কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড গ্রামীণ অবকাঠামো, বিপর্যস্ত মানুষ আর অধিকাংশ বসতভিটা। কাঁচা পাকা রাস্তার নাকাল অবস্থায় যান চলাচল তো দূরের কথা হেঁটে চলাচল করাও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভয়ংকর তান্ডব লীলা চলেছে এই জনপদে। প্রকৃতির এমন বিমাতা সূলভ আচরণ নতুন নয় কিংবা একেবারেই অযৌক্তিক নয়। প্রকৃতির উপর মানুষ যে পরিমাণ অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে, এতে করে প্রকৃতিও তার চিরায়ত সৌন্দর্যের খোলস বদলাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, কল-কারখানার বর্জ্য এবং গাড়ীর ধোঁয়া বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। চরম সভ্যতা এক সময় মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় হামাগুড়ি দিয়ে লুকাবে অন্ধকারের পেটে।
ভূ প্রকৃতির এ পরিবর্তনের খেসারত তো আমাদেরই গুনতে হবে। সহজ হতে অতি সহজ সমীকরণও আমাদের শিক্ষা দেয় প্রাকৃতিক বৈরিতা মানব সৃষ্ট। রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তায় বিনষ্ট হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন।
ঝড়ের দাপাদাপি কিছুটা কমে এলেও বাড়ছে বৃষ্টির প্রখরতা । বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাতের গভীরতা । রাতের নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে নামছে মুশলধারে বৃষ্টি।
কাক ভেজা শরীরে যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে ইমরুল। চারপাশে কোন জন মানুষ নেই। যাত্রী ছাউনির এককোণে জড়সড় হয়ে ইমরুল বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষার প্রহর শুনছে । শহর থেকে ফিরে স্টেশনে নামার পরই কপালে জুটেছে বৃষ্টির আদিখ্যেতা।
ইমরুল একবার ঘড়ির দিকে তাকায় পুনরায় আকাশে। না বৃষ্টি কমে আসার কোন লক্ষণ নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলো আর বজ্রপাতের বিকট শব্দে আঁতকে ওঠে ইমরুল। মধ্য বয়সী যুবক, কলিজা বুঝাই সাহস থাকার পরেও একাকীত্বের কারণে মাঝে মাঝে শরীরের মধ্যে ঝাঁকুনি দেয়। পুনরায় সাহসে ভর করে মনোবল চাঙ্গা করে। এভাবেই চলে নিজের সাথে নিজের বুঝা পড়া। আবেগের উচ্ছ্বাসে কতটা বিপর্যস্ত, কতটা অসহায় তা ভেবে নিজেকে নিজেই ধিক্কার দেয় ইমরুল।
রাত দ্বিপ্রহর। বৃষ্টির যৌবন যেন ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে পড়ছে। যাত্রী ছাউনী হতে ৫ কিলোমিটার রাস্তার পর ইমরুলদের বাড়ী । ঝড় বৃষ্টিতে ভিজেই রওনা হয় নিজ গ্রাম হিজলতলীর দিকে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে কিছু সময়ের জন্য চোখ ধাঁধানো ঝলকানি দেখা গেলেও তারপর মিস কালো অন্ধকার। আলো আঁধারীর লুকোচুরি খেলার মাঝেই বাড়ীর রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। পরনের প্যান্ট শার্ট বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপটে গেছে। পায়ের কেট্রস এর মধ্যে পানি ঢুকেছে। হাঁটতে গেলেই কেমন যেন খপাত খপাত শব্দ হচ্ছে। বিধি বাম রাস্তা আগলিয়ে পড়ে আছে থরে থরে আস্ত বাঁশ । রাস্তার এ প্রান্ত হতে ওপর প্রান্তে বাঁশগুলো পড়ে আছে আড়াআড়ি ভাবে। দেখে মনে হয় পুরো বাঁশ ঝাড় উপড়ে পড়েছে রাস্তার উপর।
গাছের ডালপালা, আস্ত গাছ, বাঁশ ঝাড়, বাড়ীর টিনের চাল এমনকি আস্ত ঘর উড়িয়ে নিয়েছে ঘূর্ণিঝড়।
ইমরুল কয়েক সেকেন্ড ভাবে কিভাবে অতিক্রম করবে রাস্তায় পড়ে থাকা বাঁশ । পলিথিনের মধ্যে মুড়িয়ে রাখা পকেটের মোবাইল ফোন বের করে লাইট জ্বালায়। একটি বাঁশ অতিক্রম করার জন্য বাঁশের অপর প্রান্তে এক পা রাখতেই তরতর করে বাঁশটি সোজা হতে থাকে। ইমরুল বাঁশের উপর বসে শক্ত করে দু হাত দিয়ে ধরতে গিয়ে হাতের মোবাইল ফোনটি পড়ে যায়। বাঁশ একবার উপর দিকে উঠে আবার নিচের দিকে শো শো শব্দে নাগর দোলার মতো দোল খেতে থাকে। বাঁশের উপর বসে থাকা ইমরুলের অন্তর আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মোবাইল ফোনটি নরম কাদামাটির মধ্যে গেড়ে যায়। আকাশের দিকে তির্যকভাবে মিটমিট করে জ্বলছে মোবাইলের ক্ষীর্ণ আলো।
বাঁশ আর কঞ্চির সপাং সপাং আঘাতে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেটে অঝোরে রক্ত ঝরছে। এ যেন হাতির সুরে পেচিয়ে জীবন্ত মানুষকে আছড়ে মারার দৃশ্য। মনে মনে খানিকটা ঘাবড়ে যায় ইমরুল। মৃত্যু সন্নিকটে ভেবে দোয়া কালিমা পড়তে থাকে। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার ইতিহাস। ধীরে ধীরে সব কিছু তার নিকট ধোঁয়াশা হয়ে ওঠে।
অপরদিকে অন্ধকার ঘরে চিত হয়ে শুয়ে আছে লুবনা । পিতা হোসেন আলী ও মাতা মমতা বেগম । শিয়রে বসে রাত জেগে চোখ মুখ লালচে করে ফেলেছে। মায়ের মমতাময়ী মন একমাত্র কন্যার দুরাবস্থা দেখে হু হু করে কেঁদে উঠে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কপালে জলপট্টি। রাত গভীর হতে থাকে। লুবনার ঘুম ভেঙে যায়। থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঝাঁকুনি দিয়ে শরিরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। বিছানা হতে ধড়ফড় করে উঠতে চায়, বাবা মা বিছানায় চেপে ধরে আবার শুইয়ে দেয়। শুরু করে চিৎকার চেঁচামেচি । এক পর্যায়ে শরীর নেতিয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।
লুবনা ষড়শী তরুণী। দেখতে সুদর্শনা। নম্র ভদ্র মার্জিত। আচরণের দিক থেকে আশে পাশের দশ গ্রামের মেয়েদের চেয়ে আলাদা। যেমন সিমসাম দেহ, বাচনভঙ্গি, তেমনি সুন্দরী। কোন দিক থেকেই এমন মেয়েকে কেউ অপছন্দ করার কোন কারণ নেই। ছাত্রী হিসেবেও অত্যন্ত মেধাবী। মেডিক্যালের শেষ বর্ষের ছাত্রী। হঠাৎ করে কি থেকে কি যে হয়ে গেল। বাবা মায়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়ে লুবনা এখন পাগলের মতো আচরণ করছে। মেয়ের শিয়রে বসে ভাবেন হোসেন আলী। ভাবতে ভাবতে আবেগপ্রবণ হয়ে দরদর করে চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। ডাক্তারী পড়ার প্রাক্টিক্যাল ক্লাসের কার্যক্রমের পিণ্ডি চটকাতে থাকেন মনে মনে।
জ্বর মাথায় উঠেছে লুবনার। বালতি ভরে পানি এনে ম্থাায় ঢালতে থাকে মমতা বেগম। মাথা ভর্তি চুলে জট বেঁধেছে, পানিও পৌঁছাতে পারে না মাথার তালুতে। চুলের গোড়ার অংশে জট হয়ে গেছে। দিন গড়াতে বাড়তে থাকে মাথার চুলের জট। চুলের জট দিন দিন সমস্ত চুলকে বেনি বাঁধার মত একত্র করে ফেলেছে। কেচি দিয়ে চুলের জট কাটতে চায়। চুল কেচি চালাতেই দরদর করে পড়তে থাকে রক্ত। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে চুল কাটা বন্ধ রাখে। অবাক হতবাক নির্বাক নেত্রে তাকিয়ে থাকে চুলের দিকে।
ঘরময় শুন শান নিরবতা। হোসেন আলী ও মমতা বেগমের চোখে ভর করেছে ঘুমের রাজ্য। তাকাতে চাইলেও ঢুলু ঢুলু চোখ মুদে আসে। কয়েকদিন ধরে নির্ঘুম রাত কাটানোর ধকল সামলাতে পারছেন না।
বাইরে বিরামহীন ঝড় বাদল। কিছু সময় পর চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে যান হোসেন আলী ও মমতা বেগম।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় লুবনার। তাকিয়ে দেখে বাবা মা দু’জনই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসে। এরপর জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালার দরজা ধীরে ধীরে খুলে। বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা লুবনার মুখে আছড়ে পড়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে দেখে দূরে অনেক দূরে ধবধবে পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাকের একজন নওজুয়ানের আকৃতিতে ছায়ামূতি। দু হাত প্রসারিত করে লুবনাকে ডাকে। মিহি কণ্ঠের সে আহবান উদ্বেলিত করে লুবনার হৃদয়।
অজানা আকর্ষণে লুবনা ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে ফেলে হিতাহিত জ্ঞান। ভুলে যায় নারী পুরুষের বৈষম্য। শ্রেণি বিভাজন। লোক লজ্জার ভয়। ধীরে ধীরে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে লুবনা। দু’ হাত প্রসারিত করে জানালার গ্রিল ধরে হেচকা টান মারে। হাতের সাথে উঠে আসে গ্রিল। ক্ষিপ্রতার সাথে জানালার ফাঁক গলিয়ে লাফ দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায়। নওজুয়ানের দিকে ক্ষিপ্রতার সাথে এগুতে থাকে। গ্রিল খোলার শব্দে ধড়পড় করে ঘুম হতে উঠে মমতা বেগম এবং হোসেন আলী। আটকাবার পূর্বেই জানালা টপকিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় আদরের কন্যা।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে লুবনার মা, বাবা। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের তালে বাতাসে ভাসতে থাকে বুকফাটা আর্তনাদ। লুবনা যতই ছায়ামূর্তির দিকে দৌড়ে এগুচ্ছে ততই ধীরে ধীরে ছায়ামূর্তি পিছাতে থাকে। ছায়ামূর্তির আকর্ষণে হিতাহিত কাণ্ড জ্ঞান হারিয়ে ফেলে লুবনা।
অপর দিকে ইমরুল অনেক কষ্টে ঝুলন্ত বাঁশ হতে একটি পা বের করে নিয়েছে। শক্ত করে বাঁশ ধরে ঝুলে আছে। বাঁশ অনেক উপরে হলেও মাঝে মাঝে নিচের দিকেও নেমে আসে।
ইমরুল নিচের দিকে তাকিয়ে ভালো করে একবার দেখে নেয়। বাঁশটি নিচের দিকে নামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। না, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশ । নিচ দিকে হেলানোর অনেক চেষ্টা করে। ছোট বেলার দোলন কাঠি খেলবার মতো নিচ দিকে নামিয়ে আনতে চায় বাঁশটির মাথা। এ দিকে দু’ হাতের শিরা উপশিরায় টনটন করে ব্যথা বাড়তে থাকে। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কোকিয়ে উঠে। দমকা হাওয়া উড়ে এসে বাঁশটি নিচের দিকে কড়কড় শব্দে নামাতে থাকে। দ্রুততার সাথে ধরে রাখা বাঁশ ছেড়ে দেয় ইমরুল। মাটির মধ্যে লুটিয়ে পড়ে। সমস্ত শরীরে আঘাত পেয়েছে । জবাই করা মুরগির মতো কয়েক সেকেন্ড দাপাদাপির পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
লুবনা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির হয় ইমরুলের কাছে। পাশে মোবাইলের ক্ষীর্ণ আলতে চিনে ফেলে ইমরুলকে। এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে ইমরুলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে মনে করতে থাকে বাল্যকালের ঘটনা। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাথে আড্ডা। কত হাসি ঠাট্টা কত গল্প গুজব। মনের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনের আনন্দ উল্লাসের ইতিবৃত্ত। বলাই বাহুল্য একে অপরের প্রতি খানিকটা দূর্বল। দুজনের মনে মনে কত শত কথা হয়েছে। কথা হয়েছে চোখে চোখে।
লুবনা নিজের অজান্তেই ঢুকরে কেঁদে উঠে। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, ইমরুলের শরীরে মুখ লুকায়। রাগে ক্ষোভে ছায়ামূর্তি রাক্ষুষের আকৃতি ধারণ করে। বিশাল আকৃতির দেহ, দানবীয় হাত, বন মানুষের মতো নখ ও দাঁত । রক্ত পিপাসু ড্রাকুলা মতো হিংস্রতা চোখে মুখে। চোখ দিয়ে নির্গত হতে থাকে অগ্নিশিখা । দু’ হাত প্রসারিত করে দু’ জনের ঘাড় ধরে ফেলে। ডান হাতে ইমরুল আর বাম হাতে লুবনা দু’ জনকে ধরে ধীরে ধীরে শূন্যে তুলতে থাকে। দু’ জনের দাপাদাপিত, চিৎকার চেঁচামেচিতে ভারী হয়ে উঠে রাতের হিম শীতল বাতাস। ভূকম্পনে প্রতিধ্বনিত হয় মাটি। রাক্ষুষের পৈশাচিক আনন্দ, খুবলে খুবলে খায় স্বাধীনতার সৌন্দর্য। মানবিক মূল্যবোধ।
গল্প: ভয়ার্ত রাতের শরীর
লেখক: সৈয়দ রনো