তামীম আব্দুল্লাহ
শিক্ষার দীপ্তিময় মশালকে মুসলিমরা সভ্যতায় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি লাভ করে বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে যে অমূল্য অবদান রেখেছে তা প্রকৃতার্থেই বিরল।একদল প্রথিতযশা ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানমনস্ক গবেষকরা এ তথ্য উদঘাটন করেন এবং এই ঐকমত্যে পৌঁছেন ও স্বীকার করেন যে, মুসলিমরা শুধু প্রাচীন শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়াদিগুলো সংরক্ষণ করেনি বরং তা সমৃদ্ধও করেছে। অষ্টম শতাব্দীর গোড়া থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত মুসলিমরা ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জনে সন্ধিতসু জাতি।সেই সময়ে এই অর্জনের ধারায় যারা নতুনমাত্রা যোগ করেছিলো তাদের অন্যতম হলেন শিরাজী গ্রামের কবি, ফরাসি গদ্যের জনক, মহাকবি আবু মুহাম্মাদ মুসলিহ আল দ্বীন বিন আব্দুল্লাহ শিরাজী। যাকে শেখ সাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়।তিনি ছিলেন মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ ফার্সি কবিদের অন্যতম।ফরাসিভাষী দেশের বাইরেও তিনি সমাদৃত। তার লেখার মান এবং সামাজিক ও নৈতিক চিন্তার গভীরতার জন্য তাকে কদর করা হয়। ধ্রুপদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে শেখ সাদীকে একজন উঁচুমানের কবি ধরা হয়।তিনি ১২১০ ঈষায়ী খ্রিষ্টাব্দে ইরানের শিরাজীতে জন্মগ্রহণ করেন। ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়ালেখা করে হজ শেষে তিনি হয়ে ওঠেন ভ্রমণ পিপাসু। পরবর্তী ত্রিশ বছর তিনি তার কবিত্যের কাব্যকে আঁকড়ে নিয়ে হেঁটে চলেন এশিয়া ইউরোপের অজস্র পথ।তিনি এত বেশি ভ্রমণ করেন যে, ইবনে বতুতা ছাড়া প্রাচ্যদেশীয় পর্যটকদের মধ্যে কেউই এত বেশি দেশ ভ্রমণ করেনি।অবাক করা বিষয় হলো তিনি চৌদ্দবার পায়ে হেঁটে গিয়ে হজ করেছেন। তার সফরকালে অসংখ্য নদী এমনকি পারস্য উপসাগর, ওমান সাগর, আরব সাগরসহ প্রভৃতি পাড়ি দিয়েছেন। তিনি ভ্রমণেই নিজের কবিতা আর জ্ঞান করেছেন সমৃদ্ধ। দীর্ঘ ভ্রমণযাত্রা শেষে বাকী জীবনের দিনগুলো গ্রন্থ রচনা, খোদার প্রতি একাগ্রতা, এবং কবিতাকে ভালোবেসে কাটিয়েছেন।এ সময়ে তিনি তার যাপিত দিনের অভিজ্ঞতাকে কবিতার রূপ দিয়ে মানুষের কাছে তা পৌঁছিয়েছেন।তিনি বলেছেন, খোদার কথা, নবীর কথা, প্রেমের কথা, বিরহের কথা, শিক্ষা-দীক্ষার কথা। তিনি কবিতায় বুঝিয়েছেন মানবতার কথা,মনুষ্যত্ব আর তার প্রকৃত বিবেকের কথা। তার লেখা দিয়ে তিনি সামাজিক ও নৈতিকতা নিয়ে মানুষের মনে ফুটিয়েছেন সবুজের মাঝে কোমল গোলাপ।তিনি তার লেখার মান দিয়ে পৌঁছেছেন ধ্রুপদী সাহিত্যের চূড়ায়। বলা হয়, সাত ভাষার সাহিত্য বাদে সব ভাষার সাহিত্যকে মুছে ফেলা হয় এরপরও ফরাসি সাহিত্য টিকে থাকবে সাদীর জন্যে।শেখ সাদীর ২২টি গ্রন্থের নাম জানা যায়। সেখানে উল্লেখযোগ্য হলো,গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ,কারীমা,সাহাবিয়া, কাসায়েদে ফারসী,কাসায়েদে আরাবিয়া,গযলিয়াত, কুল্লিয়াত ইত্যাদি।এগুলোর মাঝে বিশ্ব সাহিত্যে সমাদৃত হচ্ছে গুলিস্তাঁ এবং বুস্তাঁ। তিনি তার কথায় কবিতায় সবসময়ই বুঝিয়েছেন যে, থাকা চাই মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্বের দ্বারাই সভ্যতার অঙ্কুরিত ফল ভোগ সম্ভব। যেখানে মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতার ছোঁয়া থাকবে সেখানে জেগে ওঠবে সভ্যতার শেকড়। নিওয়র্কে জাতি সংঘের সদর দফতরে রয়েছে সাদীর অমর মানবতার বাণী। যা ইরান সরকার কার্পেটে অঙ্কিত করে জনগণের পক্ষ থেকে পাঠিয়ে ছিলেন। ২০০৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের নওরোজ (নববর্ষ) উপলক্ষে সে দেশের জনগণকে ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা জানান।সেখানে তিনি কোট করেন সাদীর সেই অমর কাব্যাংশ।তিনি বলেন, আমরা নিজেদের মধ্যে কতগুলো বিভাজনের কারণে বিভক্ত হয়ে আছি।তবে আমরা সেই কথা স্মরণ রাখি যা কবি সাদী লিখে গেছেন বহু আগে। “আদম সন্তান সবাই এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো,কারণ সবাই একই উপাদানেরই তৈরি। তার কবিতায় বলা হয়,‘কৃতজ্ঞ কুকুর শ্রেয়/অকৃতজ্ঞ মানুষের চেয়েও’ যা নৈতিকতা শেখায়।তিনি পরকালকেও স্মরণ করেছেন কবিতায়,‘যাহা আবশ্যক ইহ-পরকালে/জোগাড়ে রাখিও তাহা যৌবনকালে’ । তিনি আরবি কবিতা ও প্রবাদ বাক্য ছাড়াও তার লেখায় যথেষ্ট পরিমাণে পবিত্র কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি চোখে পড়ার মতো। শেখ সাদির লেখা জনপ্রিয় ‘কশিদা’ তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। (বালাগাল উলা বিকামালিহি/কাশাফাদ দুজা বিজামালিহী/হাসুনাত জমিউ খিসালিহী/ছাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী) অতিশয় মহান গুণগান যার/রূপে যার দূরীভূত হলো অন্ধকার/মনোহর যার সমুদয় আচার/পড় সবে দরুদ উপরে তাহার।তিনি কত সালে মৃত্যবরণ করেন তা সঠিক জানা নেই। তবে ১২৯১-১২৯৪ ইষায়ী সনে মৃত্যুবরণ করেন বলে ধারণা করা হয়।মৃত্যুদিন কিবা সাল যাই হোক তিনি মানবতায় অমর রবেন তাঁর ‘কশিদা’র মতো করে।
আলোকিত প্রতিদিন // আতারা