কবি শাহীন রেজার শুভ জন্মদিন

0
401

আশুতোষ মিত্র

প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে এলো সুন্দর একটা বই, ঝকঝকে। খণ্ডিত মেঘের মুখ। লেখক শাহীন রেজা। প্রথমে নাকে নিয়ে ঘ্রাণ শুকলাম তারপর ভেতরটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। কয়েকটা কবিতার নাম, প্রিন্টিং Ñ বাইন্ডিং। বাহ্ সব চমৎকার। এরপর পাশে রেখে দিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে একটা দীর্ঘ চুমুক। রাতে খাবার পরে নিত্য অভ্যাসের মতো হাতে তুলে নিলাম বইটি। এই এক ঘন্টা শুধু আমার। এ ঘন্টাটিতে আমি বই পড়ি। নতুন আসা যে কোনো বই, না হলে পুরনো কোনোটা। আজ শাহীন আমার সাথী। ওকে আমি পছন্দ করি, শুধু এটুকু বললে ভুল হবে Ñ বলা উচিত, ভালোবাসি। এই ভালোবাসার সঠিক কোনো কারণ আমি ব্যক্ত করতে পারবোনা। আসলে ভালোবাসা বিষয়টিই এমনি, যা হয়ে যায় কোনো কারণ ছাড়াই। ঢুকছি শাহীনের কবিতায়। সেই কবে ওর একটা বই পড়েছিলাম, ‘পাখি চলে গেলে কবি বড় একা’। কী দীর্ঘ নাম। কিন্তু এই নামটির মধ্যে একটা হাহাকার লুকিয়েছিল, একটা দর্শন। পুরো বইটি জুড়েই সেই দর্শন যা আমাকে টেনে নিয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। আমি ওর যে কয়টি বই পড়েছি, সত্য কথা বলতে কি, প্রতিটি বইতেই আমি ওকে ভাঙতে দেখেছি। এ যেন কোনো এক নতুন আল মাহমুদ। নিজেকে ভেঙ্গে আবার গড়ার মধ্যে যে আনন্দ তা যেমন আল মাহমুদকে গ্রাস করেছিল তেমনি যেন শাহীনকেও। এবার আসি ওর সাম্প্রতিক বইয়ে। নামকরণই বলে দেয় এটির স্বাদ, গন্ধ এবং নির্মানরীতি সব কিছুই আলাদা, নতুন। ঢুকি প্রথম কবিতায়Ñ ‘দেয়ালে আটকে গেছে আস্ত দুপুর’। কল্পনা করুন, একটি দেয়াল, ঝকঝকে তকতকে কিংবা পুরানো, তারমাঝে একটি দুপুর আটকে আছে। সকালের দিকেও যাচ্ছেনা, বিকালের দিকেও। একমাত্র একজন কবির পক্ষেই এটা সম্ভব। এই বইটির একটি উল্লেখযোগ্য কবিতাÑ ‘পাশাপশি’। আমি কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করতে চাইÑ ‘উড়ে যাচ্ছে চিল, গোধূলি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করেÑ সন্ধ্যার দিকে। মাছকুড়ানি মেয়ে ফিরে যাচ্ছে বাড়ি, আাঁচলে তার বলেশ্বর এবং কয়েকটি ধূসর মরামাছ। অন্ধকারের আমন্ত্রণ হাতে জেগে ওঠার প্রতীক্ষায় থাকা কিছু নক্ষত্র ডেকে তুলছে নিশিন্দার ডালে ঘুমন্ত জোনাকিকে। ঠিক তখুনি আমার মা হাঁস মুরগি খোপে তুলে ওযুর জন্য পা বাড়াচ্ছেন পুকুরের দিকে আর মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের সাথে মিশে যাচ্ছে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি তীব্র আবেগে।’ বাংলাদেশ সম্প্রীতির চির ঐতিহ্যের দেশ। আমার জন্ম এদেশেই। এখানের এক নিভৃত গ্রামে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। কলকাতায় এসেছি তখন আমার বয়স ২১ কি ২২। আমার ভাষায় এখনো মুন্সিগঞ্জের টান। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে চাকরি করেছি দীর্ঘকাল, কিন্তু মাটি ভাষা লৌকিকতা এক হলেও মিশে যেতে পারিনি এর সঙ্গে। আমি এখনো সুরুজ ওঠা ভোরে চোখ মেলতেই শুনতে চাই এক ঝাঁক শালিক-চড়ুইয়ের একটানা চেঁচামেচি। শাহীনের কবিতায় আমি সেই দিনগুলোকে খুঁজে পাই। সেই বৈচি মালা, ঢোল কলমীর ফুল, সেই গঙ্গা ফড়িং এর নাচানাচি, সারি সারি তালগাছ, স্বচ্ছ দীঘির জলে জলপোকাদের ছোটাছুটি আর হারিয়ে যাই সেই সুবর্ণ সময়ে। সন্ধ্যায় পাখিদের ঘরে ফেরার মূহুর্তে আজানের ধ্বনির সাথে মিশে যাওয়া মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি আমার পরিণত হৃদয়ে আজও স্মৃতির দোলা জাগায়। শাহীন কতো বড় কবি সেটা বিচারের ভার আমার নয়। আমি কবি নই, একজন শিক্ষাবিদ মাত্র। বাংলা আমার সাবজেক্ট বলেই কবিতার প্রতি একটি দূর্বলতা সেই শিশুকাল থেকে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে এখনকার তরুণতম কবিটির কবিতাও আমি যত্নভরে পাঠ করি। কেউ আমাকে থমকে দেয়, ভাবায়, কেউবা পাশ কেটে হুঁশ করে হারিয়ে যায়। শাহীন টিকে আছে। ওর কবিতা আমাকে ধরে রেখেছে ওর কাছাকাছি; নিবিড় নৈকট্যে। আমি শাহীনের কবিতাকে ভালোবাসি, যেমন ওকে। একজন কবি যখন কোনো পাঠকের হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে সেখানে গড়ে তুলতে পারেন একটি স্থায়ী অবস্থান তখনই তিনি স্বার্থক। শাহীন তা পেরেছে বলেই আমার ধারনা। আমার ইতিমধ্যে বিরাশি হয়ে গেছে আর ওতো এবার পা দিচ্ছে ষাটে। খুব বেশি যে দূরত্ব তা কিন্তু নয়। তবুও বলছি, এটাই শেষ নয়, সামনে যে সময়টুকু আছে সেটুকু পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগালে বাংলা কবিতায় শাহীন একটি নিজস্ব স্থান অর্জনে সক্ষম হবে। শাহীনের একটি কবিতায় ‘ও’ লিখেছিল Ñ ‘আমি কবি, বেঁচে আছি পাখি ও কবিতার কাছাকাছি Ñ আমি কেন ভুল পথে যাবো?’ না ‘ও’ ভুল পথে যাবেনা, এটাই আমার বিশ্বাস। জন্মদিনের ক্ষণে প্রার্থনা করি শাহীন সঠিক পথেই এগিয়ে চলুক এবং বাংলা কবিতায় একটি স্থায়ী আসনের দাবীদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক।

আলোকিত  প্রতিদিন / ২৮ মে ,২০২২/ মওম 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here