শহিদুল্লাহ সরকার
গাজীপুরে শত বছরের পুরনো সরকারি হালট একটি কোম্পানীর অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার না করে বরং পুরো রাস্তাই জবরদখলকারী কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। নজিরবিহীন এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছেন পরিষদের ১১ জন সদস্য। অপরদিকে জবরদখলকারী ওই কোম্পানী বর্তমানে পুরো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে এলাকাবাসী ও পাশের অন্যান্য কোম্পানী। এঘটনায় রাস্তাটি ব্যবহারকারী স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এরই প্রেক্ষিতে দখলদার কোম্পানীর বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় গত মঙ্গলবার সাধারণ ডায়েরী করেছে রাস্তাটির প্রধান সুবিধাভোগী প্রীটি শিল্প গোষ্ঠী। ওই রাস্তার পাশেই ৩০ বিঘা জমির ওপর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রীটি শিল্প গোষ্ঠীর প্রীটি ইকো অ্যাপারেলস ভিলেজ লি. ও অক্সফোর্ড সুজস লি. নামের দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠান দুটি চালু হলে সেখানে দশ সহস্রাধিক লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে এলাকাবাসী আশা করছেন।এলাকাবাসী জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন নির্মাণাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান হামজা অ্যাপারেলস লি. এর দক্ষিণ পাশের রাস্তাটি সিএস জরিপ থেকে হালনাগাদ জরিপ পর্যন্ত সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত রাস্তা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত। শত বছরের অধিক পুরনো এ রাস্তার পাশেই হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু জমি ক্রয় করে এবং স্থানীয়দের বাধা উপেক্ষা করে রাস্তার একটি বড় অংশ জবরদখলে নিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে। পরবর্তীতে কোম্পানীটি স্থানীয় ভাওয়াল গড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে গত বছর ১২ মার্চ ওই রাস্তার সমস্ত জমি সাফ কবলা দলিল (নং-৩৩০৪) মূলে ক্রয় করে নেয়। সম্প্রতি রাস্তাটি টিনের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দিলে ইউপি চেয়ারম্যান কর্তৃক রাস্তাটি গোপন প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরের বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এঘটনায় রাস্তাটির প্রধান সুবিধাভোগী পাশের প্রীটি শিল্প গোষ্ঠী ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেন এবং উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। উচ্চ আদালত রাস্তায় প্রীটি শিল্প গোষ্ঠীর সহজ চলাচল উত্তরণের ব্যবস্থা রাখার জন্য হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষকে গত ২৭ অক্টোবর নির্দেশ দেন। কিন্তু উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনা অমান্য করে হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ রাস্তাটি তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের ভেতরে রেখে বাউন্ডারি নির্মাণের চেষ্টা করে আসছে। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার প্রীটি শিল্প গোষ্ঠীর মানবসম্পদ কর্মকর্তা বাবুল আহমেদ বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী নং-১০৩ করেন।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে রাস্তা থেকে বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলো উপরে ফেলেছে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে রাস্তার প্রবেশপথ থেকে শুরু করে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টিনের বেঁড়া দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আতাব উদ্দিন বলেন, জনগণের দীর্ঘ দিনের চলাচলের গুরুত্বপুর্ণ উক্ত রাস্তার একটি বৃহৎ অংশ হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক দখল করে নেওয়ার প্রথম থেকেই আমরা বাধা দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য রাস্তাটিকে পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত দেখিয়ে হামজা অ্যাপারেলস কারখানার কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। রাস্তাটির মোট ৬৭ শতাংশ জমির মধ্যে হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ প্রায় ৪৩ শতাংশ আগেই জবরদখলে নিয়েছিল। বেদখল হওয়া এ রাস্তার জমি অন্যান্য শিল্পোদ্যোক্তা তথা জনস্বার্থে উদ্ধার না করে বরং রাস্তার পুরো ৬৭ শতাংশ জমিই হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষের কাছে এক গোপন প্রক্রিয়ায় বিক্রি করে দেন ভাওয়ালগড় ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক। এ হস্তান্তর প্রক্রিয়ার বৈধতা দিতে বিদ্যমান জনচলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটিকে পরিত্যাক্ত ও অব্যবহৃত দেখানো হয় এবং চেয়ারম্যানের যোগসাজশে স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, এসি ল্যান্ড, ইউএনও, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচলক পর্যন্ত ম্যানেজ করা হয়। ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের অপর প্যানেল চেয়ারম্যান হাজী আব্দুল মোতালিব অভিযোগ করে জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গুরুত্বপূর্ণ উক্ত রাস্তার ৬৭ শতাংশ জমির মূল্য কয়েক কোটি টাকা। ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক গোপনে হামজা অ্যাপারেলসের কাছে চার কোটি টাকায় উক্ত জমি বিক্রি করেছেন। অথচ দলিলে মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সরকারি রাস্তা বিক্রির এই টাকা থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নামে অপ্রয়োজনীয় ১২২ শতাংশ জমি কিনেন ইউপি চেয়ারম্যান। তার মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় ৬৮ শতাংশ জমি হামজা অ্যাপারেলসরে সাথে কথিত বিনিময় দেখানো হয় এবং বাকি ১ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা তসরুফ করা হয় এবং অবশিষ্ট ৫৪ শতাংশ জমি ইউপি চেয়ারম্যানের অনুগত ইউপি সদস্য আবিদ হোসেন বাবুল এর নামে আমমোক্তারনামা দলিল করে নেয়া হয়।
এদিকে রাস্তাটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার যাবতীয় কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সিএস ও আরএস খতিয়ানে রাস্তা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত আলোচিত রাস্তার ৬৭ শতাংশ জমি সাবেক ১ নং মির্জাপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের নামে রেকর্ডভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে গত ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাস্তাটির জমি নবগঠিত ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদে ন্যাস্ত করা হয়। এর পর গত বছর ৩০ অক্টোবর ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে রাস্তাটির সমস্ত জমি অর্থাৎ ৬৭ শতাংশ জমি সাফ কাবলা দলিলমূলে ক্রয় করে আলোচিত জবরদখলকারী প্রতিষ্ঠান হামজা অ্যাপারেলস। অপরদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রাস্তাটি ভাওয়ালগড় ইউপিকে ন্যাস্ত করার আগেই বিগত ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর উক্ত রাস্তার জমিসহ অন্যান্য দাগে মোট ১৪ একর ৪১ শতাংশ
জমি ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের নামে নামজারি জমাভাগ (খারিজ) করা হয়।
যার নথি নং- ২৫৫২/২০১৭-২০১৮ ও জোত নং ৮০। এর পর ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক সভায় রাস্তাটি বিক্রির প্রস্তাব অনুমোদন দেখানো হয় এবং পরবর্তীতে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ১২ মার্চ ৩৩০৪ নং সাফ কবলা দলিলমূলে রাস্তাটির দখলদার প্রতিষ্ঠান হামজা অ্যাপারেলসের কাছেই হাস্তান্তর করা হয়। রাস্তাটি হস্তান্তরের এক সপ্তাহ পর অর্থাৎ ২০২০ সালের ২২ মার্চ ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের ১১ জন সদস্য গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত আবেদন জানান। কিন্তু রাস্তাটিকে পরিত্যাক্ত হিসেবে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আলোচিত হস্তান্তর প্রক্রিয়ার সাথে জেলা প্রশাসনও জড়িত থাকায় পরবর্তীতে এব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এদিকে এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে হামজা অ্যাপারেলসের নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও স্ট্যাট তত্ত্বাবধায়ক ফরিদ আহমেদ বলেন, রাস্তাটি পরিত্যাক্ত থাকায় আমাদের দখলেই ছিল। রাস্তাটির শেষ প্রান্ত থেকে ৩০-৩৫ ফুট দূরে প্রিটি শিল্প গোষ্ঠীর মূল ফটক। রাস্তার শেষ প্রান্তের উক্ত ৩০-৩৫ ফিট জায়গাও হামজা অ্যাপারেলস ক্রয় করেছে। ফলে প্রিটি শিল্প গোষ্ঠী এই রাস্তা ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। এব্যাপারে প্রীটি শিল্প গোষ্ঠীর মহাব্যবস্থাপক নাহিদ আক্তার নীরব বলেন, হামজা অ্যাপারেলসের দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারা আমাদের প্রতিষ্ঠানে চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ করে দিতে দীর্ঘ দিন ধরে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সরকারি রাস্তা থেকে আমাদের কারখানার প্রবেশমুখের আলোচিত জায়গাও আমরা ক্রয় করেছি। রাস্তার শেষ প্রান্তে আমাদের ক্রয়কৃত উক্ত জায়গার ওপর অগ্রক্রয়ের দাবীতে হামজা কর্তৃপক্ষ আদালতে মোকদ্দমা করেছেন। হামজা অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে, যাতে রাস্তাটি বন্ধ হয়ে গেলে নামেমাত্র মূল্যে আমাদের সম্পত্তি তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হই। এব্যাপারে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস. এম তরিকুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাস্তাটি হস্তান্তর প্রক্রিয়া আমার সময়ে হয়নি। তখন কোন প্রক্রিয়ায় কিভাবে রাস্তাটি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর হয়েছে তা ফাইল না দেখে বলা যাচ্ছে না।
আলোকিত প্রতিদিন // আতারা