শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো নবীজির আদর্শ

0
463

মুহাম্মাদ শামীম কায়সার

ঋতুর পালাবদল প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম।সেই নিয়মের ডানায় ভর করে পৃথিবীতে আসে হাড়কাঁপানো শীত।শীতে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের চিত্র বদলে যায়।রূপ নেয় নতুন এক ছবির। সকালে কুয়াশার চাদর মোড়ানো,দুপুরে রোদ্দুরের ঝলকানি,বিকেলে আবছা ছায়ায় ঢেকে যাওয়া দিগন্ত।সমাজের ধনাঢ্য ও বিত্তবান ব্যাক্তিদের জন্য শীত একটি উৎসবমুখর ঋতু।শীতে বিত্তবানদের ঘরে খুশি নামে ঝেঁপে।শীত তাই বরিষ্ণু হয় বিত্তশালীদের ঘরে পরম সাদরে।নানানভাবে তারা শীতকে উপভোগ করে।হরেকরকম পিঠের উৎসব আর নানান পোশাকে শীতকে তুমুল উপভোগ্য করে তোলে। আবার ছিন্নমূল ও বস্তুহারা মানুষের জন্য শীত একটি দুর্যোগের নাম।শীতে তাদের জীবনে নেমে আসে পরম দুর্ভোগ।দুঃখ, দুর্দশা ও হতাশাব্যঞ্জনার গ্লানি।অসহায় ও দুঃস্থ মানুষদের নানান অসুখ- বিসুখের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয় এই ভয়ধরানো শীতের ঋতু।এখন চলছে শীতকাল।ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের প্রকোপে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ অবস্থায় পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লাখ লাখ দুঃস্থ, নিঃস্ব, ছিন্নমূল, গরিব, দুঃখী, বস্ত্রহীন, শিশু, বৃদ্ধ । কনকনে শীতে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় শিশু,বৃদ্ধ ও নারীরা আক্রান্ত হচ্ছে নানান রোগে।বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ।নিউমোনিয়া, কোল্ডডায়রিয়ার মতো ভয়ানক রোগের ছোবলে পড়ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা।ফলে ছিন্নমূল মানুষের অর্থসংকট ও অসহায়ত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে ইসলাম আমাদের শেখায় মানবিক হতে।মানবতার হাত বাড়াতে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তাদের শীতবস্ত্র ব্যবস্থা করে শুকনো ঠোঁটে হাসি ফোটাতে।

তাই সমাজের সংগতিসম্পন্ন ও সচ্ছল মানুষদের উচিৎ এই মুহূর্তে ছিন্নমূল মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করা।কনকনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপা মানুষের গায়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো শুধু সামাজিক দায়িত্বই নয় এটা মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্বও বটে।কোরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে—”পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সব কিতাব ও নবীর প্রতি ইমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহ-প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীদের ও দাস মুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে, জাকাত দিলে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে; অর্থসংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭)।

নবী করীম (সা.) অসহায় মানুষকে সাহায্যের কথা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব একটি মুসিবত দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার মুসিবতগুলো দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবী মানুষকে সচ্ছল করে দেবে, আল্লাহ তাকে ইহকাল ও পরকালে সচ্ছল করে দেবেন এবং আল্লাহ বান্দাকে সাহায্য করবেন, যদি বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।’ (সহীহ মুসলিম)।অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে যুবকদের নিয়ে রাসূল (সা.) নির্মাণ করেছিলেন হিলফুল ফুজুল (দাতব্য সংস্থা) সংগঠন। অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো প্রিয় নবীর শিক্ষা ও আদর্শ।আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) এর কয়েকটি ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়,অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো কতবড় পুণ্যময় ইবাদাত।

ঘটনা
একদা আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) হজের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন।তাঁর সাথে একটা পাখি ছিলো।পাখিটা মারা যায়।আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) তাঁর ওকিলকে বললেন, মৃত পাখিটা ডাস্টবিনে ফেলে দাও।পাখিটা ফেলা মাত্রই ডাস্টবিনের পাশে একটা ডোরা থেকে একটি মেয়ে এসে পাখিটি কুঁড়িয়ে নেয়।এবং খুবই খুশিমনে পাখিটি নিয়ে দ্রুত বাড়ি চলে যায়।আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রহ. তাকে অনুকরণ করে মেয়টির ডোরাতে প্রবেশ করেন।
— মৃত পাখিটা তুমি আনলে কেন?
— আমি এবং আমার ভাই এইখানে থাকি।আমাদের একটি লুঙ্গি ব্যতীত কোন পোশাক নেই।আমাদের খাদ্য সামগ্রী নেই।তা জোগাড় করার মতো সামর্থও নেই।তাই বেশ কিছুদিন যাবৎ ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খেয়েই জীবন চালাচ্ছি।আমাদের পিতা ছিলেন একজন বিত্তবান ব্যক্তি।তাঁকে জুলুম অত্যচার করে সব ছিনিয়ে নিয়েছে।ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের পিতার প্রাণও।
—মা, তুমি এই মৃত পাখিটি ফেলে দাও।এই কথা বলে তিনি তাঁর এসিস্ট্যান্টকে বললেন, আমাদের হজ খরচ কেমন আছে?
— এক হাজার দিনার।
মারো (একটি জায়গার নাম ) পর্যন্ত পৌঁছার খরচ রেখে মেয়েটাকে সব দিয়ে দাও।আর জেনে রাখো এই সাহায্যই আমাদের এই বছরের হজ।এবং এই সাহায্য এই বছরের হজের চাইতেও পুণ্যময়।

ঘটনা
আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক তিনি যখনই সীমান্ত হয়ে রাক্কায় (একটি স্থানের নাম) আসতেন তিনি একটি সরাইখানাতে প্রায়ই উঠতেন,সারাইখানাগুলো ছিলো তখনকার সময়ের হোটেল।একজন যুবক এসে আবদুল্লাহ ইবনে মোবারককে সেবা যত্ন করতেন।তাঁর প্রয়োজন মিটিয়ে দিতেন।এবং তাঁর কাছ থেকে হাদিস শুনতেন।

একবার তিনি হোটেলে এসে যুবকটিকে পাননি। খোঁজ করে জানতে পারেন সে ঋণের কারণে বন্দী।আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক( রহ.) খোঁজ লাগিয়ে ঐ যুবকের পাওনাদারকে রাতে তার কাছে ডেকে বললেন, “আমি তাঁর সব ঋণ শোধ করে দিলাম।তুমি তাকে মুক্তি দিয়ে দাও।আর তুমি শপথ করে বলো যে,এই ঘটনা যুবককে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জানাবে না।”

ঘটনা
একজন ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে মোবারকের কাছে এসে বলল,
“আমি অভাবী। আমার ঋণ আদায় করতে পারছি না।আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক তার ম্যানেজারের কাছে পত্র পাঠিয়ে পরিশোধ করে দিতে বললেন।ম্যানেজার ঋণগ্রস্ততল ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন—
— তোমার ঋণ কতো?
— সাতশত দিরহাম।

ম্যানেজার আবদুল্লাহ ইবনে মোবারকের কাছে পত্র পাঠালেন। অভাবী লোকটির প্রয়োজন সাতশত দিরহাম,আপনি সাতহাজার লিখেছেন।সঞ্চয় প্রায় শেষ, অল্পকিছু বাকি থাকবে।আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক চিঠির উত্তর করলেন।জীবনের সময়ও তো প্রায় শেষ।যা লিখে দিয়েছি তাকে তাই দিয়ে দাও।(সিলসিলাতু আ’লামিত তারিখ)।

হাড়কাঁপানো শীতে শৈত্যপ্রবাহ ও শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন সতর্ক থাকা।প্রয়োজনীয় সুচিকিৎসা ও জরুরী ওষুধাদি সরবরাহ করা। সরকারি- বেসরকারি কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাছাড়া আমাদের অতিরিক্ত সোয়েটার, জ্যাকেট, কম্বল ইত্যাদি শীতবস্ত্র দান করার মাধ্যমেও আমরা শীতার্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারি।

এই প্রসঙ্গে রাসূল( সা.) বলেছেন,
“যে ব্যক্তির অতিরিক্ত বাহনজন্তু বা বাহনের খালি জায়গা আছে সে যেন বাহনহীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। কোনো ব্যক্তির যদি অতিরিক্ত পাথেয় থাকে তাহলে সে যেন পাথেয়হীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজী এভাবে আরো অনেক ধরনের সম্পদের কথা বললেন। তাতে আমাদের মনে হতে লাগল যে প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদে আমাদের কোনো অধিকার নেই।” — (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭২৮)।

সমাজের ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে অঢেল বিত্ত-বৈভবের প্রয়োজন নেই।আমরা মধ্যবিত্তরাও চাইলে সম্প্রসারিত করতে পারি সাহায্যের হাত।উপার্জিত অর্থের সামান্য অংশ যদি বরাদ্দ করে রাখি, হতদরিদ্রদের শীতবস্ত্রের জন্য তাহলেই দেখাতে পারি মমত্ব ও ভালোবাসা। ফলে মানুষে মানুষে তৈরী হবে মানবতার সেতুবন্ধন।লাঘব হবে শীতকষ্ট।হ্রাস পাবে শীতজনিত রোগের পরিমাণও।আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।আমীন!

লেখক : শিক্ষার্থী,জামিয়াতুল উস্তায শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী রহ.

 

আতারা // এপি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here