শীত মুমিনের বসন্ত

0
580

আল-আমিন হাসান নাহিদ

আমরা বাঙালি। ছ’টি ঋতুর সাথে আমাদের পরিচয় আছে বেশ। প্রতি বছরই এক এক করে ছ’টি ঋতুর সাথে আমরা কথা বলি। প্রকৃতিকে বরণ করি আমাদের মাঝে।গ্রীষ্ম উষ্ণতম কাল। এই সময় সূর্যের প্রচণ্ড তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভূমি, পানি শুকিয়ে যায়, অনেক নদীই নাব্যতা হারায়, জলশূন্য মাটিতে ধরে ফাটল। গ্রীষ্মকালের শেষার্ধ্বে সন্ধ্যা সমাগত সময়ে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসময় গাছে গাছে বিভিন্ন মৌসুমী ফল দেখা যায়, যেমন: আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুয়ায়ী এর পরের ঋতুটিই হলো বর্ষাকাল।গ্রীষ্মকালীন সব তপ্ততা মিটিয়ে দিতে আগমন ঘঠে ঋতু বর্ষা। মৌসুমি বায়ূপ্রবাহ অঞ্চলগুলোতে উদযাপিত একটি ঋতু বর্ষাকাল। মৌসুমী বায়ুর প্রভাব সক্রীয় হওয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাত হয় এ ঋতুতে। ব্যাপৃত বর্ষাকাল শেষে দেখা মেলে শ্যামল শরতের।শরৎ বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। পৃথিবীর ৪টি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। এসময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ঠাণ্ডা হতে থাকে। শরতের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় পত্রভরা বৃক্ষের পাতা ঝরেঝরে আগমন ঘঠে ঋতু হেমন্তের।

হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। শরতের কাশফুল মাটিতে নুইয়ে পড়ার পরপরই হেমন্তের আগমন ঘটে। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তে সকালবেলা আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারি দিকের মাঠ-ঘাট। সকালে ধানগাছের ডগায় যে শিশির জমে থাকে তা হেমন্তের মায়াবী রূপের এক ঝলক। সকালের প্রথম রোদের বর্ণচ্ছটায় গাছের পাতাগুলো যেনো হেসে ওঠে। দৃষ্টিসীমা যত দূর যায়, দেখা যায় আলোকোজ্জ্বল অপূর্ব একটি সকাল তার অভাবনীয় সৌন্দর্য নিয়ে যেনো অপেক্ষমান। গাছের নরম-কচি পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি রোদ আর সুনীল আকাশ যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকে। হেমন্তের রাতে মেঘমুক্ত আকাশে ফালি ফালি জোছনার আলো অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই ঠিকরে পড়ে।হেমন্তের বিদায়ক্ষণ। শীত আসন্ন। বরণের প্রস্তুতি চলছে প্রকৃতিতে। শীতও যেনো প্রস্তুত সবাইকে ‘হিম’ চাদরে জড়িয়ে নিতে। ভোরের ‘শীত শীত’ আবহাওয়া আর বিকেলের ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাস অন্তত এ ইঙ্গিতই দিচ্ছে আমাদের। হেমন্তের ঝিরঝির বাতাস শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও জানান দিচ্ছে, যা শুধু জাগ্রত কানের অধিকারী মানুষই শোনতে পায়। যুগ যুগ ধরে জাগ্রত কানওয়ালারাই হেমন্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শীত যাপনের মোহনীয় প্রস্তুতি নিয়েছেন।‘রুহ জাগ্রত’ মানুষদের কাছে তা অফুরন্ত ইবাদতের আহ্বান। তাইতো আল্লাহ প্রেমিকেদর কাছে রমজানের পর ইবাদতের উত্তম মৌসুম হলো শীতের দিনগুলো।
রাসুল (সা.) এর ভাষায়- ‘শীত হলো মু’মিনের বসন্তকাল’ (মুসনাদে আহমাদ)। হজরত ওমর রা. এর ভাষায়- ‘শীত মু’মিনের গনীমত’। ওমর রা. এর কথার সমর্থন পাওয়া যায় স্বয়ং রাসুল সা. এর বাণীতেও। রাসুল সা. বলেছেন, ‘শীতের গনীমত হলো দিনে রোজা রাখা’ (তিরমিজি)। অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা.) আরও বলেছেন- ‘শীতের রাতগুলো বড় হওয়ায় দীর্ঘ সময় নামাজে কাটানো যায়। আর দিন ছোট হওয়া বেশি বেশি নফল রোজা রাখা যায় (বায়হাকী)। ইমাম গাজালী রাহি. লেখেন, ‘আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কিনা আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোটো থাকে আর রাতগুলো বড়ো হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয় (কিমিয়ায়ে সা’আদাত)।

প্রিয়তম সা. এর মতো সাহাবিরাও শীতকে ইবাদতের মৌসুম হিসেবে গ্রহণ করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তো রীতিমত শীতের গীত গাইতেন আর বলতেন- ‘হে প্রিয় ঋতু শীত! তোমাকে স্বাগতম!’ তিনি আরও বলতেন- “শীতে আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। কারণ এ সময় বেশি বেশি নফল নামাজ এবং নফল রোজা পালন করা যায়”। হজরত উবাইদ ইবনে উমাইর রা. বলতেন, ‘হে কোরআনের অনুসারীরা শোনো! শীত এসে গেছে। তোমাদের জন্য রাত বড়ো এবং দিন ছোটো করা হয়েছে। অতএব রাতে কোরআন তেলাওয়াত করো এবং দিনে রোজা রাখো।’ হজরত মুআজ ইবনে জাবাল রা. কে মৃত্যুর সময় কাঁদতে দেখে কোনো একজন জিজ্ঞেস করলেন- হে মুয়াজ! আপনি কি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছেন? তিনি বললেন- না। আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না। শীতের রাতে নফল নামাজে দাঁড়াতে পারবো না এই দুঃখে কাঁদছি।প্রিয় পাঠক! পৃথিবীর অনেক প্রান্তে বসন্ত ঋতুতে ফুল ফুটে, নতুন গাছের পাতা গজায়, নতুন গাছের জন্ম হয়। এই সময় অনেক পশুপাখি মিলন ঘটায় এবং বাচ্চার জন্ম দেয়। আবার পৃথিবীর অনেক জায়গায় এই সময় বৃষ্টিও হয়। এর ফলে গাছপালা বেড়ে উঠে, ফুল ও ফলের বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এ ঋতু। পূণ্যতার সাথে বেড়ে ওঠার সাওগাত নিয়ে আসছে ‘মুমিনের বসন্ত’ শীত। আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে ইবাদতের জন্য। মানবসেবার জন্য। শীতের আগেই যেনো দরিদ্র ও অসহায় মানুষের হাতে শীত বস্ত্র পৌঁছে দিতে পারি এ বিষয়ে বিত্তশালীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রতি বছরই শীতের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করলে পরে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ স্লোগান ওঠে। এবার যেনো শীতের কারণে কোনো আদম সন্তানকেই দুর্ভোগ পোহাতে না হয়- এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। আসন্ন শীতে বেশি বেশি নফল ইবাদত করে মহান মাবুদের প্রিয় বান্দা হওয়ার সুযোগ যেনো হেলায় ফেলায় নষ্ট না হয়। মাবুদের ভালোবাসার পাত্র হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেই আমরা ‘আল্লাহ প্রেমিক বান্দা’ হতে পারব। হতে পারব জাগ্রত কানের অধিকারী। যে কান বুঝতে পারবে হেমন্তের ঝিরঝির বাতাসের সুর, গ্রীষ্মের পাতার মরমর গান আর শীতের পত্র-পল্লবহীন গাছে ফিরে আসা রহস্যময় প্রাণের মাহাত্ম্য।

আতারা // এপি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here