রিপন সারওয়ার
মুক্তাগাছার পাহাড়ী অঞ্চল রসূলপুর বনাঞ্চলের হাজারো কৃষক শামুক আতঙ্কে দিশেহারা। ধূসর বর্ণের নরম খোলসের লম্বা এ শামুক কৃষিতে যেন জম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শামুকের রাক্ষুসী অচরণে এলাকার হাজারো কৃষককূল আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। গাছের পাতা, ফল-ফলাদী থেকে শুরু করে স্বজাতি মৃত শামুক পর্যন্ত খেয়ে ফেলছে এ রাক্ষুসী শামুক। কৃষি জমি থেকে শুরু করে বসত-ভিটা এমনকি শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলও এই শামুকের দখলে। দিনের বেলায় এদের বিচরণ শান্ত হলেও রাতের আঁধারে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তাদের আচরণ।
মুক্তাগাছার রসূলপুর পাহাড়ী অঞ্চল ৮নং দাওগাঁও ইউনিয়নের রাজাবাড়ী সমগ্র এলাকায় এ ভয়ংকর শামুকের অবাধ বিচরণ পরিলক্ষিত। এলাকার কৃষকরা ধান, আলু, লেবু, আনারস, হলুদ, আদা, আম, লিচু, শাক-সবজী চাষাবাদ করে থাকে। কিন্তু এ শামুক পঙ্গপালের মত নিরব ঘতক হয়ে গ্রাস করে যাচ্ছে তাদের আবাদী ফসল ও শাক-সবজি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এ শামুক কৃষিতে নিরব ঘাতক পঙ্গপালের মত গাছের চারার কুশি থেকে শুরু করে ডাল-পালা, পাতা, ফল, শাক-সবজি খেয়ে ও পচিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে। ধূসর বর্ণের লম্বাটে ছোট ও বড় আকৃতির এ শামুকগুলো দেখতে জলাশয়ের শামুকের মত হলেও জলাশয়ে তাদের বিচরণ নেই, তাদের বিচরণ শুকনো ও ঠাণ্ডা জায়গায়।
এলাকাবাসী জানান, শখের বশে আনা শামুক আজ বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেত-খামার, ঘর-বাড়িতেও এ শামুকের উপদ্রোপ যেন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমরা এক বস্তা ১০০ টাকা দরে কিনে প্রায় ১০০ বস্তা শামুক পানিতে ফেলেছি তবুও কমানো যাচ্ছে না শামুক। এই শামুক নিয়ে আমরা বড় বিপদে আছি।
এ বিষাক্ত ঘাতক শামুকের শখের বিষয়ে জনতে গেলে তারা জনান, জৈনক ব্যক্তি কয়েক বছর আগে হাঁসের খাবারের জন্য সিলেট থেকে ১০/১২ টি শামুক নিয়ে আসে। কিন্তু এ শামুক হাঁস না খাওয়াতে ফেলে দেয় জঙ্গলে। মাঝে মাঝে আমরা এ শামুক দেখলেও তেমন কিছু উপলব্ধি না হলেও গত বর্ষায় হঠাৎ করে এ শামুকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও আমাদের ফসলে আক্রমণ করাতে চাষাবাদে ব্যাপক বাঁধার সৃষ্টি করেছে। এতে করে আমরা বড় ধরবের ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করেও একে দমন করতে পারছি না। অবশেষে ফসল রক্ষা করার জন্য নেটের জাল দিয়ে ঘের দিলেও আটকানো যাচ্ছে না। এ শামুক দমন করতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাদের চাষাবাদ ব্যহত হবে।
স্থানীয় চাষীরা বলেন, দিনের বেলায় এ শামুকগুলো গাছের ছায়যুক্ত ডালে বসে থাকে। আর যে জায়গায় বসে সে জায়গার পাতার রস চুষে ও পঁচিয়ে ফেলে। এমনকি কালো রঙের বিষাক্ত মল ত্যাগ করে। দিনের আলো ঘনিয়ে সন্ধ্যা এলেই তারা নিচে নেমে চাষকৃত ফসলে আক্রমণ করে। আমাদের থাকার ঘর, গোয়াল ঘর, বাচ্চার পড়ার টেবিল পর্যন্ত এ শামুক চলে আসে।
স্থানীয় লেবু চাষী খলিলুর রহমান জানান, এ শামুক রাক্ষসী শামুক। আমাদের সব ফসল খেয়ে ফেলছে। চলার পথে এ শামুক পায়ে পিষ্ট হলে আশে পাশে থাকা শামুকগুলো এসে মরা শামুকটিকে খেয়ে ফেলে। একেকটি শামুকের পেটে অসংখ্য ডিম। আমরা বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক দিয়ে শামুক মারার চেষ্টা করলেও এ শামুককে মারতে পারছি না। গভীর রাত থেকে সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত রাস্তাঘাটে এদের এতটাই বিচরণ যা দেখলে যে কেউ হতভম্ভ হয়ে যাবে।
আব্দুর রহমানের স্ত্রী শারমিন আক্তার জানান, সন্ধ্যার পর থেকেই শামুক আমার বাড়ির আঙিনার গাছাগুলোতে আসতে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি শামুকে ছেয়ে গেছে আমার উঠান। ঘরের বেড়া, রান্নাঘর, গোয়ালঘর সব জায়গায় শুধু শামুক আর শামুক। প্রতিদিনই ঝাড়ুদিয়ে ফেলতে হয়। তার আট বছরের শিশুকন্যা বলে, আমার পড়ার টেবিলেও শামুক আসে। এটা দেখে আমার ভয় লাগে।
নার্সারীর মালিক বাবলু মিয়া জানান, আমি ১০ হাজার আমের বীজ এনে চারা উৎপাদন করেছিলাম। বীজ থেকে গজানো চারা গুলোর কচি পাতা খেয়ে ফেলে এখন ৫ হাজারের মত অবশিষ্ট আছে। বাকী চারাগুলো রক্ষা করার জন্য ব্যবহার করছি কীটনাশক ও চারদিকে নেট দিয়ে ঘিরে রেখেছি তবুও সকাল বেলা এসে দেখি শামুক পাতা খাচ্ছে। আগামী ২/৩ বছর যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে পাহাড়ে মনে হয় আর কোনকিছু চাষাবাদ করা সম্ভব হবে না।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের বসবাসকারী উপজাতিরা খাওয়ার জন্য এ শামুক নিয়ে যায়। গরম পানিতে সিদ্ধ দেওয়ার সময় শামুকের ভেতর থেকে এক ধরনের নীল রঙের লালা বের হয়। এ নীল রঙের লালা তারা বিষাক্ত বলে ধারণা করায় খাওয়ার অনুপযোগী বলে ফেলে দেয়।ভুক্তভোগী এলাকাবাসীরা এ নিরব ঘাতক শামুক আতঙ্ক ও তাদের আবাদী ফসলকে বাঁচানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আকুল আবেদন জানান।
আলোকিত প্রতিদিন // আতারা