পানযোগ্য এক অঞ্জলি পানি চাই…

0
586

:: মোস্তফা কামাল ::
‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউ চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো…’। না, নীল জল বা দিগন্তের কোনো গান সম্পর্কে বলছি না। নীল জল মানুষের জীবনে কীভাবে অভিশাপ বয়ে আনে সে গল্প বলবো। আর জীবনে দিগন্ত ছুঁতে না পারলেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হৃদয়ের আকুতি কিছুটা অনুভব করেছি। বিস্তৃর্ণ জলরাশি কিন্তু পান করার মতো কোনো পানি নেই। বৃদ্ধ নারী-পুরুষ ও শিশুরা তাকিয়ে থাকে কখন বৃষ্টি আসবে তার দিকে। আবার বৃষ্টি আসলেও সমস্যা। একটা ঘরও নেই যে, সেখানে আশ্রায় নিবে। আর দু’মুঠো অন্ন তো অনেক বড় বিষয়। এসব কিছু দেখতে দেখতে আমার চোখ স্থীর হয়ে গেল এক অশীতিপর বৃদ্ধকে দেখে, যিনি আকাশের দিকে দু’হাত তুলে কী যেন বলছেন। ভাবলাম কোনো পাগল হবে। কিন্তু কাছে যেতেই ধারণা পাল্টে গেল। অশীতিপর বৃদ্ধটি মহান মাবুদের কাছে খাবার পানি, থাকবার জন্য নিরাপদ আশ্রয় চাইছে। জীর্ণ শরীরে কিবা করার আছে তার। গায়ে জোর নেই, না খেতে পেরে শরীরের হাঁড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যখন মানুষের কোনো কিছু করার থাকে না তখন নাকি সাক্ষাতে যা পায় তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। আমাদের পেয়ে সে আকুতিটাই করলো কিছুই চাই না, বাঁধ ঠিক করে দাও। কিন্তু আমরাতো সামান্য মানুষ, কী বা করার আছে। মানুষ কখন অসহায় বোধ করে তা ঠিক আমার জানা নাই। তবে বোধ হয়, প্রিয় মানুষের চাওয়া পূরণ করতে না পারাটাই মানুষকে বেশি অসহায়ত্ব করে তোলে। এই বৃদ্ধ মানুষের আকুতি সেটাই জানান দিলো।

আমি আজ এক বিপন্ন জনপদ প্রতাব নগর- সাতক্ষীরার কথা বলছি। এ অঞ্চলের মানুষগুলো সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কামার-কুমার, জেলে, কৃষক বিভিন্ন পেশার মানুষ একত্রে সুখে-দঃখে বসবাস করে আসছে যুগের পর যুগ। কোনো অভাব নেই, অভিযোগও নেই তাদের। কৃষি কাজ যিনি করেন, কৃষি কাজ করেই তিনি কোনোভাবে তার সংসার নির্বাহ করেন। আবার যিনি জেলে, নদীতে মাছ ধরে সুখেই তার সংসার চলাতে থাকেন। যিনি মাছের ব্যবসা করেন, তিনিও ভালোভাবেই দিনাতিপাত করতে থাকেন। কারো কোনো সমস্যা হলে সবাই মিলে সাহায্য সহযোগিতা করে সমাধান করার চেষ্টা করতো এ এলাকার মানুষ। সেই সাথে প্রাকৃতিক কোনো দূর্যোগ আসলে সকলকে সুরক্ষিত রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতো এরা নিজেরাই। ‘ঘুর্ণি ঝড়, আইলার পরে এখানকার জন-জীবনে নেমে এলো এক অভিশাপ। মিষ্টি পানির পুকুর হলো লোনা পানি। ফসলভরা মাঠে লোনা পানির অথৈই সাগর। সব কিছু পানিতে একাকার হয়ে গেল, লন্ডভন্ড হয়ে গেল ধানের জমি, ঘের, পুকুর, মানুষের ঘর-বাড়ি, নদীর বেড়ি বাঁধ। এত বড় ঘুর্ণিঝড় ওই অঞ্চলের মানুষ আগে কখনো দেখেনি’ -এমন কথাও শুনেছি প্রতাব নগরের স্থানীয় বাসিন্দা সত্তর উর্ধো দাউদ আলীর কাছে। এ অঞ্চলের সমস্ত পানীয় জলের উৎস্য নষ্ট হয়ে যায়। ফসলের জমিও পানিতে তলিয়ে যায়। একটা ঘরও বসবাস করার উপযোগী ছিলো না। এসব ক্ষতির পর মানুষ কয়েক মাসের মধ্যে নিজেদের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এবং অনেকাংশে সফলও হয়। কিন্তু কতই বা পারবে দাউদ আলীর মতো বৃদ্ধ, যার হাত দু’টোই সম্বল। আকাশের পানে হাত উঠানো ছাড়া আর কী বা করার আছে তার।

ফনি, বুলবুল, নার্গিস, আম্ফান, ইয়াসের মতো বড় বড় ঘুর্ণি ঝড়ে নির্মানাধীন ঘর যদি বারবার ভেঙে যায়, ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমনই হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের। আবার শব্দটি তিন বার বলতেও কষ্ট লাগে। কিন্তু বারবার ভেঙেছে এ অঞ্চলের মানুয়ের স্বপ্ন। তারা আবার স্বপ্ন দেখে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বছর যেতে না যেতেই নদী ভাঙনে হারাতে হয় সুখের স্বপ্ননীড়। ক্লান্ত পথিক অনেকটা পথ হাঁটার পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে, কিন্তু এখানে পথিকের বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই। অনেকেই ভাবছেন এতো কষ্ট করে এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। অন্যত্রে চলে গেলে তো হয়। সহজেই কি আর সেটা সম্ভব? এখানেই রয়েছে বাপ-দাদার পৈত্রিক নিবাস। শৈশবের কতই না স্মৃতি। এই স্মৃতি টুকুই মানুষকে আগলে রেখেছে। শত কষ্টের পরেও বাপ-দাদার ভিটা-মাটিটুকু ছাড়তে রাজি নয়। আর যাবে বা কোথায়? অনিশ্চিত গন্তব্য শুভ নাও হতে পারে। তাই আগলে আছে এখানে তার প্রিয় জন্মভূমির মাটিকে। স্বপ্ন দেখে আবার সেই সুখের জনপদের। স্বপ্ন দেখে আবার বেড়িবাঁধ হবে, সবুজে ভরে উঠবে ফসলের মাঠ, পাখির কলোকাকলি আর মেঠো পথে ভরে যাবে নাম না জানা নানা পত্র-পল্লবে। পাবে কাজলা দিঘির টলটলা পানির অবগাহন। থাকবে না লোনা পানির অভিশাপ। নির্মল বাতাসে ভরে যাবে আনন্দের প্রতিটি ক্ষণ। কিন্তু দাউদ আলীর স্বপ্নের আমরা কি কোনো মূল্য দিতে পেরেছি? দাউদ আলীর স্বপ্ন না হয় স্বপ্নই থেকে যাবে। কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মের- যারা কেবল স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এভাবে কি প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে যাবে?

ষাটের দশকে নাকি এ অঞ্চলে বেড়িবাঁধ হয়েছিলো। তখন ছিলো পাকিস্তান আমল। এখন তো উন্নয়ণশীল বাংলাদেশ। এ দেশে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে, তাতে থাকে শত কোটি টাকার বাজেট। কাদের জন্য এতো বড় বড় প্রকল্প, যদি এক গ্লাস সুপেয় পানি না পাওয়া যায়? সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে না ওঠে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ? বড় বড় প্রজেক্টের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আমার বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের জন্য ফ্রেশ এক অঞ্জলি পানি। তাই এ অঞ্চলের মানুষের একটাই দাবি- ‘ত্রাণ চাই না, চাই টেকশই বাঁধ নির্মাণ’।

 

আলোকিত প্রতিদিন/জেডএন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here