কে হচ্ছেন রাবি’র পরবর্তী উপাচার্য ?

0
299

প্রতিনিধি, রাজশাহী :
তিন সপ্তাহ ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য পদটি ফাঁকা রয়েছে। এতে করে ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম। ইতোমধ্যেই উপাচার্যের দৈনন্দিন রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসজুড় সমালোচনার ঝড় বইছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে একজন ‘যোগ্য উপাচার্য’ নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের মেয়াদ শেষ হয় গত ৬ মে। শেষ দিনে তিনি ১৩৮ জনকে এডহকে নিয়োগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহাকে উপাচার্যের দৈননিন্দন রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় উচ্চ শিক্ষা শাখা থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তার পর থেকেই উপাচার্য’র রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। উপাচার্যের দৌঁড়ে রয়েছেন যারা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দৌড়ে অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম প্রথমে রয়েছে। নিচে সেই তালিকা দেওয়া হলো : অধ্যাপক রকীব আহমেদ : ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক এখন অবসর পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসরে যাবেন আগামী ৩০ জুন। এই অধ্যাপক সদ্য বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ঘনিষ্ঠ বলেই ক্যাম্পাসে পরিচিত। অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান প্রথম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) উপাচার্য থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইইএস) পরিচালক করেছিলেন রকীব আহমেদকে। অনেকটা ক্লিন ইমেজের হওয়ায় ওই সময় আরও বেশ কয়েকটি দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার জন্য বেশ দৌঁড়ঝাপ করেছিলেন অধ্যাপক রকীব আহমেদ। কিন্তু ওই সময় তিনি সেই দায়িত্ব পাননি। তখন আবদুস সোবহানকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রকীব আহমেদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক ছিলেন। উপাচার্য না হতে পেরে তিনি জার্মানিতে চলে যান। পরে দেশে ফিরে আসলে সদ্য বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাকে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের দায়িত্ব দেন। তিনি উপাচার্যের একনিষ্ঠ হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দি ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাহায়ালপুরের ভূগোল বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়া তিনি বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী অধ্যাপক রকীব আহমেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার দৌঁড়ে বেশ এগিয়ে রয়েছেন বলে ক্যাম্পাসজুড়ে বেশ চাউর হচ্ছে। অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান : প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলেন। ১৯৯৬ সালে জাপানের ওকাইমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজির ওপর পিএইচডি করেন।ক্লিন ইমেজধারী এই অধ্যাপকের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ডা. ইয়াসিন আলীর হাত ধরেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আওয়ামী লীগের উত্থান হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. ইয়াসিন আলী ইতোপূর্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-০২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসন থেকে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে একবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমানের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. ইয়াসিন আলী গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের অসংখ্যবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং তার নেতৃত্বেই ওই এলাকায় তিনি দলকে সুসংঘটিত করেছিলেন। তার আপন দুই চাচাও বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে জানা গেছে। এই অধ্যাপকের পারিবারিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমানের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. ইয়াসিন আলীর সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। তিনি যেই কমিটিতে গোমস্তাপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আমি সেই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ডা. ইয়াসিনের অনেকটা পারিবারিকভাবে সম্পর্ক ছিলো।’ অধ্যাপক জিনাত আরা : বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এই অধ্যাপক বিভাগটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডিন ছিলেন। তার বাবা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। জিনাত আরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান : ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান এর আগে (২০১৩-২০১৭) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডীন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা এবং ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন প্রায় ৩৪ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গত বছর পর্যন্ত ৫০ জন বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়, সেখানে তার নাম উঠে এসেছে ৪৩ নম্বরে। তবে এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ঢাকাস্থ অতিথি ভবনের জন্য জমি ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অধ্যাপক এম. শহীদুল্লাহ : ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ। উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের সময় তিনি ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজ-এর পরিচালকের দায়িত্বে পান। এখনো সেই দায়িত্বে রয়েছেন। আবদুস সোবহানের আগের মেয়াদে তিনি ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) এর পরিচালক ছিলেন। তিনি এক সময় প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক এবং রাবির কলা অনুষদের ডীন ছিলেন। অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম : বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক রাজশাহী জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম ২০১৯ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্ডিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ২০২০ সাল থেকে তিনি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য রয়েছেন। অধ্যাপক শফিকুন্নবী সামাদী : বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক ছিলেন। সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাকে আন্দোলনে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। আওয়ামীপন্থী দলীয় শিক্ষকদের স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি কনভেনিং কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক ছিলেন। এই দায়িত্ব পালনকালে হ্যাপেক প্রকল্পের টাকায় ১১ হাজার টাকায় দুটি কলম কিনে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন।তার বিরুদ্ধে হ্যাকেপ প্রকল্প নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আরও রয়েছেন বর্তমান উপ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা, ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদুজ্জামান মিলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তাই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করার একটি বিধান রাখা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রক্রিয়ায় আর উপাচার্য নিয়োগ হয় না। এখানে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী আচার্য (মহামান্য রাষ্ট্রপতি) উপাচার্য নিয়োগ দেন। ২২ বছর ধরে চলছে এই প্রক্রিয়া। ফলে উপাচার্য হওয়ার জন্য আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। প্রগতিশীল কয়েকজন শিক্ষক জানান, এবার উপাচার্য হিসেবে যিনি নিয়োগ পাবেন, তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। উপাচার্যে র কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই সরকারকে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া উচিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন একজন উপাচার্য প্রয়োজন, যিনি যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বদ্যালয়ের একাডেমিক ও গবেষণার মান সমুন্নত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রক্ষায় যিনি সকল চাপ উপেক্ষা করতে পারবেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, নতুন উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে গভীরভাবে অবশ্যই ভাবতে হবে। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক আদর্শ বিবেচনা করে এবং সেই সাথে দক্ষ প্রফেসর, একাডেমিকভাবে বোদ্ধা এবং পাণ্ডিত্য যার মধ্যে থাকবে এমন একজনকে আমরা উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, এমন কাউকে উপাচার্য করা মোটেও যুক্তিযুক্ত হবে না। প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য গত ৬ মে উপ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আলোকিত প্রতিদিন/২৮ মে, ২০২১/ দ ম দ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here