নোবিপ্রবি শিক্ষার্থী স্মরণের স্বাবলম্বী হয়ে উঠার গল্প

0
671

প্রতিনিধি, নোবিপ্রবি:

নাদিয়া রহমান স্মরণ। কুমিল্লা আওয়ার লেডী অব ফাতিমা গার্লস হাই স্কুল থেকে মানবিক বিভাগে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বর্তমানে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি এখন উইংস অব ড্রীম ট্রেইনিং সেন্টার নামক কুমিল্লা লেডী বাইকার গ্রুপের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করছেন। শিক্ষার্থী ও ট্রেইনারের পাশাপাশি স্মরণের আরো কিছু পরিচয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকাল সুহৃদ নোবিপ্রবি শাখাতে বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেইসাথে কনজুমার ইয়ুথ বাংলাদেশে (সিওয়াইবি) যৌথ সম্পাদক এবং পাঠশালা, নোবিপ্রবিতে সৃজনী অনুষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শুরুটা যেভাবে-

নাদিয়া রহমান স্মরণ গত বছরের ১ জুন ট্রেইনার হিসেবে তার বান্ধবী আফরোজ সামিহার সঙ্গে (কুমিল্লা রেদোয়ান কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত) ট্রেইনিং সেন্টার উইংস অব ড্রীম নামক কুমিল্লা লেডী বাইকার গ্রুপে যোগদান করেন। গত বছর মার্চ মাসে যখন করোনার কারণে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয় তখন অন্য সবার মতো স্মরণ বাসায় গিয়ে অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন কি করা যায়। তখন হঠাৎ করে স্মরণ তার বান্ধবী সামিহার সাথে ট্রেইনিং সেন্টার উইংস অব ড্রীম নামক কুমিল্লা লেডী বাইকার গ্রুপে যোগদান করে ট্রেইনার হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। যারা স্কুটি চালানো শিখতে আসেন তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। পাশে ছিলো স্মরণের বাবা ও কাছের মানুষ।

স্বাবলম্বী হয়ে উঠার গল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে স্মরণ বলেন, ‘আমি কুমিল্লা লেডী বাইকার গ্রুপের স্বত্বাধিকারী সামিহার সহযোগিতায় এতো সুন্দর একটা প্লাটফর্মে আসতে পারি এবং ট্রেইনার হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। এই কাজটি আরম্ভ করার আগে কাউকে জানাইনি, তাই অনুপ্রেরণা প্রথমত কারো থেকে পাইনি তবে নিজ থেকে যখন নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলাম তখন উৎসাহিত করেছেন সবাই আমাকে। আমার অনুপ্রেরণা আমার আব্বু, আমার পরিবারের সদস্যরা আর খুব কাছের একজন মানুষ। যাদের অনুপ্রেরণায় আমার এতটুকু পথচলা। আমার জীবনের পরামর্শদাতা আমার আব্বু এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্য। তাঁরা খুব সমর্থন এবং সহায়তা করে আমার সব কাজে। তাঁরা পাশে আছে বলেই নির্দ্বিধায় এগিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, নিজেদের সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। নারীরা কোনো কিছুতেই এখন আর পিছিয়ে নেই। মেয়ে বিধায় লজ্জা পেয়ে বসে থাকলে হবেনা। যতটুকু মেধা আর যোগ্যতা আছে তা কাজে লাগিয়ে কিছু না কিছু করতে হবে।’- নাদিয়া রহমান স্মরণ

স্কুটি চালানো শিখেন যেভাবে-

স্মরণ কোন গ্রুপ বা কোর্সের মাধ্যমে শিখেননি। ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শিখেছিলেন, তাই খুব সহজেই ২০১৭ সালে তিনি বাইক চালানোও শিখে ফেলেন। গত পাঁচ বছর ধরে বাইক চালানো জানেন স্মরণ আর স্মরণকে শিখতে সহায়তা করেছেন তার ভাই ও বন্ধুরা। তিনি বলেন, স্কুটি আর বাইক চালানোর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। স্কুটির বিষয়টা সরাসরি স্পষ্টভাবে সামিহার থেকে একদিনেই বুঝে নিয়েছি।

স্কুটি চালানো শিখতে চাইলে-

ট্রেইনিং সেন্টার উইংস অব ড্রীম নামক কুমিল্লা লেডী বাইকার গ্রুপে এক থেকে দেড়মাস পর পর রেজিস্ট্রেশন করার জন্য ফর্ম বিতরণ করা হয়, ফর্ম পূরণ করে সবাই রেজিস্ট্রেশন করে নিতে পারে যারা তাদের ট্রেইনিং সেন্টারে ভর্তি হতে চায়। রেজিস্ট্রেশন শেষ হলে শিক্ষার্থীদেরকে নির্দিষ্ট সময়, স্কুটি চালানো শেখানোর স্থান বলে দেওয়া হয় তারপর তারা শেখানোর কাজ শুরু করে দেয়। স্কুটি চালানো শেখানোর কোর্স ১৫ দিনের, এরপরও অনেকের শিখতে আরো বেশি সময় প্রয়োজন হয় এজন্য তারা অতিরিক্ত ক্লাস দিয়ে তাদের পুরোপুরি শিখিয়ে দেন। এক্ষেত্রে কোন অতিরিক্ত ফি শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া হয় না।
কুমিল্লা ছোটরা কলোনি মাঠে ট্রেইনিং করানো হয় প্রশিক্ষণার্থীদের।

স্কুটি চালানো শেখানোর কোর্স ফি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে স্মরণ বলেন, ‘যারা সাইকেল চালাতে পারে তাদের ক্ষেত্রে ৩৫০০ টাকা এবং যারা সাইকেল চালাতে পারেন না তাদের ক্ষেত্রে ৪০০০ টাকা কোর্স ফি হিসেবে নেওয়া হয়। যারা শিখতে আসেন সবাইকে ট্রেইনিং সেন্টারের নিজস্ব স্কুটি দিয়েই শেখানো হয়। ট্রেইনিং সেন্টারে দুইটি স্কুটি বরাদ্দ রাখা আছে শুধু প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।’

স্মরণের অন্যান্য পারদর্শিতা-

ট্রেইনার পাশাপাশি স্মরণ নাচ, গান, অভিনয়, কবিতা আবৃত্তি এগুলোতে পারদর্শী। ছোটবেলা থেকে এসবের প্রতি খুব ঝোঁক ছিলো। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে না শেখা হলেও নিজের আগ্রহ থেকে আস্তেধীরে সব শিখে নিয়েছেন। তা ছাড়া সব ধরনের খেলায়ও স্মরণ পারদর্শী। স্মরণ বলেন, ‘ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম এমন আরো খেলা আছে যেগুলো আমি খুব ভালোভাবে পারদর্শিতা অর্জন করি। নোবিপ্রবিতে ক্যারাম প্রতিযোগিতায় এককভাবে ৩ বার চ্যাম্পিয়ন হই, অর্থনীতি বিভাগ থেকে ক্যারাম খেলার আয়োজন করা হয়, সেই দায়িত্ব থাকে আমার উপর, দায়িত্ব পালন করে খেলায় অংশগ্রহণ করেও ক্যারাম খেলায় চ্যাম্পিয়ন হই। বিজয় দিবস এবং অন্যান্য বিভিন্ন দিবসে আয়োজিত প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে ক্যারাম এবং নানাবিধ খেলায় সবসময় শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার পাই।এছাড়া প্রথম বর্ষ থেকেই বিভিন্ন সংগঠন এর সাথে জড়িত আমি, নোবিপ্রবি ডিবেটিং সোসাইটির সাথে ও জড়িত ছিলাম।’

ট্রেইনার হিসেবে স্মরণের উপার্জন-

স্মরণের মাসিক আয় ২০-২৫ হাজার টাকা। স্টুডেন্ট কতজন হয় এক ব্যাচে তার উপর নির্ভর করে আয়ের পরিমাণ । একটি ব্যাচ শেষ হতে দেড়-দুই মাসও লাগে কখনো কখনো। বার্ষিক আয় ১ লাখের কাছাকাছি।

যত বাধা-প্রতিবন্ধকতা ছিলো-

মেয়েদের কাজ করা নিয়ে সমাজের প্রায় সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। স্মরণের এলাকার সবাই সমান চোখে দেখেননা। বিষয়টি কেউ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে, আবার কেউ নেতিবাচকভাবে নিয়েছে। প্রথম দিকে মেয়ে এ কাজ করার জন্য স্মরণের বাবাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে স্মরণের বাবার সাপোর্ট ছিলো সবসময়। স্মরণের বাবা বলেন, ‘এখনকার মেয়েরা কোনোদিক দিয়েই আর পিছিয়ে নেই, মেয়েরা তো এখন হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে সব চালায় আর আমার মেয়ে স্কুটি চালালে সমস্যা কী?’

স্মরণ বলেন, ‘বাধা-প্রতিবন্ধকতা,আলোচনা- সমালোচনা সব কাজেই থাকে, তবে এই কাজে মেয়েদেরকে নিয়েই একটু সমালোচনা বেশিই। নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় রাস্তায় স্কুটি নিয়ে বের হলে মেয়েদের, অনেক ধরনের কটু কথা শুনতে হয় মেয়েদের। প্রথম প্রথম নতুন যারা স্কুটি শিখে তারা এসব বিষয় নিয়ে খুব মন খারাপ করলেও একটা সময় তারা আত্মসচেতন হয়ে উঠে, প্রতিবাদ করতে শিখে যায়। ‘

নিজস্ব ট্রেইনিং সেন্টার খুলতে চান স্মরণ-

ইতোমধ্যে স্মরণের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেট, সিনিয়র , জুনিয়র অনেকেই ক্যাম্পাসে স্কুটি চালানো শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে ক্যাম্পাস খোলা হলে নিজেই ট্রেইনিং সেন্টার চালু করবেন ক্যাম্পাস এলাকায়। স্মরণ বলেন, ‘মাস্টার্সের পড়াশোনা যেহেতু নোবিপ্রবিতেই করব তাই, এখানে ট্রেইনিং সেন্টার খুললে কোনো সমস্যা হবে না। যারা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাদের শেখাবো। ‘

নাদিয়া রহমান স্মরণের স্বপ্ন-

ইতিবাচক মনোভাব, সাহস, সততা, আন্তরিকতা মানুষকে অনেক দূরে নিয়ে যায় এই বিশ্বাস ধারণ করে এগিয়ে চলছেন স্মরণ। স্মরণের স্বপ্ন মানুষের জন্য কিছু করা, মানুষের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকা। নারীদের উদ্দেশ্যে নাদিয়া রহমান স্মরণ বলেন, ‘নিজেদের সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। নারীরা কোনো কিছুতেই এখন আর পিছিয়ে নেই। মেয়ে বিধায় লজ্জা পেয়ে বসে থাকলে হবেনা। যতটুকু মেধা আর যোগ্যতা আছে তা কাজে লাগিয়ে কিছু না কিছু করতে হবে।’

আলোকিত প্রতিদিন/৮ জুলাই-২১/এসএএইচ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here