সাতক্ষীরায় চাঁদাবাজ সেই শিক্ষক যখন কোটিপতি

0
321

ইব্রাহিম খলিল, সাতক্ষীরা 

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কাড়িগর। আর সেই শিক্ষক যদি হয় দূর্নীতিগ্রস্থ তাহলে শিক্ষাঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না এ কথা অস্বীকার করার নয়। সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার ধানদিয়া গ্রামের প্রয়াত কাশেম আলী দফাদারের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। ছেলের মধ্যে বড় জন রেজাউল করিম। তালা উপজেলার ধানদিয়া বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে গত ইং ০১.০১.১৯৯৩ তারিখে প্রথম যোগদান করেন। বিদ্যালয়টি এমপিও ভূক্ত হয় ১৯৯৫ সালে। মূলত রেজাউল করিম ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি গত ইং ২২.০৯.২০০৯ তারিখে উক্ত বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে গত ইং ২৯.১২.২০০৯ তারিখে সাতক্ষীরা সদরের সন্নিকটে তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। যোগদানের পরবর্তীকালে তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। অভিযোগের মধ্যে আদম ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজি ও চাকরি বাণিজ্য অন্যতম। সরকার দেশব্যাপী জেলা উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যবস্থা উন্নত, গতিশীল ও প্রবৃদ্ধি করণে বদ্ধ পরিকর। এরই ধারাবাহিকতায় সাতক্ষীরা তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে বরাদ্ধ আসে ২ কোটি ৫৯ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮ টাকা। সরকারীভাবে এ কাজের দায়িত্বভার দেওয়া হয় মেসার্স মধু ট্রেডার্স, ১নং ষ্টেশন রোড, খুলনা। স্থানীয়দের অভিযোগ মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান উক্ত কাজ না করে কাজটি বিক্রয় করেন সাতক্ষীরা দক্ষিণ কাটিয়া গ্রামের মেহের আলী সরদার এর ছেলে ফজলুর রহমানের কাছে। তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪ তলা ভবন নির্মাণ কাজের শুরুতেই সাব ঠিকাদারের নিকট শিক্ষক রেজাউল করিম বিভিন্ন সময় চাঁদাদাবী করেন। নব নির্মিত বিদ্যালয় ভবন নির্মাণে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার হচ্ছে এমন মর্মে রেজাউল করিম কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বললে সাব ঠিকাদার ফজলুর রহমান চলতি বছরের ২রা ফেব্রুয়ারী কাজের সুবাদে প্রধান শিক্ষককে নগদ ১ লাখ টাকা প্রদান করেন। নগদ নারায়ন পেয়ে তুষ্ট না হয়ে ফের সাব ঠিকাদারের নিকট প্রধান শিক্ষক চলতি বছরের ৫ই জুলাই ৫০ হাজার টাকা দাবী করেন। সাব ঠিকাদার চাঁদা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় তালতলা গ্রামের গিয়াসউদ্দীনের ছেলে মহাসিনুল হাবিব মিন্টুকে নিয়ে শিক্ষক রেজাউল করিম ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন এ দাবী সাব ঠিকাদার ফজলুর রহমানের। প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম কর্তৃক বারবার চাঁদা দাবীতে বিরক্ত হয়ে সাব ঠিকাদার সাতক্ষীরা কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে রেজাউল করিম ও মহাসিনুল হাবিব মিন্টুর বিরুদ্ধে গত ইং ১৮.০৯.২১ তারিখে অভিযোগ দায়ের করেন। কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মিজানুর রহমান এর সাথে মুঠোফোনে আলাপকালে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফজলুর রহমানের একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। প্রধান শিক্ষক কর্তৃক চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ দিকে সাব ঠিকাদার ফজলুর রহমান দাবি করেন তার নিকট প্রধান শিক্ষক কর্তৃক চাঁদা আদায় করার ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ কথোপকথন মোবাইলে রেকর্ড আছে। সাব ঠিকাদার ফজলুর রহমান এর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত ম্যানেজার আলতাফ হোসেনের সাথে তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমের সাথে সেদিন মুঠোফোনে যেভাবে মোবাইলে চাঁদা দেওয়া ও পুনরায় চাঁদা দাবীতে মুঠোফোনে যেভাবে কথা হয়েছিল সে রেকর্ডের কিছুটা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো, “প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন: আসসালামু আলাইকুম, প্রতি উত্তরে ম্যানেজার আলতাফ হোসেন বলেন: অলাইকুম আসসালাম। ম্যাানেজার বলেন: স্যার, যেদিন আপনাদের স্কুলে ভবন নির্মাণ কাজে গিয়েছিলাম সেদিন আপনাদের সাথে কথা হলে আপনারা বললেন ভবন তৈরিতে নিম্নমানের ইট গাঁথা হয়েছে। সে অনুযায়ী আপনাদেরকে নগদ ১ লাখ টাকা প্রদান করেছি। প্রতি উত্তরে প্রধান শিক্ষক বলেন: হ্যা, পেয়েছি। ম্যানেজার : তাহলে, আবার কেন আপনার মিন্টু টাকা দাবী করছে? ম্যানেজার: একটু খোলামেলা কথা বলি স্যার। প্রতি উত্তরে প্রধান শিক্ষক সম্মতি দিয়ে ‘হ্যা’ বলেন। ম্যানেজার : আমাদের যাতে ঝুট ঝামেলা না হয় সে কারণে আপনাকে টাকা দিয়েছি। প্রতি উত্তরে প্রধান শিক্ষক বলেন: হুম, হুম,হুম…।” সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার ধানদিয়া গ্রামের প্রয়াত কাশেম আলী দফাদার তার জীবদ্দশায় একজন কৃষিজীবী মানুষ ছিলেন। তালা উপজেলার ধানদিয়া গ্রামের প্রয়াত কাউছার আলী দফাদারের ছেলে রাজ্জাক দফাদারের সাথে কথা বলে জানা গেছে প্রয়াত কাশেম আলী দফাদারের মোট জমির মধ্যে বিলান জমি ছিল ১০ বিঘা। ১ বিঘা বাগান, ১ বিঘা ভিটা বাড়িসহ সর্বমোট জমি ছিল ১২ বিঘা। উল্লেখিত জমির মধ্যে ৩ ছেলের অংশ মাফিক প্রত্যেক ছেলের মধ্যে ৪ বিঘা করে জমি বন্টন করে দেওয়া হয়। শিক্ষক রেজাউল করিম পিতার নিকট হতে ৪ বিঘা জমি প্রাপ্ত হন। রেজাউল করিমের স্ত্রী আজিদা বেগম। সেনেরগাঁতী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্বরত আছেন। তাদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে জানা গেছে বর্তমানে রেজাউল করিম তার স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে সাতক্ষীরার উত্তর কাটিয়ায় তার ক্রয়কৃত সাড়ে ৪ শতক জমির উপর টিনশেড বিশিষ্ট বাড়িতে বসবাস করছেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক উক্ত জমিটি ক্রয় করেন ২০ লাখ টাকা দিয়ে। শিক্ষক রেজাউল করিম চলতি বছরে সাতক্ষীরা সদরের মিল বাজার এলাকায় কাটিয়া মৌজায় ৩ শতক জমি ক্রয় করেন ৪৫ লাখ টাকা এ দাবী জমি মালিকদের। ক্রয়কৃত জমির দাগ নং- ০৮, জে.এল নং-১০১, খতিয়ান নং-২৩৯। এ বিষয়ে তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমের সাথে মুঠোফোনে আলাপকালে ৪৫ লাখ টাকা ও ২০ লাখ টাকা দিয়ে দু দফায় জমি কেনা ও এ টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ আমি রুপালী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা লোন নিয়েছি। গ্রামের জমি থেকে ১৫ কাঠা জমি বিক্রি করে বন্ধকী ছাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা অবশিষ্ট ছিল। তিনি আরো বলেন, যেখানে বসবাস করি ঐ জায়গাটি ৩ লাখ টাকায় কিনেছি। কাটিয়া মিল বাজার এলাকায় ৩ শতক জমি কিনেছি ঠিকই তবে তার মূল্য ৪৫ লাখ নয় ২৫ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ মানবাধিকার উন্নয়ন কমিশন এর সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম মহিদার রহমান এর সাথে শিক্ষকের দূর্নীতি নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক কর্তৃক চাঁদা আদায় ও হঠাৎ আঙুল ফুঁেল কলাগাছ বিষয়টি ভাবনার বিষয়। তিনি এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ও দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ক্যাপশনঃ তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম।

আলোকিত প্রতিদিন/ ২৯ সেপ্টেম্বর,২০২১/ এইচ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here