নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রায় ছ’বছর আগের কথা,এখনো কত প্রাণবন্ত হয়ে আছে হৃদয়পটে। বাতাসে ভেসে আসছে আসরের আজানের ধ্বনি। আমি ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড ধরে হাঁটছি। রাস্তায় প্রচন্ড রকমের জ্যাম,গরমে গা গেমে শার্ট পর্যন্ত ভিজে গেছে। সংসদ ভবনের সামনে আসতেই ফোন ভেজে উঠলো। সাতাশির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেনের ফোন- কোথায় আছেন ইমরান?
আমিতো শ্যামলী চলে আসছি। আমি হাঁপাচ্ছি আর বলছি,দয়া করে আর ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেন আমি কাছাকাছি চলে আসছি। আমি পৌঁছে দেখি তিনি শামসুজ্জামান খানের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। দু’জন একসঙ্গে গেলাম শামসুজ্জামান খানের বাসায়।উদ্দেশ্য ছিল আমার লেখা ‘ শহীদ নূর হোসেন এক জীবন্ত পোস্টার’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে দাওয়াত নিয়ে যাওয়া। তখন তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। এত বড় মাপের একজন মানুষ আমাদের অবাক করে দিয়ে নিজেই দরজা খুললেন। দুজনেই তাঁর পা ছুয়ে সালাম করলাম। এতো কাছ থেকে সেদিনই তাঁকে প্রথম দেখা। গণভবনের স্টাফ হওয়ায় আলী হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে আগেই পরিচিত ছিলেন। আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলে আলী হোসেন ভাই তাঁর হাতে আমার লেখা বইটা দিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
হাতে নিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখে মুগ্ধ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটি তোমার লেখা!ভালো একটি কাজ করেছো।তোমার মত বাচ্চা ছেলে এই কাজ করতে গিয়ে নিচ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে? আমি হাসিমাখা মুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সাথে যোগ করলেন আলী হোসেন ভাই,ছেলেটা অনেক কষ্ট করে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে বইটি লিখেছে। এখন আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করতে চাই।তারপর যা ঘটলো তা ছিল অবিশ্বাস্য! যাকে বলে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তিনি বললেন একাজের মূল্যায়ন আমরা করবো। আমার দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন তুমি একদিন অফিসে এসো সঙ্গে কয়েক কপি বই নিয়ে আইসো। স্যারের সঙ্গে প্রায় আধাঘন্টার কথাবার্তা ছিল সেদিন।সহজ সরল কথা শুনে মনে হচ্ছিলো এজন্যই হয়তো তিনি এত বড় হতে পেরেছেন। জ্যাম ঠেলে যেতে অনেক কষ্ট হলেও সেদিন স্যারের বাসায় চা- নাস্তা সেরে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বিদায় নিলাম। কথামতো একদিন গেলাম বাংলা একাডেমিতে। নাম বলতেই পারমিশন মিললো তাঁর কক্ষে প্রবেশের। সালাম দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতেই কক্ষে বসা অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন আমার বই কিনতে।তিন জন কর্মকর্তা সেখানেই টাকা দিয়ে অটোগ্রাফ সহ বই নিয়েছেন যাতে আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু শামসুজ্জামান স্যার বললেন বই লিখেছে তারা বই কিনবে এতে লজ্জা কিসের।
সেদিন কবি পিয়াস মজিদ সহ আরো তিনজন কর্মকর্তা আমার বই কিনেছিলেন। উনার মত বাংলাসাহিত্যের একজন পুরোধাব্যক্তিত্ব আমার মত নগন্য নতুন একজন লেখককে এভাবে কাছে টেনে নিবেন তা আমি কখনো ভাবতেও পারিনি। সেদিনের ঘটনা আমি জীবনেও ভুলবনা।’ শহীদ নূর হোসেন এক জীবন্ত পোস্টার ‘ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান অডিটোরিয়াম ফ্রিবুক করে দিলেন।তিনি নিজেই অতিথিদের দাওয়াত দিলেন এবং আমার অনুরোধে অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন বলে কথা দিলেন।এত সহজে বড় কিছু পেয়ে যাবো কল্পনা করিনি। হয়তো শামসুজ্জামান খান বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল। সেদিন তিনি আমাকে যে কথা গুলো বলেছিলেন তা আমার সারাজীবনের চলার পাথেয় হয়ে থাকবে।তিনি বলেছিলেন -‘ জীবনে কাউকে অতি ভক্তি করবেনা,কারো কাছে নিজেকে বিক্রি করবেনা,আর ভালো লিখতে হলে অনেক বেশি পড়তে হবে।’ বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় সিটি আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত তাঁর লেখা বই’ রাষ্ট্র ধর্ম সংস্কৃতি ‘বইটি অটোগ্রাফ সহ আমাকে উপহার দিলেন এবং বললেন, যাবার সময় তোমার তিন কপি বই বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে দিয়ে যাবা।আমি কিনে রাখতে বলে দিচ্ছি।
শামসুজ্জামান খানের মত এমন মহান ব্যাক্তিত্বের কথা বলে বা লিখে প্রকাশ করার মত ভাষা আমার জানা নেই। শুধু ভালো মনের অধিকারীই ছিলেননা। বাংলাসাহিত্য সংস্কৃতির জন্য বিলিয়ে গেছেন তাঁর পুরো জীবন। রেখে গেছেন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার মত অসংখ্য কাজ।বাংলা সাহিত্যের দিকপাল,বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির প্রণম্য গবেষক পহেলা বৈশাখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি হারালো একজন যোগ্য অবিভাবক। শামসুজ্জামান খান স্যারের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় একুশে বইমেলা ২০২০ এ, যখন শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা আমার দ্বিতীয় বই ‘ বিপ্লবী নূর হোসেন ‘ স্যারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।শেষ দেখা সেই মুচকি হাসির মুখ খানি এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আমার চোখের সামনে।স্যার, শেকড়লগ্ন সংস্কৃতি চর্চায় আপনার অবদানের কথা আমরা ভুলিবো কেমনে। আপনি বেঁচে থাকবেন যুগের পর যুগ আপনার কর্মগুণের মধ্যে।
–ইমরান আকন্দ, লেখক ও গবেষক।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১৬ এপ্রিল, ২০২১/ দুখু