কুড়িগ্রামে কৃষকের ভুয়া আইডি কার্ড দেখিয়ে হাতিয়ে নিল প্রায় ৬০ লাখ টাকা

0
349
প্রতিনিধি,উলিপুর (কুড়িগ্রাম)

কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে ভুয়া আইডি কার্ড সংগ্রহ করে কৃষকের কাছ থেকে চলতি বোরো মৌসুমে ধান-গম সংগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে। খাদ্যগুদামের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মিলে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লটারিতে নাম ওঠা প্রকৃত কৃষকের জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ধান-গম ক্রয় করে ৫৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন উলিপুর খাদ্যগুদামের ইনচার্জ শাহীনুর রহমান। আর ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকার লাভ। ফলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-গম ক্রয়ে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করলেও মেলেনি প্রতিকার। অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (কুড়িগ্রাম-৩) অধ্যক্ষ এমএ মতিন। এমপি এমএ মতিন বলেন, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা ছিল, সেই চেষ্টা ওসিএলএসডি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করেননি। তার অবহেলা-অনিয়মের কারণে এখানকার বরাদ্দ ৫০০ মে. টন ধান কেটে কুড়িগ্রাম এলএসডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে এখানকার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এটি আমার জন্য অত্যন্ত অপমানকর, কারণ আমি জনপ্রতিনিধি হয়েও তা জানতে পারিনি। এছাড়াও মৃত ব্যক্তিকে কৃষক দেখিয়ে ধান নেওয়া হয়েছে। কৃষকের ভুয়া এনআইডি বানিয়েও ধান, গম সংগ্রহ করা হয়েছে। কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে সরকারের ভালো উদ্যোগগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কৃষক মোহসীন আলী, আকবর আলী, সাইফুল ইসলাম ও বাবুল লিখিত অভিযোগে বলেন, খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমান উলিপুরে যোগদানের পর থেকে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে চলতি বছরে বোরো ধান-চাল ও গম সংগ্রহের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের যোগসাজশে মিল মালিক সমিতির আহ্বায়ক মাহফুজার রহমান বুলেট, সাবেক উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হেমন্ত বর্মণের কথিত ভাগনে গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা সুমন মিয়া ও মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ হাড়ির ভাতিজা ধামেশ্রনী ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সহকারী সরকারি চাকরীজীবী মিজানুর রহমানসহ কয়েকজনকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অভিযোগকারীদের তথ্য মতে, ওসি এলএসডি শাহীনুর রহমান প্রতি টন ধানে ২ হাজার, গমে দেড় হাজার এবং চালে টনপ্রতি ২ হাজার টাকা উৎকোচ নেন। এ হিসাবে ধানে ৩০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, গমে ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা এবং চাল ক্রয়ে ২৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা অর্থাৎ ৫৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আয় করেন। তারা আরও বলেন, প্রকৃতপক্ষে ৬ মে. টন ধান খাদ্যগুদামে মজুত থাকলেও কাগজে-কলমে ১ হাজার ৫৪৩ মে. টন দেখানো হচ্ছে। বাকি ধান কয়েকটি মিলের সঙ্গে ছাঁটাইয়ের চুক্তি করে অগ্রিম বিল প্রদানের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ধান সংগ্রহের লটারিতে উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ৯৬নং ক্রমিকে পানাতিপাড়া গ্রামের ভেলু মামুদের ছেলে খেলু মামুদ নামে এক কৃষক ১৮ জুন উলিপুর খাদ্য গুদামে ১ মে. টন ধান দিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন। অথচ খেলু মামুদের স্ত্রী লতিফা বেওয়া দাবি করে বলেন, তার স্বামী ১৯ মার্চ মারা যান। এদিকে ওই মৃত কৃষকের নাম ও পিতার নাম ঠিক রেখে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরে ১২ সংখ্যা ব্যবহার করে ছবি, মাতার নাম, গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। এরপর ওই ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান প্রদান ও বিল উত্তোলন করা হয়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, উপজেলার বজরা ইউনিয়নে ৪ জন কৃষকের কাছ থেকে ১০ জুন ৪ মে. টন ধান সংগ্রহ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। তারা হলেন, মুন্সিপাড়া গ্রামের জব্বার আলীর ছেলে আলম মিয়া, মমফার আলীর ছেলে মনজু মিয়া, বাহার প্রধানের ছেলে আনোয়ার হোসেন এবং নাপিতপাড়া গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে মকবুল হোসেন। এই ইউনিয়নেও কৃষকের নাম ও পিতার নাম ঠিক রেখে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরে ১২ সংখ্যা ব্যবহার করে ছবি, মাতার নাম, গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। এরপর ওইসব ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান প্রদান ও বিল উত্তোলন করা হয়। বজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমীন ওই ইউনিয়নে মুন্সিপাড়া ও নাপিতপাড়া নামে কাগজে-কলমে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব নেই বলে নিশ্চিত করেছেন। লটারিতে নাম থাকা ধামশ্রেণী ইউনিয়নের ভদ্রপাড়ার গ্রামের কৃষক উপেন চন্দ্র বর্মণ বলেন, আমি ৪০ মন ধান বিক্রি করেছি বাজারে। উলিপুর খাদ্যগুদামে কোনো ধান দিইনি। অথচ তার নাম ব্যবহার করে খাদ্যগুদামে ধান সংগ্রহ দেখিয়ে বিল উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে। উপজেলা খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ২৭ টাকা দরে ২৬৩৫ মে. টন ধান, প্রতি কেজি ২৮ টাকা দরে ২৭৮ মে. টন গম ও প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে ১৪৩৫ মে. টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-এ-জান্নাত রুমি জানান, অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু বকর বলেন, জাল এনআইডি কিংবা ভুয়া কৃষকের কাছ থেকে ধান, লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মিল মালিক সমিতির আহ্বায়ক মাহফুজার রহমান বুলেটের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নিউজ করেন আপনি। তবে আমি সাক্ষাতে বসে আলাপ করব। ওসিএলএসডি শাহিনুর রহমানের বক্তব্য নিতে গেলে তিনি কয়েক ভাড়াটে লোক ডেকে এনে সাংবাদিকদের ছবি ও ভিডিও করতে বলেন। এ সময় তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে একসময় বলেন, মিল চাতাল মালিকের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি আমার দেখার বিষয় নয়। জাল এনআইডি, মৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান, গম সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি মিথ্যা, বানোয়াট। এগুলো হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য।”

আলোকিত প্রতিদিন/ ১৮ আগস্ট ২০২১/ আর এম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here