হেলাল আসহাব কাসেমি
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইউপি নির্বাচন চলছে। অনেক জায়গায় তো নির্বাচনের সমাপ্তিও ঘটেছে। আবার কিছু কিছু জায়গায় নির্বাচন সন্নিকটে। নির্বাচন আসলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ অবলীলায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষিত মানুষ পর্যন্ত খুবই উদাসীনতার পরিচয় দেয়। অথচ আমার-আপনার একটা ভোটই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।অনেকের তো ভোট সম্পর্কে নূন্যতম ধারণাটুকুও নেই।নির্বাচন বা ভোট প্রয়োগকে নিছক হার-জিত বা আনন্দ-ফূর্তির একটি মাধ্যম হিসেবেই দেখে! ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানুষ এতোটাই উদাসীন যে,অনেকেই স্লোগান তুলে- ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’ ভোট আপনার অধিকার,কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেয়ার অধিকার আপনাকে ইসলাম দেয় নাই ।তাই ,উপরোক্ত স্লোগানটি কোন ভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না। আসুন, শরীয়তের দৃষ্টিতে ভোটের গুরুত্ব এবং প্রয়োগীক অর্থ সম্পর্কে জেনে নেই-
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোটের চারটি প্রয়োগিক অর্থ রয়েছে : ১. সাক্ষ্য প্রদান ২.আমানত রাখা ৩.সুপারিশ করা ৪.উকিল বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করা।
সাক্ষ্য প্রদান
প্রার্থীকে তার প্রার্থিত পদে ভোট দেয়ার অর্থ হলো ভোটার এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, এই প্রার্থী ঐ পদের জন্য সার্বিক বিবেচনায় সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। বাস্তবে যদি তিনি ঐ পদের জন্য যোগ্য না হন, তাহলে ভোটার মিথ্যা সাক্ষ্যের দোষে দোষী হবেন। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্য ও ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদান ওয়াজিব এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হারাম। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও।’ (সুরা নিসা-১৩৫)।আল্লাহ আরো বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং অসার কার্যকলাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় মর্যাদার সাথে তা পরিহার করে চলে’ (সূরা ফুরকান- ৭২)। এক হাদীসে এসেছে-হযরত আবুবকর রা. বলেন, মহানবী সা. একদা এক জায়গায় হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় তিন তিনবার সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে কবিরা গুনাহের মধ্যে বড় কবিরা গুনাহের কথা বলব?’ সাহাবিরা হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, মা-বাবার অবাধ্যতা (এ দু’টির কথা বলার পর তিনি সোজা হয়ে বসলেন) এবং বললেন, ‘শুনে নাও! মিথ্যা সাক্ষ্যও অনেক বড় কবিরা গুনাহ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬২৭৩)।
আমানত রাখা
ভোট মহান রবের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর বিশেষ এক আমানত। এর হেফাজত করাও প্রত্যেকের জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব। ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয় এবং আগামী পাঁচবছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে দেশ-জাতি ধর্ম-বর্ণ সবারই মঙ্গল-অমঙ্গলের বাহ্যিকভাবে একটা ফয়সালা হয়ে যায়।সুতরাং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে সকল নাগরিককে হতে হবে দায়িত্বশীল। বিশেষ করে একজন মুসলিম নাগরিককে আরোও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে প্রধান্য দিতে হবে। টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রয় করা যাবে না। অন্যান্য চুরির ন্যায় ভোট চুরি করাও একটি গুরুতর অপরাধ। জাল ভোট প্রদান ও অন্যকে ভোট প্রদানে বাধা প্রদানকারী হাক্কুল ইবাদ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবে। একজন মুসলমান নিজে অন্যায় করবে না এবং অন্যকে অন্যায় করার সুযোগ দেবে না। মানুষ মূর্তির মতো নির্বোধ নয়। ফেরেশতার মতো নির্ভুল নয়। শতভাগ ভালো মানুষ পাওয়া দুষ্কর। তারপরেও ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, হক ও বাতিল, ঈমান ও কুফর, সুন্দর ও অসুন্দর এর পার্থক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপনার ভোট হতে পারে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কল্যাণ ও অকল্যাণের এ মিশ্রিত সময়ে অপেক্ষাকৃত তুলনামূলক সৎ, ভালো ও ইসলামপন্থী মযলুম মানুষগুলো হতে পারে আপনার সমবেদনার আশ্রয়স্থল।
সুপারিশ করা
কোনো ব্যক্তি কোনো প্রার্থীকে ভোট প্রদানের অর্থ হলো, সে ব্যক্তি ওই প্রার্থীকে একজন সৎ ও যোগ্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করার সুপারিশ করেছে। আর জেনেশুনে কোন অযোগ্য ব্যক্তির জন্যে সুপারিশ করা গর্হিত কাজ। সুপারিশ দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যক্তির ভালো-মন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-‘যে ব্যক্তি সৎকাজের জন্য কোনো সুপারিশ করবে তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের সুপারিশ করবে, সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে। বস্তুত আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল’। (সুরা নিসা,আয়াত- ৮৫)।
উকিল বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করা
সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য নেতা নির্বাচন প্রত্যেক পরিণত নাগরিকের সামাজিক অধিকার ও জাতীয় দায়িত্ব। দলীয় সঙ্কীর্ণতা, স্বজনপ্রীতি, বৈষয়িক ব্যক্তিস্বার্থের লোভ বা কোনোরূপ প্রভাবের কাছে নত স্বীকার না করে সৎ, যোগ্য ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করার মাধ্যমে এ অধিকার প্রয়োগ ও পালন করতে হবে। কিন্তু এর বদলে অর্থ, প্রতাপ বা বংশীয় সম্পর্কে প্রভাবিত হয়ে কেউ যদি অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়, তা হলে হাদিসের ভাষায় তিনি খিয়ানতকারী সাব্যস্ত হবেন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিমদের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বে নিযুক্ত হয়, তারপর সে তাদের ওপর এমন কাউকে কোনো কাজে কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, যার চেয়ে চরিত্রে ও কুরআন-হাদিসের জ্ঞানে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তি আছে বলে সে জানে, তবে সে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: এবং মুসলিম সমাজের অধিকারের খেয়ানত করল’। (সুত্র- তাবারানী;১১/১১৪,মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া, হাদিস নং-১১২১৬) ।তাই, কোনো অযোগ্য লোককে প্রতিনিধিত্বের জন্য দেয়া এবং তাকে জয়যুক্ত করা হলে পুরো জাতির হক নষ্ট করার গুনাহ হবে। আসুন, আমরা পবিত্র এই আমানতের হেফাজতে সচেষ্ট হই।পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন-নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আমানতসমূহ এর যোগ্য ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত করার আদেশ দিচ্ছেন আর তোমরা যখন শাসনকাজ পরিচালনা কর, তোমরা মানুষের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন করবে। নিশ্চয় আল্লাহর উপদেশ কতই চমৎকার। (সুরা নিসা, আয়াত- ৫৮)।উপরোক্ত আয়াতে শাসনক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে জনগণের আমানত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচন করা খুব প্রয়োজন।
লেখক: তরুণ আলেম
আতারা // এপি