বিশ্বরেকর্ড গড়তে যাওয়া গরু রাণী’র মৃত্যুর দায় কার

0
324

সফি সুমন, আশুলিয়া :

মাত্র দেড় মাস পরেই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠতো রাণী’র। এরপরেই পেতো বিশ্বের সবচেয়ে ছোট আকৃতির গরুর খেঁতাব। কিন্তু, তা আর হলো না, হঠাৎ প্রাণীটির মৃত্যুতে থেমে যায় সকল কিছু। সাভার আশুলিয়ার এই আলোচিত গরু রাণী’র মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমকর্মীরা সরাসরি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে থেকে জানতে পারেন। তবে শুরুর দিকে এই তথ্য অস্বীকার করেন গরুর মালিক। পরে বিষয়টি স্বীকার করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানিয়েছেন রাণী আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। তাকে শেষ সময়ে চিকিৎসার জন্য আমাদের কাছে আনা হয়। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর রাণী’র মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ। ফেসবুকেও অনেকে এ নিয়ে পোস্ট দেন। তাদের ধারণা, গিনেসে নাম লেখাতে খামার মালিক মরিয়া হওয়ায় রাণী’র অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুর বিষয়টিও ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। রাণী’র মৃত্যুর দুই দিন আগে তার খোঁজ নিতে আশুলিয়ার কুরগাঁও এলাকার শিকড় এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের ওই খামারে যান সাংবাদিকরা। তখন তাদেরকে খামারে ঢুকতে দেয়া হয়নি। দেখতে দেয়া হয়নি রাণীকে। কারণ জানতে চাইলে খামারের একজন বলেন স্টাফদের অসুস্থতার কারণে মালিকের নির্দেশে সেখানে প্রবেশ একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে সেদিনই ফোন দেয়া হয় খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. আবু সুফিয়ানকে। তিনি বলেন, তাদের নিজস্ব প্রাণিচিকিৎসক নিয়মিত রাণীকে দেখতে আসেন, রাণী সুস্থ আছে। এর দুই দিন পর সাভার উপজেলার উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল মোতালিব সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন, গরুটি মারা গেছে। মুমূর্ষ অবস্থায় গরুটিকে তার কাছে আনা হয়। কোনোভাবেই তাকে আর বাঁচানো যায়নি। রাণী’র অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে খামার এলাকায়
গিয়ে, আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আগে রাণীকে খামারের যে অংশে রাখা হতো, তা বাইরে থেকে দেখা যেত। তবে, বেশ কিছুদিন ধরে রাণীকে সেখান থেকে সরিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।

খামারে দর্শনার্থী, গণমাধ্যমকর্মীদেরও প্রবেশ বন্ধ করে দেয় খামার কর্তৃপক্ষ। ওই খামারের পাশেই বাড়ি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় সাংবাদিকদের রাণী’র বিষয়ে খোঁজখবর দিতেন। তার দাবী তিনিই প্রথম জানতে পেরেছিলেন যে রাণী মারা গেছে। তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগে রাণীরে আমি খামারে দেখি নাই। করোনার কারণে ওনারা আমাদের ঢুকতে দিত না। এই কারণে আমিও যাইতাম না। এলাকার লোকজন প্রাচীরের ওপর দিয়া রাণীরে দেখার চেষ্টা করত। সাভারের সরকারি পশু হাসপাতালের একজন পরিচিত লোক আমারে ফোন করে জানাল, ভাই পাঁচ মিনিট আগেই রাণী মারা গেল। বলছে, আমার চোক্ষের সামনে মারা গেছে। পরে আমি সাংবাদিকদের ফোন দিয়া জানাইছি। পেটে অতিরিক্ত পরিমাণ গ্যাস জমে পেট ফুলে গিয়েছিল। ‘গ্যাস তো অনেক কারণেই জমতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় যে, দানাদার খাবার গুঁড়া, ভুসি এগুলা খাওয়ালে পেটে গ্যাস জমে যায়। তা ছাড়া রাণী যেহেতু বামন টাইপ, তাই ইমিউনিটিও অনেক কম ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অনেক চেষ্টা করেছে রিকভার করার জন্য। কিন্তু রিকভার করা সম্ভব হয়নি। তাহলে রাণীর মৃত্যুর দায় কার? বিশ্বরেকর্ড করতে যাওয়া, বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনতে যাওয়া একমাত্র প্রাণীটির বিশেষভাবে যত্ন নেওয়ার দায় কি কারও উপর পড়েনি? এ ধরণের খর্বাকৃতি স্বল্প ইমিউনিটির গরুর যত্ন কেমন হওয়া উচিত (তার খাবার, বাসস্থান, ঘুম বিশ্রাম) রাণীকে সেভাবে রাখা হয়েছিল কিনা তার নিয়মিত খোঁজখবর না নেওয়ার দায় কি কেউ এড়াতে পারেন? কেউ এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ যে বিষয় রাষ্ট্রের সুনাম বয়ে আনে, তা কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রীক থাকে না, রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পদ রক্ষার জন্য কার কেমন ভূমিকা থাকা দরকার বা কার কতটুকু দায়িত্ব পালন করা দরকার ছিলো তা সকলের অগচরেই রয়ে যাবে? সাভার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম জানান এ ধরনের গরু যেহেতু স্বাভাবিক না, সেহেতু এগুলোর যত্ন অন্যসব গরুর মতো নেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি এ ধরনের গরুকে অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা জায়গাতেই রাখা দরকার ছিলো। তিনি আরও বলেন, আমি প্রথম যখন রাণীকে দেখতে সেখানে যাই, তখনই তাদের (খামার কর্তৃপক্ষকে) বলেছিলাম এর যত্ন নিতে হবে বিশেষভাবে। তাদের জানিয়েছিলাম, স্বাভাবিক গরুকে যে পরিমাণ খাবার দেয়া হয়, রাণীকে সে পরিমাণ দেয়া যাবে না। তার ওজন বুঝে পরিমিত খাবার দিতে হবে। যেহেতু এটি আকারে ছোট, তাই অন্য গরুর থেকে এটিকে আলাদা করে রাখতে হবে।’ রাণীর যত্নে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, জানতে চাইলে সাজেদুল ইসলাম বলেন, তা আমি বলতে পারব না। রাণী’র বিষয়ে বিভিন্ন সময় খামার কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে ফোন করে পরামর্শ নিতেন। রাণীকে শেষ সময়ে যখন নিয়ে আসে, তখন পরীক্ষা করে বোঝা গেছে যে এটি অন্তত দুই দিন ধরে অসুস্থ। ‘যখন রাণী অসুস্থ হয়, তখনই আমাদেরকে খবর দেয়া উচিত ছিল। তাহলে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা দিলে হয়তো রাণীকে বাঁচানো যেত। সাজেদুল মনে করেন যে গরু নিয়ে দেশে-বিদেশে এত আলোচনা হচ্ছে, তার রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে খামার কর্তৃপক্ষের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। রাণী’র অসুস্থতার খবর কেন আগে জানানো হলো না, সেই প্রশ্নও তোলেন এই চিকিৎসক। ‘খামারের মালিক শিকড় এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. আবু সুফিয়ানকে ফোন দেয়া হয় ঘটনার সত্যতা জানার জন্য। তিনি বেমালুম অস্বীকার করলেন। বললেন, তার “রাণী” মরেনি! এই গরুটি তো আর কোটি টাকার ব্যাংক লোন নিয়ে কেনা নয়’। তো সেই গরুর মৃত্যুর খবর তিনি কেন অস্বীকার করছেন? এমন প্রশ্নে তিনি চুপ।

কারণ একটাই। তার আকাঙ্খা এই খবর কোনোমতে চেপে রাখলে দেড় মাস পর গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাদের নাম উঠবে! পরে আবু সুফিয়ান ইনবক্সে লিখে পাঠান ‘রাণীকে আবিষ্কারের পর থেকেই সব প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক বন্ধুগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা, চারিগ্রাম এলাকার সর্বস্তরের জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় রাণী। অনেক শৌখিন ক্রেতা উচ্চমূল্যে রাণীকে কিনেও নিতে চান। কিন্তু, আমাদের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের হয়ে গিনেস বুকে আগে ওর নামটা লেখানো। তারপর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে শিকড় এগ্রোর পক্ষ থেকে উপহার দেয়া। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা আবেদনও করে রেখেছিলাম। রাণী তো রাণী-ই। পৃথিবীর একমাত্র ইউনিক পিস। স্বাভাবিকভাবে সেলিব্রিটি হবার পর রাণী’র নিরাপত্তার কারণে ওর চলাফেরা আমাদের সীমিত করতে হয়। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গরু আমাদের রাণী মারা গেল। রাণীকে ওই রাতেই খামারে মাটিচাপা দেয়া হয়। রাণী’র খবর গত ৫ জুলাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপরই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয় ২০ ইঞ্চির এই গরুটি। দুই বছর বয়সী রাণীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে এএফপি, বিবিসি, অস্ট্রেলিয়ার এবিসি, ফ্রান্সের ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের গালফ নিউজসহ অনেক সংবাদমাধ্যম। সে সময় বক্সার ভুট্টি জাতের এই গরুকে কিনতে আগ্রহ দেখান অনেক সৌখিন ক্রেতা ও খামার মালিকরা। এর জন্য সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতেও রাজি ছিলেন কেউ কেউ। তবে খামার কর্তৃপক্ষ গিনেস বুকে নাম ওঠার আগে রাণীকে হাতছাড়া করতে নারাজ ছিলেন। শেষমেশ চিরতরেই হাতছাড়া হয়ে গেল রাণী। আর এই চিরতরে হাতছাড়া হওয়ার দায়ভার কি কারও উপর বর্তাবে না?

আলোকিত প্রতিদিন/ ১ সেপ্টেম্বর ২০২১/ আর এম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here