বারী সুমন : “সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী/ লাউয়ের আগা খাইলাম ডুগাওগো খাইলাম/ লাই দিয়া বানাইলাম ডুগ ডুগি/ সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী।আমার বাংলাদেশের একতারা সুর কতই ভালোবাসি/ আমার বাংলাদেশের দোতারা সুর কতই ভালোবাসি/ তোমরা বাজাওরে ঢোল বাজাওরে বাঁশি।তাকধুম তাকধুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল/ আমি সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের বোল/ তাকধুম তাকধুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল।”
এমন অনেক গানের কথার মধ্যেই দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের কথাগুলো চলে আসে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ছাড়া জমে না গানের আসর। যদিও এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সেই সুর সবসময় হৃদয়ে বাজে। গ্রামে গ্রামে বসতো গানের আসর। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় জমতো আসর। এসব আসরে বাংলার কাঁদাজলে বেড়ে উঠা গ্রাম্য শিল্পীরা তাদের দরাজ গলায় গেয়ে উঠতো নানান ধরণের গান। কবিগান, পালা গান, বাউল গান, পুঁথি পাঠ, পল্লী মায়ের অপূর্ব সংমিশ্রণে সেইসব গান শিল্পীর গলায় সুরের ঝংকার তুলতো। কখনও কখনও সেইসব গানে দোহার থাকতো। গানের সাথে যন্ত্রসঙ্গীত হিসেবে বাজতো ঢোল, খঞ্জনি, হারমোনিয়াম, জুড়ি, বাঁশি, একতারা দোতারা, খমক, মৃদঙ্গ, বেহালা ইত্যাদি। এসব দেশীয় যন্ত্রসঙ্গীতের সুর দোলা দিয়ে যেতো মানুষের মনে। কি যে অপূর্ব প্রাণ জুড়ানো সেইসব সুর তা বলে শেষ করা যাবেনা। তাল লয়ের এক চমৎকার সংমিশ্রণ ছিলো সে যন্ত্রসঙ্গীতে। শুধু গান নয় যন্ত্রসঙ্গীত বাজিয়েও মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা যেতো সেসব সুরে। পল্লীপ্রকৃতির মায়াবী সুর গুলো ধারণ করতো সেসব যন্ত্র সঙ্গীতে। এইতো আমার দেশ /সোনার বাংলাদেশ/ দোয়েল শ্যামা কোয়েল ডাকা/ ডাকার নাইতো শেষ। কখনও বা বেজে উঠতো গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। পাগল মন মনরে/ মন কেনো এতো কথা বলে। এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে/ আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়/ এ আমার দেশ এ আমার প্রেম/ কতো আনন্দ বেদনা সিলনও বিরহ সংকটে। এমন মধুর সুর গুলো তরলা বাঁশের বাঁশিতে বেজে ওঠতো। সাথে ঢোল করতালের অপূর্ব সংমিশ্রণ। এসব বাদ্যযন্ত্রের সাথে আমাদের পল্লীজননীর অমূল্য সম্পদ লোকজ গান গুলো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতো। তখনকার সময়ে এসব বাদ্যযন্ত্র ছাড়া জমতো না গানের আসর। গানের আসর মানেই দেশীয় যন্ত্র। যে যন্ত্রের প্রতিটা টোকা মানুষের অন্তরে দাগ কেটে যেতো। সে যন্ত্রের সুর বাতাসের ঢেউয়ে যখন আছড়ে পড়তো গ্রাম্য কিশোরী মেয়ে নৃত্যে মেতে ওঠতো। এগুলো আমাদের মাটির সুর, প্রাণের সঞ্চার। মাটির গানে দেশীয় যন্ত্রসঙ্গীতের বিকল্প আর কিছু ছিলো না। দূর থেকে কানে ভেসে আসতো ঢোলের টোকা। গহীন জোছনা রাতে গ্রামের বাঁশিওয়ালারা খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে বা শূন্য উদ্যানে বসে বাঁজাতো তরলা বাঁশের বাঁশি। চারপাশে অসংখ্য শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে শুনতো সে বাঁশির সুর। কখনও কখনও রাতের বেলায় ঘুম ভেঙে গেলে সৌখিন শ্রোতারা যোগ দিতো সেই আসরে। রাত যতো গভীর হতো জমে ওঠতো গ্রামের এসব আসর। কখনওবা কণ্ঠে ভেসে আসতো পল্লী মায়ের গানের সুর। যে সুরে ঘর ছাড়া করে মানুষকে নিয়ে যেতো গ্রাম্য লোকজ গানের আসরে। বর্তমানে আদুনিক যন্ত্রসঙ্গীতের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় বাদ্য যন্ত্র। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে দেশীয় যন্ত্রের দেখা পেলেও তা যথেষ্ট নয়। দু’একটা যন্ত্র থাকে দেশীয়, বাকি সব আধুনিক। আমাদের দেশীয় যন্ত্রগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মাটির সুর পল্লী জননীর গান গুলোকে পুনরায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে ছন্দের ঝংকার তুলুক এটাই প্রত্যশা। আসুন সবাই মিলে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র দ্বারা গান করতে উৎসাহিত করি শিল্পীদের। ঢোল, বাঁশি করতালের ছন্দ-তালে আবারো আমাদের প্রাণে বেজে ওঠুক পল্লী মায়ের গানের সুর। “প্রাণো সখীরে ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কে”। এই গানের মতোই বেজে ওঠুক বাঁশি, বেঁচে থাকুক আমাদের দেশীয় বাদ্য যন্ত্র আমাদের সংস্কৃতিতে।
আলোকিত প্রতিদিন // আতারা