স্টাফ রিপোর্টারঃ সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে করোনার মধ্যেও প্রায় আড়াই হাজার শিশুশিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে অবস্থিত কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। দেশে করোনায় মৃত্যুর মিছিলের শুরুতেই প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। তবে সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে আমলে নেয়নি মিশনারি সংস্থা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ও তাদের পরিচালিত কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। গত দেড় বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি খোলা রেখে চালানো হচ্ছে একাডেমিক ও শিক্ষা কার্যক্রম। দীর্ঘ এই সময়ে একবারের জন্যেও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এজন্য অবশ্যই কৌশলী হতে হয়েছে কোয়ান্টাম কর্তৃপক্ষ’কে। সম্পূর্ণ আবাসিকভাবে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে এতিমখানা ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেওয়া হলেও আবাসিক এতিমখানার কোন কিছুই নেই কোয়ান্টামে। আর এই অনুমতিকে ব্যবহার করেই চলছে পাঠদান কার্যক্রম,তবে শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনা এড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। গত ৭ জুন মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ষষ্ঠ শ্রেণির দুই শিশু শিক্ষার্থী শ্রেয় মোস্তাফিজ (১১) ও আব্দুল কাদের জিলানী (১২)। স্কুলের অদূরেই একটি খালে ভাসমান অবস্থায় এই দুই শিক্ষার্থীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। এই ঘটনায় লামায় থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন নিহত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। সেই মামলায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ, কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং স্কুলের আবাসিকের পরিচালকদের’কে আসামি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরোপুরি আবাসিকে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে আড়াই হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। যার ৫৫ শতাংশ উপজাতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ৪৫ শতাংশ দেশের উত্তর বঙ্গের মঙ্গা-পীড়িত এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শিশু।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসাইন জানান, মূলত দুস্থ, দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরাই এখানে বিনা খরচে পড়াশোনা করছে। এদের কারো মা নেই, কারো বাবা নেই। আবার অনেকের বাবা-মা দুই জনই নেই- এমনটাই দাবি কোয়ান্টামের এই পরিচালকের। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কিছু শিক্ষক ও অভিভাবক বলেন, এতিম বা অসহায় একটা লেবাস মাত্র নামে বেনামে অবৈধভাবে সাধারণ মানুষের যে সম্পদ দখল করেছে তা জায়েজ করতে বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলা থেকে কিছু সংখ্যক উপজাতি ও বাঙালি এতিম শিক্ষার্থী রাখা হলেও ২ হাজারের ও বেশি শিক্ষার্থী আবাসিকের যাদের মাসিক বেতন, থাকা খাওয়াসহ ৭- ৮ হাজার টাকা করে। আবার বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদান তো রয়েছে সবমিলিয়ে করোনার মধ্যে মাসিক বিশাল অংকের দূর্নীতি করে যাচ্ছে কোয়ান্টাম নামের এই প্রতিষ্ঠান। এমন কি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে মাসিক খরচ পাঠিয় সব কিছু ম্যানেজ করেন কয়েকজন স্টাফ তাদের মধ্যে অন্যতম, সেন্টারে পারভেজ, এড আরিফ, বান্দরবানে ফয়সাল আজিজসহ আরও অনেকে। করোনার মহামারিতে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলে এই প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাদের অতি লোভনীয় অফার দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি খোলা রাখতে প্রথমে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে জানানো হয়, এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়, শিক্ষা বোর্ডের হাতে নেই। পরে এতিমখানার কথা বলে উৎকোচদান সাপেক্ষে আবাসিক কার্যক্রম চালু রাখার আবেদন করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার অনুমতি দেয়। সেই থেকেই দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৮ মাসের কার্যক্রম এখনও চালু রেখেছেন প্রতিষ্ঠানটি।
কোয়ান্টামের চট্টগ্রাম অঞ্চলের এই পরিচালকের ভাষ্যমতে, গত ৭ জুন কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিশুরা প্রতিদিনের ন্যায় এদিন সকালেও ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পিটি ক্লাস শেষ করে। এরপর নাস্তা এবং পাঠ শেষে খেলাধুলায় মেতে উঠে। ওদিন ভারি বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির সময় আবসিকের কিছু ছাত্র নতুন ক্যাম্পাসের জিমনেসিয়াম ভবনের পেছনে নালায় বাঁধ দিয়ে পানি নিষ্কাশনে বসানো পাইপের মুখ ঠিক আছে কিনা দেখতে যায়। সেখান থেকে ফের ওই পাইপে পানি প্রবেশ পথ দেখতে গিয়ে পাহাড়ির ঢলের সৃষ্টি ঘূর্ণিতে পড়ে ওই পাইপের ভেতরে ঢুকে যায়। পরে সেখানেই শ্রেয় মোস্তাফিজুর রহমান এবং আব্দুল কাদের জিলানী মৃত্যু হয়। এদের একজনের বাড়ি ঠাকুরগাঁও। অপরজনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। পড়াশোনার জন্য এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় তারা।
তবে স্থানীয়রা জানায়, ওইদিন বেলা সাড়ে এগারোটার সময় কোয়ান্টামের অদূরের ঢেঁকিছড়া খালে ভাসমান অবস্থায় এই দুই শিশু শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয় জনতা। পরে কোয়ান্টাম কতৃপক্ষের লোকজন বাচ্চা দুটির লাশ সরই পুলিশ ক্যাম্পের অগোচরে পাশ্ববর্তী উপজেলার লোহাগাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানান আরোও ৫ থেকে ৭ ঘন্টা আগে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ২ ছাত্রের মৃত্যুর বিষয়ে ৭জুন লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও রেজা রশিদ ও লামা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন এবিষয়ে কোয়ান্টাম কতৃপক্ষ এখনো আমাদের কাছে কিছুই জানায়নি। তবে নিয়ম অনুযায়ী অত্র উপজেলায় দূর্ঘটনাজনিত কারণে কেউ মারা গেলে আগে পুলিশ প্রশাসন লাশ উদ্ধার করে জেলা হাসপাতালে লাশ পোস্টমটেম করবে এর পর অভিভাবকদের হাতে হস্তান্তর করে।
করোনার এই মহামারির সময়ে ক্যাম্পাস কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, যেহেতু তারা বললো, এটা একটা আশ্রম, সেখানে সরকারি নির্দেশের বাহিরে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের বলেন, নিষিদ্ধ এই সময়ে ক্যাম্পাস কার্যক্রম চালু রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১৩ জুন, ২০২১/