ফেনীতে করোনাকালেও নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে। চলতি বছরের ৮ মাসে ফেনী জেলার ৬ থানায় ১৩৬টি মামলা হয়েছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১শ ৮০টি। তবে নারী ও শিশু নির্যাতনের পুরো চিত্র এটা নয়। মামলার বাইরেও অসংখ্য ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। যা সামাজিকভাবে মিমাংসা, প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দেয়া কিংবা অনেকেই আইন-আদালত পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ফেনী জেলার ৬ থানায় গত ৮ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৩৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে ১৮৯ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর মডেল থানায় ৫৭টি মামলায় ৭১, দাগনভূঞা থানায় ২৭টি মামলায় ৩৬, সোনাগাজী মডেল থানায় ১৭টি মামলায় ২৮, ছাগলাইয়া থানায় ৯টি মামলায় ১৩, ফুলগাজী থানায় ১৫টি মামলায় ২২ ও পরশুরাম মডেল থানায় ১১টি মামলায় ১৯ জন গ্রেফতার হন। পুলিশ মামলার তদন্ত শেষে সদর মডেল থানার ৩২, দাগনভূঞা থানার ২১, সোনাগাজী থানার ১২, ছাগলনাইয়া থানার ২, ফুলগাজী থানার ৯ ও পরশুরাম মডেল থানার ৬টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছে। এখনো ৫৪টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। পুলিশের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় ২০২০ সালে ১৮০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৪৫ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৭৭টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ আদালতে জমা দিয়েছে।ওই বছরের মাত্র তিনটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলে ওই তিনটি মামলার প্রতিবেদন জমা দেবেন তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ। আদালতের একটি সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৫ মার্চ ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ ঠাকুরগাঁও জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হন। সেই থেকে দীর্ঘ ১৪ মাস এই ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন জেলা ও দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেসা। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল এক আদেশে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ ওসমান হায়দার বিচারক হিসেবে যোগদান করেছেন। এছাড়া করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মামলার স্তুুপ পড়ে যায়। জানা গেছে, বতর্মানে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে ২ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১ হাজার ৩শ ১৪, ধর্ষণ ১শ ৯৯, শিশু নির্যাতন ৩শ ৪৬ ও মানবপাচারের ৪টি মামলা বিচারাধীন। এছাড়া ৫শ ৬০টি কমপ্লেইন (অভিযোগ) মামলা রয়েছে। আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো: দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে নতুন স্যার যোগদানের পর বিচারপ্রক্রিয়ায় গতি এসেছে। বেশ কয়েকটি মামলার নিস্পত্তিও করেছেন। একটি মামলায় সাজা ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী জর্জ কোর্টের আইনজীবী এড. এম. শাহজাহান সাজু বলেন, মামলা জট কমাতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদ্যোগ নিতে হয়।নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের নিজস্ব পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নেই। ফলে বারবার তারিখ ঘোষণা করে বছরের পর বছর মামলার কার্যক্রম চলছে। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নুর হোসেন বলেন, ফেনীতে হাজার হাজার মামলার জট কমাতে কমপক্ষে দুটি আদালতের প্রয়োজন। নারী ও শিশু আদালতে পিপি নিয়োগে বিচার বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এমনকি ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর সহযোগিতা কামনা করেন। ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি হাফেজ আহম্মদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু হলে মামলা দ্রুত নিস্পত্তি হবে। জানতে চাইলে ফেনীর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফোকাল পার্সন এবং সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মো: জাকির হোসাইন বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচার ছাড়াও মানবপাচার প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালের মামলা ও শিশু আদালত এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে একাধিক ট্রাইব্যুনাল করা প্রয়োজন। শিশু অভিযুক্তদের বিচার দ্রুত করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে শিশু আদালত পৃথক করা দরকার। এছাড়া পুলিশ ও পিপির সমন্বয় করে সময়মতো স্বাক্ষী উপস্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন, তাহলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, নারী ও শিশু আদালতে ভিকটিম মূলত মেয়েরা। তাই সবার কথা শুনে বিচার-বিশ্লেষন করার জন্য ও দ্রুত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সকলের সমন্বয় ও একাধিক ট্রাইব্যুনাল এখন সময়ের দাবী। জানতে চাইলে ফেনীর পুলিশ সুপার খোন্দকার নূরুন্নবী বলেন, ফেনীতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার পরই তাৎক্ষনিক আইনী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বিগত বছরে ১৮০টি মামলার মধ্যে ১৭৭টির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের ১৩৬টি মামলার মধ্যে ইতিমধ্যে ৮২টির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল সহ অধিকতর তদন্তের জন্য কিছু মামলা প্রতিবেদন জমার অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, ভিকটিমের শারিরীক পরীক্ষা ও ২২ ধারায় জবানবন্দি গ্রহনে পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মামলায় যাতে নিরপরাধ কাউকে ফাঁসানো না হয় সে জন্য কিছু মামলায় অধিকতর তদন্ত করতে সময় লেগে যায়। তিনি তদন্তাধীন মামলাসমূহের দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হয় বলে জানান।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১/ আর এম