অপরাজিতা
নম্রতা সাহা
আজ কেন যে এত ঘুম পাচ্ছে, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না রোহিণী । যতই সে তাকানোর চেষ্টা করছে,ততই যেন তার দুচোখের পাতা বুজে আসছে । এদিকে ক্লাসটা শেষ হতে আরও পনের-কুড়ি মিনিট বাকি । ম্যাম যে কী পড়াচ্ছেন তা কিছুই বুঝতে পারছে না রোহিণী । হঠাৎ করে ম্যাম ক্লাসের একেবারে লাস্ট বেঞ্চে বসা রোহিণীকে বললেন – “কাকে ‘প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার’ বলা হয়?” প্রশ্নটা শুনে রোহিণী তো একেবারে আকাশ থেকে পড়ল । সে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে । ক্লাসের বাকি সব মেয়েরা তো উত্তর বলার জন্য উদগ্রীব । রোহিণীকে চুপ থাকতে দেখে ইতিহাস ম্যাম এবার রেগে আগুন – “ এই সোজা প্রশ্নের উত্তরটাও তুমি দিতে পারবে না ? আমি তো এটা পড়াতে পড়াতে এইমাত্র বললাম । তাহলে ক্লাসে বসে আমার পড়ানো না শুনে তুমি কী করছিলে ? দেখে তো মনে হচ্ছে এক্ষনি ঘুমিয়ে পড়বে । তোমার কি পড়াশোনায় একটুও মন বসে না ? কোনদিনও তো একটা প্রশ্নের উত্তরও ঠিক করে দিতে পারো না । পরীক্ষাটা তো এগিয়ে আসছে,এখন থেকে পড়া শুরু না করলে আর কবে করবে ? অবশ্য তোমাকে এসব বলে কোন লাভ নেই । আমার মাথাটা আর গরম না করে এক্ষনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও।” রোহিণী ছলছল চোখে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । ম্যাম ওই প্রশ্নটা ক্লাসের ফার্স্টগার্ল অনুস্কাকে ধরতেই সঙ্গে সঙ্গে অনুস্কার সাজানো-গোছানো উত্তর শুনে ম্যাম তো খুব খুশি।“এই না হলে ফার্স্টগার্ল…।” ঘণ্টা পড়তেই ম্যাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে রোহিণীকে বললেন,“ অনুস্কাকে দেখে একটু শেখো,তোমারই লাভ হবে।আর পড়াশোনাতে একটু মন দাও।”
এখন টিফিন টাইম।ক্লাসের সব ভালো মেয়েগুলো একসঙ্গে বসে টিফিন খাচ্ছে। অনুস্কা, অঞ্জলি, সাক্ষী, ঐন্দ্রিলা – এই চারজন একেবারে হরিহর আত্মা।এরা লেখাপড়ায় যেমন ভালো তেমন নাচ-গান-আবৃত্তি সবেতেই সমান পারদর্শী।স্কুলের সব অনুষ্ঠানেই এরা অংশগ্রহণ করে।এরা নানা জায়গা থেকে অনেক প্রাইজ পেয়ে,স্কুলের নাম,বাবা-মা –এর মুখ উজ্জ্বল করেছে।ক্লাসের সবাই এদেরকে খুব মেনে চলে,আর স্কুলের ম্যামরাও এদেরকে খুব ভালোবাসে।রোহিণী এসব দেখে মনে মনে খুব কষ্ট পায়।সে আনমনে ভাবতে থাকে ভগবান বোধহয় এদেরকেই সব ভালো গুণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।তাকে এর ছিটেফোঁটা পর্যন্ত দেননি।ক্লাসে বেশিভাগ মেয়েরা তাকে এড়িয়ে চলে।রোহিণী মনে মনে ভাবে,সে যদি লেখাপড়ায় খুব ভালো হত, প্রতিদিন ক্লাসে পড়া পারতো,অনেক প্রাইজ এনে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করতে পারতো তাহলে কি ভালোই না হত। স্কুলের ম্যামরাও নিশ্চয় তাকে খুব ভালোবাসতো…।
এখন রোহিণীদের অংক ক্লাস।ক্লাসে ঢুকেই অংক ম্যাম অনুস্কাকে জিজ্ঞাসা করেন,“এবারের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হয়েছে জানো তো?” অনুস্কা বলে,“ হ্যাঁ ম্যাম।” “ তাহলে তো তোমার ওপর এখন অনেক দায়িত্ব। অনুষ্ঠানটা কিন্ত খুব ভালো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর করে করতে হবে।অনেক গণ্য-মান্য ব্যক্তি আসবেন।অবশ্য তোমাকে এসব বলতে হবে না আমি জানি।তুমি সবটাই ঠিক করে করতে পারবে।” কথা বলতে বলতে একবার রোহিণীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়েই অংক ম্যাম বললেন,“ অনুস্কা,এই অনুষ্ঠানে যারা যারা নাম দেবে তাদেরকে ভালো করে দেখে-বুঝে তারপর কিন্ত কাজে নেবে।ভুলভাল কাউকে নিলে কিন্ত পুরো অনুষ্ঠানটাই মাটি হবে।বুঝতেই তো পারছো স্কুলের সন্মান বলে কথা!” রোহিণী বুঝতে পারে না সব ম্যামদেরই তার উপর এত কীসের রাগ।এমনি করেই চলতে থাকে।
আগামীকাল স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান।সব প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে।সারা স্কুল সেজে উঠেছে রং-বেরং এর ফুল-মালাতে ।সবাই শেষবারের মত করে তাদের রিহার্সেল সেরে নিচ্ছে। প্রতিবারের মত এবারও রোহিণীকে অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য যতবারই সে অনুস্কাকে বলতে গেছে ততবারই অনুস্কা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে।রোহিণীরও কোন উপাই নেই যে,সে এই বিষয়ে ম্যামদেরকে বলবে।কারণ সে জানে ম্যামরা সবসময় অনুস্কার পক্ষেই কথা বলবে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থাকবে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান , সঙ্গে আর্ট-এক্সিবিশনেরও আয়োজন করা হয়েছে প্রতিবারের মতই ।মাননীয় জেলাশাসক মহাশয় স্কুলের কৃতীদের হাতে প্রাইজ তুলে দেবেন। অনুস্কা,অঞ্জলি,সাক্ষী,ঐন্দ্রিলা – এই চারজনই এবার মনোনীত হয়েছে দশম শ্রেণী থেকে।অন্যান্য ক্লাস থেকেও অনেকে মনোনীত হয়েছে।স্কুলের সেরা ছাত্রীর কৃতিত্বটা এবার অনুস্কাই পাবে।তাই বাকিদের থেকে নিজেকে একটু বেশি বড়ো ভাবছে।
আর্ট-এক্সিবিশনে যাদের ছবি সেরা হয় তারা কলকাতার বড় আর্ট-স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। আর্ট-এক্সিবিশনের হলঘরের সামনে স্কুলের ছাত্রীরা মিলে বড় করে একটা আলপনা আঁকতে বসেছে।এই আলপনা দিতে গিয়েই বিপদে পড়েছে অনুস্কা আর তার দলবল।যতবারই তারা আলপনা দিতে যাচ্ছে একবারও ঠিকমত হচ্ছে না।অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও যখন আর হচ্ছে না তখন তারা এই বিষয়টা ম্যামদের জানাতে গেল।কিন্ত অনুস্কা তো হাল ছাড়ার পাত্রী নয়!সে ঠাই বসে আলপনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।বহুকষ্টে একটা ফুল এঁকে সে সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছে।খবর পেয়ে ম্যামরা ছুটে এসে অনুস্কার আঁকা ফুল দেখে হাসির বেগ আর সামলাতে পারে না।অনুস্কা এক কোনে গিয়ে চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।রাগে–দুঃখে একেবারে মাটির সাথে মিশে যায়। হেড ম্যামকে আসতে দেখেই সবাই একেবারে চুপ।নিমেষের মধ্যে সবার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।হেডম্যাম সবটা দেখে শুনে বললেন,“এখন তাহলে আলপনার কী হবে? কে দেবে এই আলপনা?আগামীকাল অনুষ্ঠান,আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা!আর এই কম সময়ে বাইরে থেকে কাউকে ভাড়া করে আনাও সম্ভব নয়।” রোহিণী এবার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে হেড ম্যামকে বলে,“ম্যাম,আমি…মানে…আমি কি এখানে আলপনা দিতে পারি?” সঙ্গে সঙ্গে বাকি ম্যামরা তো একেবারে হো হো করে হেসে উঠলেন।“পড়াশোনা তো কিছুই পারো না,আবার এখানে আলপনা দিতে এসেছো?এসব না করে পড়াশোনা করো।কাজে দেবে।” রোহিণী প্রায় কাঁদতে কাঁদতে হেড ম্যামকে বলে,“ ম্যাম আমাকে একটা সুযোগ দিয়েই দেখুন না আমি পারি কিনা।প্লিজ ম্যাম।” রোহিণীকে কাঁদতে দেখে হেড ম্যাম বললেন,“ তুমি ঠিক বলছ? ঠিক করে আলপনা দিতে পারবে তো? দেখো হাতে কিন্ত বেশি সময় নেই।একটু পরেই তো তোমাদের ছুটি হয়ে যাবে।আর আগামীকালই তো অনুষ্ঠান।” পাশ থেকে একজন ম্যাম বলে ওঠেন,“ও আবার পারবে? বড়দি,আপনি বরং বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।এসব করে আর সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।” হেড ম্যাম বললেন,“তাও একবার চেষ্টা করে দেখি।রোহিণী,নাও নাও,তাড়াতাড়ি আলপনাটা দিতে শুরু করো।দেখি তুমি কীরকম আঁকতে পারো?” রোহিণী মনে মনে নিজেকে ভরসা যোগায়,তাকে পারতেই হবে। অল্পক্ষনের মধ্যেই রোহিণী এঁকে ফেললো অসাধারণ আলপনা ।সবাই একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল।যেখানে কিছুক্ষণ আগে অবধি একটা সাধারণ ফুল আঁকা ছিল এখন সেখানে খুব সুন্দর নকশাযুক্ত আলপনা।রোহিণীর আলপনা দেখে সবাই একেবারে তাজ্জব।কারও মুখ দিয়ে একটা টু-শব্দও বেরোচ্ছে না।হেড ম্যাম এবার অবাক হয়ে রোহিণীকে বলেন,“বাঃ! দারুণ হয়েছে।তুই এত কম সময়ে এত ভালো আলপনা এঁকেছিস?এবারের আর্ট-এক্সিবিশনে কিছু জমা দিয়েছিস?”রোহিণী মাথা নীচু করে বলে,“না,ম্যাম।”রোহিণীর কাঁধে হাত রেখে হেড ম্যাম বাকিদের উদ্দেশ্যে বলেন,“শুধুমাত্র লেখাপড়া দিয়েই সবাইকে বিচার করা যায় না।সবাই যেমন ওর থেকে লেখাপড়াই অনেক এগিয়ে রয়েছে,তেমনই ও কিন্ত এই দিক দিয়ে সবার থেকে এগিয়ে রয়েছে।প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নিজস্ব গুণ থাকে।সবাই সবকিছুতেই ভালো হয়না।” হেড ম্যামের কথা শুনে বাকি ম্যামেরা সবাই একেবারে চুপ হয়ে যায়।হেডম্যাম এবার রোহিণীকে ডেকে বলেন,“আমি কিন্ত আর্ট-এক্সিবিশনে তোমার আঁকা ছবি দেখতে চায় । তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।কাল তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
হেড ম্যামের কথা শুনে রোহিণীতো খুব খুশি।সে তার সবচেয়ে সুন্দর আঁকা ছবিটা আর্ট-এক্সিবিশনে জমা দেয়।বিচারকদের বিবেচনায় রোহিণীর আঁকা ছবিই সেরার সেরা নির্বাচিত হয় । জেলাশাসকও ব্যক্তিগত ভাবে রোহিণীকে পুরস্কৃত করেন। পুরস্কার হিসেবে সে কলকাতার বড়ো আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে। এখন সে নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে, স্কুলের হয়ে অনেক প্রাইজও আনছে।
কৃষ্ণনগর , পশ্চিমবঙ্গ , ভারত
আলোকিত প্রতিদিন /৬ জুলাই ,২০২১ / দুখু