প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা:
টানা ৫দিন ধরে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে ট্রাক থেকে পণ্য লোড-আনলোড বন্ধ রয়েছে। ফলে ৫ দিনে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে একটি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তা ছাড় করানোর সময় লেবার বিল ও রাজস্ব একই সাথে পরিশোধ করতে হয়। সরকারের কাছ থেকে বিল তুলে নিয়ে লেবারদের বিল পরিশোধ করেন লেবার ঠিকাদার। এরপর পণ্য খালাসের সময় আবারও বিল দিতে হয় লেবারদের। ফলে একই পণ্যে দুইবার লোড-আনলোড বিল গুনতে হয় আমদানিকারকদের। ঠিকাদারদের কাছ থেকে লেবাররা ঠিকমত বিল পায়না বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, ভোমরা বন্দরে লেবারদের বিল পরিশোধ নিয়ে এক মুরগি দুইবার জবাই করার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যে কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানিকৃত পণ্য খালাসে লেবারদের ডাকছেন না।
ভোমরা স্থলবন্দরের হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। পণ্য খালাস বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ট্রাক প্রতি লেবার ঠিকাদাররা তাদের বিল দেন ৩৮০ টাকা। প্রায় ৪০ টন পণ্য খালাসে এই টাকা কিছুই না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় শ্রমিকদের। এতদিন ট্রাক প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বকশিস দিতেন ব্যবসায়ীরা। এই বখশিসের টাকা বন্ধ করে দেওয়াতে শ্রমিকেরা গত বৃহস্পতিবার থেকে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের আরেকাংশের সভাপতি পরিতোষ ঘোষ জানান, ভোমরা স্থলবন্দরে ১০ জন করে ১২০টি দল রয়েছে। শ্রমিক হিসেবে সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ জন। পণ্যভেদে ট্রাক প্রতি ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা পায় শ্রমিকরা। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক পণ্য লোড-আনলোড হয়। ফলে বকশিস না পেলে একজন শ্রমিক ৩০০ টাকার বেশি পাবেননা। আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যে টাকা তিনি পাবেন, তা দিয়ে তার সংসারও চলবেনা।স্থলবন্দরের শ্রমিক আলাওল ইসলাম জানান, সারাদিন খেটে-খুটে ৫০০-৬০০ টাকা পাওয়া যায়। এখন শোনা যাচ্ছে, মালিকরা (ব্যবসায়ীরা) বকশিস দেবেনা। তাহলে সংসার চলবে কীভাবে।
ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বলেন, প্রতি টন পণ্য খালাসে প্রায় ৭০ টাকা পরিশোধ করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এরসাথে লেবারদের ট্রাক প্রতি বকশিস দিতে হয় ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে দেড় হাজার টাকা। বাড়তি এই বকশিসের টাকা গোনা সম্ভব নয় বিধায় তারা লেবার ডাকা বন্ধ করে দিয়েছেন। ভোমরা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারি পরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, সরকার নির্ধারিত ৬০ টাকা ২০ পয়সা হারে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর্তন করা হয়। অন্যদিকে টেন্ডারকৃত লেবারদের জন্য পরিশোধ করা হয় ২৭ টাকা ৭৪ পয়সা। কিন্তু এই টাকা লেবাররা পান কিনা তা নিশ্চিত করবেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। ৪০ টনের একটি ট্রাক থেকে লেবারদের পাওয়ার কথা ১ হাজার ৮০ টাকা। অথচ তারা পান মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ভোমরা শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, প্রতিদিন গড়পড়তায় ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। সেই হিসেবে ৫দিনে রাজস্ব ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরণের ঘাটতির মুখে পড়তে হবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে পণ্য খালাস করার জন্য সরকার একজন ঠিকাদার নিয়োগ করেছে। ট্রাক থেকে পণ্য লোড আনলোড করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ লেবার সরবরাহ করতে টন প্রতি ৬৯.২০ টাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। অথচ সেই ঠিকাদার অদ্যাবধি কোনো লেবার নিয়োগ দেয়নি। বরং বন্দরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মাসের পর মাস ওই টাকা তুলে আত্মসাৎ করছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকাস্থ ড্রপ কমনিকেশন কোম্পানী লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান বন্দরে লেবার নিয়োগের ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিল। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী সোহরাব হোসেন গত ৫-৭ মাস পূর্বে সাতক্ষীরার এক জনপ্রতিনিধির ছেলের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। এরপর গত ৩ মার্চ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এক চিঠিতে ব্যবসায়ীদেরকে অবগত করেন যে, ১ এপ্রিল থেকে ডাবল লেবার বিল কার্যকর করা হবে। এ উপলক্ষে গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কৃর্তপক্ষের সচিবের উপস্থিতিতে ও বন্দরের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে একটি কার্যকরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিষয়টি মিমাংসা হওয়া পর্যন্ত ওই আদেশ চালু না করার জন্য সচিব, জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার জন্য লিখিতভাবে অনুরোধ জানান তারা। অথচ কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও উপ-পরিচালক তাদের নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে জোরপূর্বক ডাবল বিল চালু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এটি চালু হলে প্রতি ট্রাকে শুধুমাত্র লেবার সংক্রান্ত ব্যয় হবে ১০ হাজার ৯২০ টাকা। যা বাংলাদেশের আর কোন বন্দরে অদ্যাবধি পরিলক্ষিত হয়নি।
তবে লেবারদের এই বক্তব্য অস্বীকার করে ঠিকাদার মীর তামজিদ হাসান সাংবাদিকদের জানান, লেবারদের প্রাপ্য টাকা যথাযথভাবে দেওয়া হয়।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ১৯৯৬ সালে ভোমরা সুল্ক স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালের ২৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শ্যামনগরে জনসভায় ঘোষণা করেন ভোমরা পূর্ণাঙ্গ স্থল বন্দর হবে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৩ সালের ১৮ মে প্রাক্তন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান ভোমরাকে পূর্ণাঙ্গ স্থল বন্দর ঘোষণা করেন। এই স্থল বন্দরে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক নেতা জানান, এই বন্দর আমাদের প্রাণ। আমরা এখানে কাজ করে পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহ করি। সম্প্রতি বন্দর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের অনিয়মের জন্য ব্যবসায়ীদের সাথে ঝামেলা হওয়ায় তারা আমাদের কাজে না ডাকায় ৪টি শ্রমিক সংগঠনের প্রায় ৫ হাজারের অধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এভাবে কাজ বন্ধ থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। তাই বন্দরটি রক্ষার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বিষয়টি সম্পর্কে ভোমরা স্থলবন্দর আমদানী ও রপ্তানীকারক এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: আবু হাসান জানান, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরটি বাংলাদেশে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই বন্দর থেকে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা আয় করে থাকে। অথচ ব্যবসায়ী হয়েও শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছি না।
তিনি আরও জানান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাসের জন্য আমাদের লেবার সরবরাহ না করে বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আমরা আমদানীকারকগণ বাইরের লেবার সংগ্রহ করে ট্রাক প্রতি দুই হাজার টাকা দিয়ে পণ্য খালাস করাচ্ছি। ফলে পণ্য খালাসে আমারা দুই বার লেবার বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছি। বিভিন্ন সময়ে এর প্রতিবাদ করেও কোন প্রতিকার পাইনি। সম্প্রতি এই বন্দরটির দিকে শকুনের চোখ পড়ায় কঠিন সংকটের মধ্যে অবস্থান করছে। তাদের হাত থেকে বন্দরকে বাঁচানোর স্বার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। এ বিষয়ে জানান জন্য ভোমরা স্থল বন্দরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলামের সেল ফোনে একাধিক বার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আলোকিত প্রতিদিন/ ৬ এপ্রিল, ২০২১/ দ ম দ