আবু তালহা রায়হান
আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্ম ইসলাম। আর ইসলাম মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম। শান্তি ও মানবতার ধর্ম। ইসলাম মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরি করেছে ইসলাম। ইসলাম মানুষকে ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। ইসলামের মূল ভিত্তিসমূহের মধ্যে অন্যতম দ্বিতীয় প্রধান হচ্ছে নামাজ। নামাজে আছে শান্তি-সুখ। নামাজ কল্যাণ বয়ে আনে। চিরস্থায়ী সুখের ঠিকানা জান্নাতে যাবার পথ সুগম করে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নামাজ বেহেশতের চাবি।
যে ব্যক্তি সঠিকভাবে নামাজ আদায় করবে তার জন্য জান্নাত সুনিশ্চিত। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় নামাজ অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৫)।
নামাজ কেবল মহান আল্লাহর একটি ইবাদতই না, বরং পারস্পরিক সম্পর্কের একটি যোগসূত্রও বটে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজে মুসল্লিদের মুলাকাত, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের একটি বন্ধন তৈরি করে। এতে করে তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি স্নেহ-মর্যাদাশীল হয়ে ওঠে। সামাজিক চলাফেরায় ধনী-গরিবের বৈষম্য বিদূরিত হয়। ইসলামে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক। এর মধ্য থেকে জুমআর নামাজের ফজিলত অন্যতম। আর জুমআর দিন হলো সপ্তাহের সর্বোত্তম দিন। এ দিনকে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশেষ দিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জুমাবারকে মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হাদিস শরিফে এসেছে, জুমার দিন কেবল মুহাম্মাদি উম্মাতেরই বৈশিষ্ট্য। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতকে জুমার দিন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অজ্ঞ রেখেছেন। ইহুদিদের ফজিলতপূর্ণ দিবস ছিল শনিবার। খ্রিস্টানদের ছিল রোববার। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠালেন এবং জুমার দিনের ফজিলত দান করলেন। সিরিয়ালে শনি ও রোববারকে শুক্রবারের পেছনে রাখা হয়েছে। কারণ, দুনিয়ার এই সিরিয়ালের মতো কেয়ামতের দিনও ইহুদি-খ্রিস্টানরা মুসলমানদের পেছনে থাকবে। আমরা উম্মত হিসেবে সবার শেষে এলেও কেয়ামতের দিন সবার ওপরে থাকব। (মুসলিম-১৪৭৩)।
জুমআর দিনের ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: এক হাদিসে রাসূল সাল্লালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন ফরজ গোসলের মতো গোসল করে প্রথম দিকে মসজিদে উপস্থিত হলো, সে যেন একটি উট কুরবানি করল। দ্বিতীয়ত, যে মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি গরু কুরবানি করল। তৃতীয়ত, যে মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ছাগল কুরবানি করল। অতঃপর চতুর্থ সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে গেল সে যেন একটি মুরগি কুরবানি করল। আর পঞ্চম সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ডিম কুরবানি করল। অতঃপর ইমাম যখন মিম্বরে বসে খুতবা পেশ করেন, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যান।’ (বুখারী-৮৮১)।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, যে দিনগুলিতে সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমাবার। এদিনে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। এদিনেই আবার তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে, বের করাও হয়েছে। এ দিনেই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। (মুসলিম)।
আমাদের দেশে জুমার দিন তথা শুক্রবার হলো ছুটির দিন। এই দিন সবধরনের অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এ দিন শহর-বন্দর, পাড়া-গাঁয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। জুমার দিন সকাল থেকেই শুরু হয় বিশেষ বিশেষ আয়োজন। কুরআন হাদিসের আলোচনা, ইলমী মুযাকারা ইত্যাদি। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়ের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ব্যস্ততা থেকে ফারিগ হয়ে সবাই এ দিন প্রভুর দরবারে নুয়ে পড়ে। তাওবা, ইসতিগফার করে। বেশি বেশি ইবাদাত করে। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেয়। কেউ কেউ আবার জুমাবারে পুরো দিনই নফল ইবাদতে মগ্ন থাকেন। জুমার দিন সকালে পাড়া-গাঁও, শহর-বন্দরগুলো কেমন আলোকিত হয়ে ওঠে। শুভ্র-সফেদ পোশাকে উম্মাহর মিলনমেলা সবাইকে মুগ্ধ করে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে যুবক-বৃদ্ধ সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। বড়-ছোটর কোনো ফারাক থাকে না। এ দিন রাজা-বাদশাহ, ধনী-গরিব সবাই সমান। এ যেন এক অপার মিলনমেলা! ভালোবাসা আর ভালোলাগার নজরকাড়া দৃশ্য। চিরঞ্জীব বন্ধন। এমন দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে! হাসিমুখে সবাই একে অপরের সঙ্গে সালাম-মুসাফাহা করেন। পারিবারিক হাল-অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। অনেক অপরচিত হয়েও এদিন সবাইকে খুব পরিচিত মনে হয়। কেউ আবার পাড়া-প্রতিবেশির মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেন। এভাবেই স্নেহ, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে জুমাবারে মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যেন আরো দৃঢ় হতে থাকে। আর মহান আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের এমন বন্ধনকে পছন্দ করে আল কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মাঝে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ (সূরা হুযরাত -১০)।
এই আয়াতে যে বিষয়ের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তা হলো, সকল মুমিন একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। মুমিনের বন্ধন অবিচ্ছেদ্য ও অভঙ্গুর হবে। সুখে-দুখে, কাজে-কর্মে, চিন্তা-চেতনায় সর্বত্রই এর জোয়ার ধারা বজায় থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুক। আমরা পরস্পর আরো স্নেহ-মর্যাদাশীল হই। মুসলিমদের এই মিলনমেলা দৃঢ়-মজবুত হোক। চির অটুট থাকুক। লিল্লাহিয়্যাতের জন্য একে অপরকে ভালোবাসি। সমাজে ভালোবাসা আর ভ্রাতৃত্বের বণ্টন বেশি বেশি হোক। সুষ্ঠুসমাজ গড়ে উঠুক। আমিন!
লেখক: প্রাবন্ধিক, ছড়াকার