সাদ্দাম হোসাইন
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এক্সপ্রেসওয়ের দৃষ্টিনন্দন সড়ক মোড়। ড্রোনের চোখে দূর আকাশ থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ ক্যানভাসে আঁকা বৃহৎ একটি সাদা ফুল। সেই ফুলের পাপড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন প্রাণী। একটু কাছে এলেই স্পষ্ট হয়, এটি একটি সড়ক মোড়। যেখানে চক্রাকারে ছড়িয়ে থাকা মসৃণ সড়কগুলো দিয়ে সাঁই সাঁই করে ধেয়ে চলছে গাড়ি। সেই চলন্ত গাড়ির ওপর দিয়ে আবার এঁকেবেঁকে বিভিন্ন দিকে নেমে গেছে একাধিক সড়ক। রাতের বেলায় সড়কবাতিগুলো জ্বলে উঠলে সৃষ্টি হয় ভিন্ন এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের। আধুনিক স্থাপত্যকর্মের এই নিদর্শনটি ইউরোপ, আমেরিকা বা দুবাইয়ে নয়, গড়ে উঠেছে ফরিদপুর জেলার গ্রামীণ জনপদ ভাঙ্গায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অগ্রাধিকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের নান্দনিক এই সড়ক মোড়টি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে এই মোড় ব্যবহার করে জেলাগুলো সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানীর সঙ্গে। এতে সংযোগ সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র মোংলা, পায়রা ও বেনাপোল বন্দরের। সড়কের পাশাপাশি তৈরি হবে রেল যোগাযোগ। ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দারা বলেন, এই এলাকাটি যে এভাবে বদলে যাবে তা এখানকার কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগেও ভাঙ্গা ছিল চায়ের দোকানে ঠাসা শুধু একটি বাস স্টপেজ। ক্ষমতায় এসে নির্মাণ করেন ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক। এরপরই মোড়টির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। এখন এই জায়গাটি দেখে বিশ্বাসই হতে চায় না এটি আমাদের সেই ভাঙ্গা। মনে হয় ইউরোপ-আমেরিকার কোনো জায়গা। এখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে মোড়টির সৌন্দর্য দেখতে। ভাঙ্গা উপজেলা শহর এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার। এ প্রবেশদ্বার দিয়ে পশ্চিমে রাস্তা চলে গেছে গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা-বেনাপোল পর্যন্ত। দক্ষিণে মাদারীপুর, বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর সাগরসৈকত কুয়াকাটা, উত্তরে ফরিদপুর শহর হয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে। পূর্বে মাদারীপুর হয়ে পদ্মা সেতু পার হলেই ২০-২২ মিনিটে ঢাকা। বর্তমানে ও ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু হওয়ার পর যাতে কোনো যানজট না লাগে সেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেই এমন আধুনিক নকশায় ভাঙ্গা মোড়টি নির্মাণ করা হয়েছে। মহাসড়কটির সঙ্গে সংযুক্ত হয় দেশের ছোট-বড় অসংখ্য শহর। তেমনি পদ্মা সেতুসহ ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুরুতেই হাত দেন দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে। আজ ঠিকই পদ্মার বুকে দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে ভাঙ্গার মোড়টি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় গত বছরের এপ্রিলে। ভাঙ্গা মোড়ে চারটি আন্ডারপাস, একটি ফ্লাইওভার ও চারটি পৃথক লেন রয়েছে। দ্রুতগতির গাড়ি চলবে এক লেন দিয়ে, ধীরগতির গাড়ি অন্য লেনে। লেন ভুল করলে ঘুরে আসতে হবে অন্তত ১০ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়েটি রাজধানীর পোস্তগোলা থেকে মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার। আর নদী পার হয়ে শরীয়তপুর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার। মাঝের প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার পদ্মা সেতু যুক্ত করবে দুই পাশকে। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যেতে সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট, যা এখনো লাগছে আড়াই-তিন ঘণ্টা। ভাঙ্গা সড়ক মোড়ের চারপাশ এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, বরিশাল, খুলনা, ঢাকা বিভাগের যে কোনো জেলায় যাতায়াত করা যাবে কোনো ক্রসিং ছাড়াই। এটিই এখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির সড়ক। এ ব্যাপারে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, এটা সম্পূর্ণ দ্বিস্তরবিশিষ্ট রাস্তা। এখানে দ্রুতগতির গাড়ি একসঙ্গে থাকবে, ধীরগতির গাড়ি একসঙ্গে থাকবে। না মেশার কারণে নিরাপত্তা বাড়ার পাশাপাশি যানজট সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না। এই এক্সপ্রেসওয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও বদলে দিতে পারে।
আলোকিত প্রতিদিন // আতারা