অসুর বধে দুর্গা আসুক

0
346

সফি সুমন:
শারদ শব্দের অর্থ শরৎকাল, আর শারদীয় মানে শরৎকালীন। শারদা হচ্ছে দুর্গাদেবীর আরেক নাম। শারদ উৎসব বলতে আমরা দুর্গাপূজাকেই বুঝি। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। এ পূজা হিন্দুরা ধর্মীয় আচার ও নিয়ম মাফিক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে উদযাপন করে থাকে। ধনী গরীব নির্বিশেষে হিন্দু নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ সবাই নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে দেবীকে দেখার জন্য মন্দিরে-মন্দিরে গমন করে। আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে সকল হিন্দুপ্রাণ। পঞ্জিকা অনুযায়ি ২০২১ সালের শারদোৎসব শুরু হবে আগামী ১১ অক্টোবর। তার আগে ৬ অক্টোবর মহালয়ায় শুরু হবে দেবীপক্ষ। ১১ অক্টোবর মহাষষ্ঠীতে দুর্গাপূজা শুরু হয়ে চলবে ১৫ অক্টোবর বিজয়াদশমী পর্যন্ত। এরমধ্যে ১২ অক্টোবর মহাসপ্তমী, ১৩ অক্টোবর মহাষ্টমী ও ১৪ অক্টোবর হবে মহানবমী।
মার্কেন্ডেয় পুরানে ৮১ থেকে ৯৩ পর্যন্ত ১৩টি অধ্যায় নিয়ে আছে দুর্গা মাহাত্ম্য। মহামায়া দেবী মাহাত্ম্য অংশে মন্ত্র সংখ্যা ৭০০। দুর্গার অনেক নাম আছে, অনেক নামেই দুর্গার পূজা হয়, হয়ে থাকে। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তি নিয়ে বিশ^-ভুবনে আবির্ভাব দুর্গাদেবীর। চণ্ডী গ্রন্থে কাহিনিগুলোর মধ্যে দেবী দুর্গার বর্ণনা সর্বাধিক জনপ্রিয়। এ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে উল্লেখিত মহিষাসুর বধের কাহিনিটি বীরত্ব ও মহত্বগাথাঁ । মহিষাসুর দেবগণকে একশ বছরব্যাপী এক যুদ্ধে পরাজিত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নেয়। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করা হয় দেবগণকে। বিতাড়িত দেবগণ কোনো উপায়ান্তর না দেখে প্রথমে তারা প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের অত্যাচারের বর্ণনা শুনে উভয়েই খুব রাগাম্বিত হলেন। প্রচন্ড রাগে-ক্রোধে তাদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ করে। প্রথমে বিষ্ণু, পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমন্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হয়। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি ও অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও বিপুল তেজ নির্গত হয়ে মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সু-উচ্চ হিমালয় স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে এই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করে। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় তা কাত্যায়নী দেবী নামে অভিহিতা হয়। এই কাত্যায়নী দেবী যিনি ছিলেন- দেবী পার্বতীর অবতার। এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হতে লাগলো। প্রত্যেক দেবতা তাদের অস্ত্র, শক্তি, ক্ষমতা দেবীকে দান করলেন। হিমালয় তার সিংহবাহন দান করলেন দেবীকে। অষ্টাদশভূজায় মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন দেবী। (চন্ডী গ্রন্থ অনুসারে, মহালক্ষ্মী দেবী মহিষাসুর বধ করেন। ইনিই ছিলেন দুর্গা। তবে বাঙালিরা এঁকে দশভূজারূপে পূজা করে থাকেন)।
দেবী ও তার বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে থাকলে; মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তার সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তার বাহন সিংহ; প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুর-সেনাদের ধ্বংস করে দেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং নিজে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন; কিন্তু দেবী তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। অহঙ্কারে মত্ত অসুর, উচ্চবিলাসী প্রবল গর্জনে আকাশ বাতাস ভারী করে তুলতে থাকলো। -ওহে মূর্খ, যতক্ষণ আমি আহারে ব্যস্ত, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই স্বর্গের প্রকৃত মালিকগণ এখানে শীঘ্রই বিনয়ী ভাষন দেবেন” এতটুকু বলেই দেবী দীর্ঘ একটা লাফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তার কণ্ঠে পা রেখে শূলের আঘাতে অসুরের সমস্ত বুক ছিন্নভিন্ন করে দেন। বধ হলো অসুর। শক্তিশালী অসুর বধের দৃশ্য দেখে বাকি সব অসুরসেনা ভয়ে তটস্থ হয়ে হাহাকার করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করল। দেবতারা আবার স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।
মূলত, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন; শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নামে পরিচিত। আবার আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া, এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালন করা হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং অনেক পরিবারে এই রীতি প্রচলিত আছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে মহাসপ্তমী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত চার দিন সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশে বিজয়াদশমীতে সর্বসাধারণের জন্য এক দিন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য ৩ দিন সরকারি ছুটি থাকে।
দুর্গা যেমন দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অসুরকে দমন করে এই পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্য ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, মহামারীর এই করোনাকালের দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সময় শেষে পৃথিবীতে আবারও দুর্গা আসুক শান্তি সুখের বার্তা নিয়ে। বধ হোক কিছু মানুষরুপী অসুর। ধ্বংস হোক দুর্নীতির সাজানো পাহাড়। ধোঁয়াশা থেকে বেরিয়ে আসুক কালিমায় নিমজ্জিত থাকা সাধারণ মানুষের একান্ত মৌলিক অধিকার। ফিরে পাক স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বসহ নিজস্ব ভূ-খণ্ডের উপর স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। সুবাতাসে বহমান থাক এদেশ ও সমগ্র পৃথিবী। ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যে সামাজিকভাবে পালন হোক দুর্গাপূজা। সকল উৎসব হোক সার্বজনীন। মানুষের পেটে জন্ম নিয়ে পরিচয় ঘটুক মানুষ হিসেবে।

আলোকিত প্রতিদিন/ ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১/ দ ম দ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here