্নয়ন ব্যাহত হয়, বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নার্সিং পেশা নিয়ে বলেছিলেন- ‘আমি রোগী হয়ে দেখেছি, ঘুরে দেখেছি। আমাদের নার্সিং যেন আমাদের সমাজের জন্য একটি অসম্মানজনক পেশা। আমি বুঝতে পারি না এ সমাজ কি করে বাঁচবে। একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করছে ,তার সম্মান হবে না আর ভালো কাপড় চোপড় পরে যারা ঘুরে বেড়াবে তার সম্মান হবে অনেক উচ্চে, চেয়ারখানা তাকেই দেয়া হবে। এরও একটা মান থাকতে হবে। আমি ডাক্তার সাহেবদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম যে, আপনারা আমাকে একটা প্লান দেন, যাতে আইএ পাশ এবং গ্রাজুয়েট মেয়েরা এখানে আসতে পারে।’

একজন সফল রাষ্ট্র নায়কের এমন মন্তব্যই প্রতিফলিত করে নার্সিং পেশাকে সমুন্নত করবার চেষ্টা ছিল তার।
তবে এটি সত্যি যে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নার্সদের কোন আন্দোলন করতে হয়নি, বিষয়গুলো উনার নজরে আনলেই বাস্তবায়ন হয়েছে। দ্রুতই নার্সদের সকল দাবি পূরণ হয়েছে। বাস্তবায়ন হচ্ছে গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল কার্যক্রম।

ক. নার্সদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৩য় শ্রেণি থেকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে।
খ. ২০০৯ সাল থেকে অদ্যবধি প্রায় ২৪ হাজার ৭শ’ নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে, আরও চলমান রয়েছে।
গ. নার্সিং জনশক্তি বৃদ্ধির জন্য ১২টি নতুন নার্সিং ইনস্টটিউটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছেন। ১১টি ইনস্টিটিউটকে কলেজে উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে ৪৩টি নার্সিং ইনিস্টিটিউট ও ১১টি কলেজে নার্সিং শিক্ষা কার্যক্রম চলমান।
ঘ. নার্সদের উচ্চ শিক্ষার জন্য মুগদায় কোরিয়ান সরকারের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে National Institute of Advanced Nursing education and Research (NIANER)। যেখানে ইতোমধ্যে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়েছে,
ঙ. নতুন করে জনবল কাঠামোসহ নার্সিং ও মিডওয়াইকারী অধিদফতর সৃষ্টি করা হয়েছে,
চ. বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইকারী কাউন্সিল আইন ২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছে।
ছ. নার্স তৈরির লক্ষে বেসরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেপিজে মেমোরিয়াল নার্সিং কলেজ অন্যতম।

নার্স হিসেবে গর্ববোধ করি আমরা। জাতির পিতার অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে বিশ্ব মাঝে বাংলাদেশ একদিন নার্সিং খাতে রোল মডেল হবে।

 

ইসলামে বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনকালে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসিলম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের কথা মনে রেখে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

২. জাতীয় পর্যায়ে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা) পালন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম হাক্কানী আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে পবিত্র ইসলামের সঠিক রৃপ জনগণের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সীরাত মজলিশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সীরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে ‍মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাযতুল মুকাররম সমজিদ চত্বরে মাহফিলের উদ্বোধন করেন।
একজন সরকার প্রধান হিসেবে জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিলের উদ্বোধন উপমাহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকাতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিল উদযাপন হয়ে আসছে।

৩. হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা

পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন।

৪. মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন

ইসলামি আকিদা ভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন। পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্ত্বশাসিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করে এর নাম রাখেন “বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড”।

৫. বেতার ও টিভিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রচার

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত ও তাফসীর প্রচার শুরু হয়। ফলে, বেতার ও টিভির অনুষ্ঠান সকালের সূচনা ও দিবসের কর্মসূচি কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত এ ব্যবস্থাই বাংলাদেশে চালু রয়েছে।

৬. ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা।

ইসলামের ধর্মীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। উল্লিখিত দিনসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন।

৭) মদ, জুয়া, হাউজ ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান করা।

ইসলামে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অবাধে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান জারি করেন।

৮) ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতা নিষিদ্ধকরণ

পাকিস্তানি আমলে ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। সেখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতার নামে চলত জুয়া, হাউজি ও বাজিধরা প্রতিযোগীতা। এই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে বাজিতে হেরে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যেতো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতা বন্ধ করেন এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের প্রিয় নবী (স) বৃক্ষরোপণের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যদি মনে কর আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি বৃক্ষের চারা রোপন কর।” মহানবী (স) এর এই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে রেসকোর্স ময়দানের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি সেখানে বৃক্ষরোপণ করে সেই স্থানের নাম রাখেন “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।” ঢাকা মহানগরীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষরাজি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবহণ করে চলেছে।

৯. বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জায়দা বরাদ্দ

তাবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামের পথে দাওয়াত দেওয়াই হচ্ছে এ সংগঠনের একমাত্র কাজ। এই সংগঠনটি যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দাওয়াতি কাজে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার তাবলীগী ভাই এ জামাতে সমবেত হন। বঙ্গবন্ধু টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার এই স্থানটি বরাদ্দ করেছিলেন বলেই ইজতেমায় আগত লক্ষ লক্ষ মুসলিম এখানে সমবেত হয়ে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

১০) কাকরাইলের মারকাজ মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ।

বর্তমানে কাকরাইলের যে মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলীগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এ মসজিদটি ছিল খুবই অপ্রশস্ত। বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের তাবলীগ জামাতের মারকাজ মসজিদের জন্য স্থান বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তারই নির্দেশে সম্প্রসারিত হয়।

১১. রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা

রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিস্ট দেশ। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে তাবলীগ জামাতের যেসব দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১২) আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আবর বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ

১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখর চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে এক লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করা হয়।

১৩) ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা সমুন্নত হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে।

এভাবে পর্যলোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে বিপুল অবদান রাখেন, গোটা পৃতিবীতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। তবু ইসলামের লেবাসধারী একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে, যা এখনও চলছে-নানা কৌশলে, নানা আঙ্গিকে।

বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ জাতির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। টুঙ্গিপাড়ায় পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। যে মাটির সান্নিধ্যে ও যে প্রকৃতিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন, সেই মাটির সান্নিধ্যে, প্রকৃতির শীতল স্নেহ ও একান্ত স্পর্শে তিনি শেষশয্যা গ্রহণ করেছেন।

উপসংহার:
জাতির মহান নেতা হতে হলে যে সমস্ত গুণের প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর তার সবই ছিল। তিনি ছিলেন সাহসী ও স্বাধীনতাপ্রিয়। সকল নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং অধিকার অর্জনের সংগ্রামে আপসহীন। কোনো প্রকার ভীতি কিংবা দ্বিধা তাকে বিচলিত করতে পারেনি। বাংলা ছিল তার দেশ, বাংলা ছিল তার ভাষা এবং তিনি নিজেকে বলতেন ‘আমি বাঙালি’। কবির উপলব্ধিই যথার্থ, কোটি বাঙালির মনের কথা –

“যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

বঙ্গবন্ধু: অবদান ও দর্শন / লেখক: দ্বীন মোহাম্মাদ দুখু 

 

তথ্য সূত্রঃ
১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী: বঙ্গবন্ধু
২. আমার দেখা নয়াচীন
৩. কারাগারের রোজনামচা
৪. জনক আমার নেতা আমার : শেখ হাসিনা
৫. শেখ মুজিব আমার পিতা: শেখ হাসিনা
৬. উইকিপিডিয়া
৭. দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টাল

 

আলোকিত প্রতিদিন/ ১৮ মার্চ-২১/ দ ম দ

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here