আবদুর রশীদ
পৃথিবী যখন আঁধারে ছেয়ে যেত; তখন অন্ধকার বিদূরিত করতে মহান রাব্বুল আলামিন আলো পাঠাতেন । যুগে পাঠানো সেই আলোরাই হলেন নবী-রাসূলগণ ৷ বর্বর আরবের জেহালতিতে পৃথিবী যখন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত, সেই সময়ে আগমনকারী দিগদিগন্তে কিরণ ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিই হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলো, শ্রেষ্ঠ মহামানব ও শ্রেষ্ঠ রাসূল। যিনি পৃথিবীর অরাজকতা, অনৈতিকতা, অশালীনতা ও অসহায়তার গ্লানি দূর করার পাশাপাশি অধিকার বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে এবং সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণীর জন্য রহমতস্বরূপ পৃথিবীর একমাত্র অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় উত্তীর্ণ । এই মহামানব ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ (মতান্তরে ৯) সোমবার সুবহে সাদিকের সময় মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন ৷
এ আলোর রবি সূচনা লগ্নেও ছিলেন পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ৷ মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় পিতার বিদায়ের মুহূর্ত চলে আসে ৷ পিতৃস্নেহের কষ্ট বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠেন মায়ের মমতায় ৷ মাত্র ৬ বছর বয়সে পৃথিবীর সব থেকে কাছের মানুষ প্রিয় আম্মাজানকেও হারিয়ে বসেন ৷ এমন কনিষ্ঠ বয়সে দুই রত্নের (পিতা-মাতা) স্থলে দাদা আবদুল মুত্তালিবের দায়িত্বে লালিত-পালিত হন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ৷ মা হারানোর কষ্ট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই উপস্থিত হয় দাদা হারানোর ভিন্ন কষ্টের ধাক্কা ৷ অতঃপর, ৮ বছর বয়সে দাদাকে হারিয়ে লালিত-পালিত হন চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে ৷ ১২ বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে পথিমধ্যে পাদ্রী বুহাইরা রাসূল(স.) সম্পর্কে একটি ভবিষ্যতবাণী করে বলেন, “তিনি একজন মহা-মানব হবেন ৷ আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি হবেন শেষ যামানার নবী ৷ তিনি নবী হওয়ার পেছনে আমি কিছু নিদর্শন দেখেছি ৷ সুতরাং তাঁকে সিরিয়ায় নিয়ে যাবেন না ৷ ইহুদীরা তাঁর ক্ষতি করতে পারে ৷” এই কথা শ্রবণ মাত্র চাচা আবু তালিব তাঁকে মক্কায় ফেরত পাঠান ৷ রাসূল (স.)-এর জন্ম থেকে যতগুলো শ্রেষ্ঠ মনীষী হওয়ার নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এই ভবিষ্যতবাণী ছিল অন্যতম ৷ এর পূর্বেও মা হালিমার কাছে থাকাকালীন মাত্র চার/পাঁচ(মতান্তর ৩) বছর বয়সে সিনাসাকের(বক্ষ বিদীর্ণ) ঘটনা ঘটেছিল ৷রাসূল(স.) মাত্র ১৭ (মতান্তর ২৫) বছর বয়সে ইতিহাসের সেরা দৃষ্টান্ত শান্তিসংঘ (হিলফুল ফুজুল) প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজও মানবজাতিকে শান্তির পথ দেখিয়ে আসছে ৷ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য হিলফুল ফুজুল অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার ৷ সিরাত গ্রন্থ থেকে জানতে পারি, রাসূল(স.)-এর এই উদ্যোগ আরবের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত কার্যকরি ভূমিকা রেখেছিল ৷রাসূল(স.) ২৫ বছর বয়সে বিবি খাদিজাকে(রা.)- বিয়ে করেন ৷ অতঃপর ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন ৷ ২৭ রমযান, সোমবার হেরা পাহাড়ের গুহায় প্রথম কুরআন নাযিল হয় সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত ৷ তিনি কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে প্রায়ই হেরা গুহায় ধ্যান করতেন একাকী ৷ ওহি প্রাপ্ত হয়ে প্রথমে তিনি অত্যন্ত ভীত অবস্থায় ছিলেন । তখন বিবি খাদিজা (রা.) তাঁকে শান্তনা দেন ৷ খাদিজা (রা.) ছিলেন রাসূল(স.)-এর সুখ-দুঃখ সব পরিস্থিতির একমাত্র কাছের মানুষ ৷ নবুওয়াত লাভের পর প্রথম ৩ বছর গোপনে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন ৷ অতঃপর, ৪৫ বছর বয়সে নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ বছরে চাচা হামজা (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ওমর(রা.)-ও এই বছরই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ৷ শুরু হয় প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ ৷
রাসূল(স.)-এর বয়স যখন ৪৯ বছর অর্থাৎ নবুওয়াতের ১০ম বছরে চাচা আবু তালিব মৃত্যুবরণ করেন ৷ এই কষ্ট মেনে না নিতেই সবচেয়ে প্রিয় মানুষ খাদিজা (রা.)-এর বিদায়ও চলে আসে ৷ একটার পর একটা কষ্টের ধাক্কা উপস্থিত হয় রাসূল(স.)-এর জীবনে ৷ এতে তিনি এতটাই ব্যতীত হয়েছিলেন যে, কয়েকদিন ঘর থেকে বের হওয়ারও শক্তি পান নি ৷ তিনি চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজাকে(রা.)- হারিয়ে একেবারে একা হয়ে পড়েন ৷অতঃপর, ৫০ বছর বয়সে অর্থাৎ নবুওয়াতের ১১তম বছর মহররম মাসে তায়েফে দাওয়াতী কাজে যান ৷ তায়েফের মানুষদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে নির্মম ঘটনার সম্মুখিন হন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ৷ যে ঘটনা প্রতিটি মুসলিম উম্মাহর চোখে পানি ঝরাতে বাধ্য করে ৷ তিনি এতটাই তায়েফ বাসীর নির্যাতনের শিকার হন যে, সহ্য করতে না পেরে স্বয়ং ফেরেস্তারা এসে রাসূল(স.) থেকে অনুমতি চাইলেন যেন তায়েফ বাসীকে মাটির সাথে মিশিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয় ৷ কিন্তু রাসূল(স.) রহমতের নবী, দয়ার নবী বললেন, “ওদের যদি ধ্বংস করে দিই, তাহলে তো পরবর্তী প্রজন্মরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না ৷ এরা না হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি; পরবর্তী প্রজন্মরা যেন সত্যকে গ্রহণ করতে পারে ৷” আর তাই রাসূল(স.) তায়েফ বাসীকে ক্ষমা করে দেন ৷ আজ সেই তায়েফ বাসীরা রাসূলকে(স.)- নিয়ে গর্ব করে, তাঁর প্রতি সালাওয়াত পাঠ করে, তাঁর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে ৷ আর এটাই ছিল রাসূল(স.) রাহমাতুল্লিল আলামিন হওয়ার শ্রেষ্ঠ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৷
রাসূল(স.)-এর কষ্ট একটু লাঘব করতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্বয়ং তাঁর সাথে দিদার লাভ করাতে রাসূলকে(স.)- সপ্ত আসমানের উপর নিয়ে যান ৷ যাকে লাইলাতুল মি’রাজ(উর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ) বলা হয় ৷ আর এই রাতেই মুসলিম উম্মাহর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয় ৷ মক্কায় কাফের-মুশরিকদের নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে মহান আল্লাহর হুকুমে তিনি ৮ রবিউল আওয়াল বৃহস্পতিবার মদিনায় হিজরত করেন (আর এই সময় থেকে মুসলিমদের হিজরী সন গণনা শুরু হয়) ৷ পরবর্তীতে মদিনায় ইসলামের প্রচার প্রসার বিস্তার লাভ করে ৷ মানবজাতির জন্য ধীরে ধীরে যাবতীয় হুকুম-আহকাম ও দিক নির্দেশনা নাযিল হয় ৷ আর ইসলাম প্রচার প্রসারে কাফেরদের সাথে বদর, উহুদ, খন্দক, খায়বার, তাবুক ইত্যাদি নানা যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটে ৷ মোট ৮৫টি যুদ্ধ অভিযানের কথা রেকর্ড করা হয়েছে, তন্মধ্যে স্বয়ং রাসূল(স.) স্বশরীরে ২৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন যা গাজওয়া নামে পরিচিত ৷রাসূল(স.) ছিলেন অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী ৷ তাঁর দেহে ছিল জান্নাতি ৪০ জন নওজুয়ানদের সমপরিমাণ শক্তি ৷ তিনি অতিরিক্ত লম্বা ছিলেন না এবং অতিরিক্ত খাটোও ছিলেন না ৷ তিনি ছিলেন মাঝারি আকৃতির ৷ বিভিন্ন কারণে আল্লাহর নির্দেশে তিনি ১১ কিংবা ১৩ টা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (তবে, তিনি ব্যতীত অন্যদের জন্য একসঙ্গে কেবল চারটি বিবাহ করা জায়েয) ৷ বিবাহিত স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র কুমারী ছিলেন হযরত আয়েশা (রা.) ৷ রাসূল(স.) ৫৪ বছর বয়সে তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৷ তাঁর জীবন জুড়েই রয়েছে সমগ্র মানবজাতীর জন্য অনুপম আদর্শ ৷ এই মহামানব অন্ধকার যুগকে আলোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন ৷ পূর্বে নারী জাতি ছিল সবচেয়ে অবহেলিত এবং সবচেয়ে অপদস্থ ৷ তারা একমাত্র ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত ছিল ৷ রাসূল (স.)-এর মাধ্যমে নারী জাতির মর্যাদা আল্লাহ তা’য়ালা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন ৷ রাসূল (স.)-এর সাথে একবার কেউ কথা বললে সে মুগ্ধ হয়ে যেতে ৷ তাঁর হাত ছিল অত্যন্ত কোমল ৷ কেউ একবার মুসাফাহা করার সুযোগ পেলে আর হাত ছাড়তে চাইতেন না ৷ তিনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন গোপনে গোপনে ইসলামের ঘোর শত্রুরাও তাঁর তিলাওয়াত শুনতে উঠে পড়ে লাগত ৷ রাসূল(স.)-এর ঘামের গন্ধ ছিল মিশক আম্বরের চেয়েও অতি সুগন্ধময় ৷ পৃথিবীর একমাত্র অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন প্রিয় রাসূল (স.) যার প্রশংসা করা হয় না এমন কোনো মুহূর্ত নেই ৷ অমুসলিমরাও তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য ৷ যুগে যুগে অমুসলিমরাও তাঁর সাক্ষ্য রেখে গেছেন ৷ মাইকেল এইচ হার্ট তিনি একশ মনীষীর জীবনীর উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং রেংকিংয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে যার নাম প্রথমে রেখেছেন তিনি হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ৷ এইভাবে শতশত নজির ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ৷
বিশাল এই আকাশ ও জমিনে যিনি একমাত্র শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত ৷ যার প্রশংসা স্বয়ং মহান আল্লাহ তা’য়ালা নিজেই করেছেন ৷ প্রিয় রাসূল (স.) সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিকে একা করে ৬৩ বছর বয়সে ১১ হিজরী ১২ রবিউল আওয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৭ জুন সোমবার দুপুরের কাছাকাছি সময়ে হযরত আয়েশা(রা.)-এর ঘরে তাঁর কোলে মাথা রেখে অফাত বরণ করেন ৷বর্তমান মুসলিমদের মধ্যে কিছু কিছু বিদ’য়াত প্রচলিত রয়েছে রাসূল(স.)-এর জন্ম তথা মিলাদ পালন নিয়ে ৷ মিলাদ পালন করতে গিয়ে নানা প্রকৃতির মিষ্টি খাওয়া, কেক কেটে মিলাদ উদযাপন, হালুয়া-রুটি খাওয়া ও যৌতভাবে কিছু মনগড়া নিয়মনীতির অনুসরণের মাধ্যমে চরম বিদ’য়াতে লিপ্ত অজ্ঞ মুসলিম ভাইয়েরা ৷ সিরাহ ও হাদীস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাসূল(স.) প্রতি সোমবার জন্মের শুকরিয়া স্বরূপ একটি করে রোজা রাখতেন ৷ যদি আমরা তাঁর জন্মের খুশিতে খুশি উদযাপন করি, তাহলে অবশ্যই রাসূল(স.)-এর অনুসরণের মাধ্যমে সোমবার রোজা রেখে মিলাদ পালন করা হলো প্রকৃত খুশি ৷মুসলিম ও অমুসলিম সকলের জন্য রাসূল(স.) একজন অনন্য আইকন ও আদর্শ ৷ বিশ্বের বিস্ময় হযরত মুহাম্মদ(স.)-এর আদর্শ (কুরআন ও হাদীস) অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ লাভ করার তৌফিক দান করুক ৷ আমিন !
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম
আলোকিত প্রতিদিন // আতারা