কোভিড পরিস্থিতি আমি যেভাবে মোকাবেলা করেছি । ডা. মো. আহাদ হোসেন

0
324

কোভিড পরিস্থিতি আমি যেভাবে মোকাবেলা করেছি
ডা. মো. আহাদ হোসেন

 

আমি যেহেতু কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কাজ করছি সে কারণে কোভিড চিকিৎসা নিয়ে অনেক কথা বলার সুযোগ হয়েছে এবং এখনো রোগী দেখে যাচ্ছি। কিন্তু আমি নিজে কোভিড আক্রান্ত হবো এ বিষয়টি একটু ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা।

ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করিনি যে কোভিড আক্রান্ত হবো না। কিন্তু সর্তকতা মেনে চলেছি শুরু থেকেই। তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে প্রথম এক মাস যে ধরনের সর্তকতা বজায় রেখেছি পরবর্তী মাসে সর্তকতাটা একটু কমে গিয়েছিল। যেমন- মাস্ক ব্যবহারে একটু দুর্বলতা প্রদর্শন করেছি। চেম্বারে রোগী দেখেছি বা কারো সাথে ছবি তোলার ক্ষেত্রে মাস্ক খুলেছি। দুই একটা সামাজিক প্রোগ্রামে দাওয়াত খেতে গিয়েছি। যদিও সেখানে মাস্ক পরে গিয়েছি তার পরেও কিছু সময় মাস্ক খুলে নিতে হয়েছে। এ সকল ঘটনাবলীর কোনো একটি থেকেই আমি কোভিড আক্রান্ত হয়েছি বলে মনে করছি।

আক্রান্ত হয়েছি কীভাবে বুঝলাম :
আমি আক্রান্ত যেদিন হয়েছি সেদিন কিছু রোগী দেখছিলাম। রোগী দেখা শেষে সন্ধ্যার দিকে আমার মনে হলো একটু জ্বর জ্বর। একটু খারাপ লাগে। এই অনুভূতি থেকে আমি পরদিন সকালে কোভিড টেস্ট করাতে গেলাম, কোভিড টেস্ট দিয়ে এসে সরাসরি একটি আলাদা রুমে ঢুকে পড়লাম এবং পুরোপুরি আইসোলেশনে চলে গেলাম। টেস্টের রেজাল্ট হাতে পেলাম ওই দিন সন্ধ্যায়। যে কারণে এরপরে টানা ১৬ দিন আমি আইসোলেটেড রুমে থেকেছি। যে কারণে আমার পরিবারের অন্য কেউ আলহামদুলিল্লাহ আক্রান্ত হয়নি। আমার পরিবারে আমার বৃদ্ধ মা আছে, আমার স্ত্রী ও তিনজন ছেলে-মেয়ে রয়েছে।

পজিটিভ রেজাল্ট হাতে পেয়ে কী কী করলাম :
পজিটিভ রেজাল্ট হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই আমি কিছু প্রাথমিক ওষুধ সংগ্রহ করলাম যেগুলো আমাদের সমাজের সবাই সংগ্রহ করেন। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী কোনো ওষুধ সেবন করিনি। আমার প্রথম দিকেই লক্ষণ ছিলো জ্বর যা দুই দিন পর্যন্ত ছিলো। হালকা কাশি যেটি তিন-চার দিন পর্যন্ত ছিলো। এছাড়া পাল্স অক্সিমিটারে আমার হার্টের গতি ১০০ এর উপরে ছিলো। কিন্তু অক্সিজেনের মাত্রা ৯৬ থেকে ৯৮ এর মধ্যে ছিলো। এ কারণে আমি যে কাজটি করেছি বারবার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করেছি যে বিষয় নিয়ে আমি নিজেই লেখেছি। ৪ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিয়েছি ৪ সেকেন্ড ধরে রেখেছি আবার ৪ সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছেড়েছি এরপর ৪ সেকেন্ড ধরে রেখেছি আবার শ্বাস নেয়া শুরু করেছি। এভাবে প্রক্রিয়াটি দিনে পাঁচ থেকে সাত বার করেছি ৫ থেকে ৭ মিনিট ধরে করেছি। তাতে করে আমার হার্টের গতি কিছুটা কমে এসেছে। একই সাথে আমার মানসিক অবস্থা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।

আক্রান্ত হওয়ার পরে কী কী খাবার খেলাম :
আক্রান্ত হওয়ার পরে স্বাভাবিক খাবার খেয়েছি। তবে এর সাথে আমি চিনি ছাড়া রঙ চা, স্যুপ এগুলো মাঝে মাঝেই খেয়েছি। দুই-তিন দিন পরে খাবারের স্বাদে কিছুটা পরিবর্তন হলো। মনে হচ্ছিলো খাবার খুব একটা ভালো লাগে না। তখন স্যুপ খাবারটি খুব বেশি খেয়েছি। কিছু ফলমূল খেয়েছি। আমি সাধারণত ভাত খাই না তবে সকাল বেলা শুধু রুটি অথবা খিচুড়ি মাঝে মাঝে খেয়েছি। দুপুরে সালাদ, মাছ অথবা মাংস অথবা ডিম খেয়েছি। রাতে শুধুমাত্র স্যুপ ও রং চা খেয়েছি। বিকালে চিনি ছাড়া চা, ফল। সারাদিন বাসায় শুয়ে না থেকে মাঝে মাঝে হাঁটাহাটি করেছি ঘরের মধ্যেই। তবে প্রথম পাঁচ দিন আমি রুমের মধ্যেও মাস্ক ব্যবহার করেছি যাতে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে ভাইরাস সরাসরি রুমের ভেতরে ছড়িয়ে না পড়ে এবং রুমের বাইরে যেতে পারে। আমি বাথরুমে গেলে বাথরুম শেষ করে কমোডটি ঢেকে রেখে তারপরে ফ্লাশ দিয়েছি যাতে ফ্লাশ দেওয়ার সময় কোনো ভাইরাস বাথরুমের ভেতরে ছড়িয়ে না পড়ে।

নিয়মিত হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করেছি। সাবান এবং শ্যাম্পু যথারীতি ব্যবহার করেছি। নিজের ব্যবহৃত কাপড় একদিন পরপর নিজেই পানিতে ভিজিয়ে ধুয়ে নিয়েছি। নিজেই রুমের  ফ্লোর ব্লিচিং পানি দিয়ে মুছে নিয়েছি। এভাবে সাত দিন পরে আমার কোনো লক্ষণ ছিলো না। শুধুমাত্র গলা বসা ছিলো। সেজন্য আমি নিয়মিত চিনি ছাড়া রঙ চা এবং গরম স্যুপ খেয়েছি।

কখন পরবর্তী পরীক্ষা করেছি :
আমি ১২তম দিনে আরেকবার কোভিড পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দিলাম। কিন্তু আমার ফলাফলটি আবারো পজিটিভ আসলো। তারপর আমি যথারিতি মাস্ক ব্যবহার করে বাহিরে গিয়েছি খুবই প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য। এরপর ১৯তম দিনে আমার আবার পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দিলাম। তাতে আমার ফলাফল নেগেটিভ আসলো।

কোভিড আক্রান্ত হওয়া নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ :
১. লক্ষণ প্রকাশ হওয়া মাত্রই কোভিড টেস্ট করাতে হবে। তাহলে এই রোগের গুরুতর অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
২. যত দ্রুত সম্ভব আলাদা একটি রুমে অবস্থান করতে হবে লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথেই। এক্ষেত্রে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করাই উত্তম।
৩. মৃদু লক্ষণ থাকা অবস্থায়ই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নিতে হবে।
৪. মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে।
৫. আমাদের দেশে কিছু জায়গায় কখনোই স্বাস্থ্যবিধি পূর্ণরূপে মানা হয়নি বরং এসব জায়গায় আমাদের উৎশৃংখল আচরণই মূলত এই কোভিড বিস্তারের মূল কারণ। তার মধ্যে অন্যতম জায়গা হচ্ছে কাঁচা বাজার, মাছ ও মাংসের বাজার, খাবার হোটেল, মার্কেট ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনার জায়গা। এসব জায়গায় চলাচলের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে মাস্ক পরে এবং দেড় হাত দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
৬. ভ্যাকসিন নিলে সাথে সাথেই আপনি নিরাপদ থাকবেন না। ভ্যাকসিন কার্যকরী হতে ন্যূনতম তিন মাস সময় লাগে। যে কারণে ভ্যাকসিন নিলেও আপনাকে পূর্ণ স্বাস্থ্য বিধি মেনে তিন মাস সতর্ক থাকতে হবে।
৭. বাড়ির বাইরে বের হলে মাস্ক পরে বের হবেন এবং কোনো ক্রমেই খোলা যাবে না। প্রয়োজনে বাহিরের খাবার পরিহার করতে হবে। অফিসে থাকাকালীন বাসার খাবারটি খুবই সন্তর্পনে খেয়ে নিতে হবে।
৮.  সকল ধরনের কোলাহল ও লোক সমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ আমরা কেউই জানি না কার মাধ্যমে এই ভাইরাসটি আমার শরীরে ঢুকে যেতে পারে।
৯.  দীর্ঘ সময় যে পোশাক পরে বাহিরে অবস্থান করবো সেটি বাসায় এসে ধুয়ে ফেলবো অথবা তিন দিন প্যাকেট বদ্ধ করে রেখে দিবো। তিন দিন পরে আবার সেই পোশাকটি পরতে পারবো।
১০.  আমাদের যাদের অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এবং ক্যান্সারজাতীয় সমস্যা তাদের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। চলমান সকল ধরনের ওষুধ নিয়মিত খেতে হবে যাতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে না যায়। লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথেই পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে যাতে এই রোগটি গভীর হতে না পারে।
১১.  বাসায় ন্যূনতম একটি পাল্স অক্সিমিটার এই মুহূর্তে সবার জন্য জরুরী। এটি দিয়ে আপনার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করতে পারবেন।

(লেখক : কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
চেম্বার : বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, কাঁটাবন, ঢাকা। )

আলোকিত প্রতিদিন/১৯ এপ্রিল-২০২১/জেডএন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here