জ্বালানি সাশ্রয়ে নাগরিক সমাজের দায়িত্ব
মোঃ নুরুজ্জামান
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” সংস্কৃত শ্লোকের অর্থ ‘মা ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।’ মানুষের প্রাথমিক আবাস মাতৃগর্ভ।দ্বিতীয় আবাস মাতৃভূমি। তাই প্রতিটা মানবশিশুর মানুষ হয়ে ওঠার জন্য জননী ও জন্মভূমই প্রধান নিয়ামক। স্বর্গের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই স্বর্গ।আগে মানুষ হতে হবে, তারপর না স্বর্গ পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্ন। মা ও মাতৃভূমি ছাড়া মানব শিশুর জন্ম গ্রহন ও বেড়ে উঠা অসম্ভব।মানব শিশুকে মানুষরুপে পরিচয় করিয়ে দিতে মা ও মাতৃভূমি ভূমিকা অপরিহার্য। তাই মা ও মাতৃভূমি মানুষের কাছে স্বর্গের চেয়েও দামি।
পৃথিবীর এই দুর্দিনীয় সন্ধিক্ষণে প্রতিটি মানুষের প্রধান দায়িত্ব মাতৃভূমির সেবায় প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা। আর আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তার জনগণের কাছে প্রথমত যে ত্যাগ প্রত্যাশা করে তা হল জ্বালানি শক্তি তথা তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির সঠিক ব্যবহার। তাই জ্বালানির এই সংকটময় দিনে প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বাগ্রে অত্যাবশ্যকীয় ও সর্বোচ্চ লাভজনক খাতের চাহিদা মেটানো। তারপর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আরাম, বিলাস ইত্যাদি খাতের চাহিদা ক্রমানুসারে মেটাতে হবে।কারণ সবারই জানা। আজকের মুক্তবাজর অর্থনীতি বিশ্বকে একটি গ্রাম বা মহল্লায় পরিণত করেছে। তাই অপ্রত্যাশিত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর আমেরিকা ও তার মিত্রদের অবরোধ বৈশ্বিক গ্রাম নামের পৃথিবীটার একেকটি বাড়িকে নরকে পরিণত করে চলেছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফিতি, স্থানীয় মূদ্রার অবমূল্যায়ন পৃথিবীর প্রতিটা মানুষকে অপ্রত্যাশিত দুর্ভিক্ষ বা ভাবী দুর্ভিক্ষের কবলে চুবান দিচ্ছে। আজ পৃথিবীর আট’শ কোটি মানুষের মানবাধিকার কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের ইগোর কাছে বন্দি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির দিকেও নিষ্ঠুর ফনা তুলে আছে নক্ষত্রের অক্সিজেন, হাইড্রজেন ও হিলিয়াম নামের স্বর্গীয় আশির্বাদের মত পৃথিবীর জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানি আজ ইউরোপের মানুষের মত আমাদের গায়েও নরকের পাথর পোড়া জ্বলনি ধরিয়ে দিয়েছে। সেই জ্বলনিতে পানি ঢালার জন্য রাষ্ট্র নানা ধরণের কৌশল অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ আজ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও উচ্চ মূল্যের ডলার দিয়ে সুউচ্চ মূল্য়ের জ্বালানি কিনতে পারছে না। তাই জ্বালানির জ্বলনি থেকে বাঁচতে দেশমাতৃকার সন্তান হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধ করিণীয় সম্পর্কে নিম্নের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
তার আগে স্বর্গের সাথে ভূস্বর্গের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আমার ভিন্নতর ভাবনার কথা বলি। মহান সৃষ্টিকর্তা চান পৃথিবীকে ভূস্বর্গ বানাতে। আর শয়তান চায় নরক বানাতে।
তাই আল্লাহর ভালবাসা আর শয়তানের কুমন্ত্রণা পরস্পর বিপরীতমুখী। আল্লাহ ও শয়তানের এই বিপরীতমুখী কার্যক্রমের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক “অপচয়” নিয়ে আলোচনা করা যাক। অপচয় পৃথিবীর জন্য একটি অমার্জনীয় ধ্বংসাত্মক অপরাধ। মানুষ সীমিত সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার করে নিজের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সদা সচেষ্ট। মানুষের সেই চেষ্টার ফলে পৃথিবী প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। সেপথেও অনেক বাঁধাবিঘ্ন আছে। আর সেসব বাঁধাবিঘ্নের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাঁধা হল প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্যময় হয়ে চলা পৃথিবীর ভারসাম্যে ব্যঘাত ঘটে। তাই সর্বাবস্থায়ই যেকোন ধরণের অপচয় পরিণতিতে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন যেকোনভাবে পানির অপচয় করলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে প্রভাব পড়ে। ফলে পানির স্তর নিচে নামে। এমনিভাবে যেকোন বস্তুর অপচয় প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে পৃথিবীর স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতির ওপর বাঁধা সৃষ্টি করে। তাই মহান আল্লাহ বলেছেন, “কিছুতেই অপচয় কর না” (সূরা বনি ইসরাইল,আয়াত : ২৬)।
এই আয়াতে আল্লাহ শুধু খাদ্য বা পানি নয়, প্রতিটি বস্তু, সেবা, মেধা ইত্যাদি সবকিছুরই অপচয় রোধ করতে আদেশ করেছেন । আল্লাহর এই আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা যারা মানবে না তাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না: “নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না।” (সূরা আনআম, আয়াত :১৪১)
এরপর আল্লাহ অপচয়কারিদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, “নিশ্চয়ই যারা অপচয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত :২৭)
শয়তানের কাজ হল মানুষের ক্ষতিসাধন করা। তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া। তার মানে কেউ শয়তানের ভাই হলে সেও মানুষের ক্ষতি করে, মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে অপচয় করে সে এমনই এক নিকৃষ্ট দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়।
প্রকারান্তরে অপচয়কারী নিজে জাহান্নামে যাওয়ার কাজ করে এবং আল্লার প্রত্যাশিত ভূস্বর্গকেও জাহান্নাম বানাতে সাহায্য করে। তাই আল্লাহ যাদেরকে “মানুষ শয়তান” বলেছেন আমার দৃষ্টিতে অপচয়কারীরা তাদেরই অংশ। আল্লাহ চান মানুষ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, ন্য়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য় কাজ করুক। তাই অযৌক্তিভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা মহাপাপ। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এত বড় ঘোরতর অপরাধ যে, এটাকে আল্লাহ মানুষ হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলেছেন। এব্যাপারে আল্লাহর স্পষ্ট ঘোষণা, ”ফেতনা (বিশৃঙ্খলা) সৃষ্টি হত্যা অপেক্ষা গুরুতর পাপ।“ (সূরা বাকারা, আয়াত :১৯১)
অন্যদিকে পৃথিবীকে ভূস্বর্গ করে তোলার জন্য আল্লাহ মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এইজন্য তিনি জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে শর্তসাপেক্ষে সবাইকে সৎকর্মের পুরস্কার দিতে চেয়েছেন,
“নিশ্চয়ই মুসলিম, ইয়াহুদী, খ্রিস্টান এবং সাবেঈন সম্প্রদায়, (এদের মধ্যে) যারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং সৎ কাজ করে, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট পুরস্কার রয়েছে, তাদের কোন প্রকার ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।” (সূরা বাকারা-৬২) এপর্যন্ত আমরা অপচয় ও সৎ কর্মের ব্যাপারে আল্লাহর সতর্ক, হুশিয়ারী ও পুরস্কার ঘোষণা সম্পর্কে সামান্য অবগত হলাম মাত্র।
এখন দেখা যাক কীভাবে আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপচয় রোধ করে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, সৎ কাজ করে, দেশমাতৃকার অনেক বেশি উপকার করতে পারি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্বালানির অপচয় রোধ করা। এই কাজে প্রতিটি মুসলিমের পবিত্র দায়িত্ব তথা ফরজ দায়িত্ব হলো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপচয় না করা। বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) বলেছেন, ’আল্লাহ প্রদত্ত হালাল রুজির অপব্যবহারও আল্লাহর ইবাদতের উপর প্রভাবশালী।‘ চিন্তা করে দেখুন, হালাল পথে আয় করা সম্পদের অপব্যবহারও আল্লাহর ইবাদত কবুলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাহলে ভেবে দেখুন, বৈশ্বিক সঙ্কটকালের দ্রব্যমূল্যের ও একমাত্র প্রাধান্য় বিস্তারকারী বৈদেশিক বানিজ্য, সেবা ইত্যাদির বিনিময়ের মাধ্যম মার্কিন ডলারের লাগামহীন উর্ধগতির কারণে জ্বালানি সংকটে পড়া দেশের মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য অপচয় রোধ করা কত বড় পূণ্যের কাজ হতে পারে!
কীভাবে জ্বালানির অপচয় রোধ করা যায় তা আপনারা সবাই খুব ভালো জানেন। কারও জানার ঘাটতি থাকলে গিন্নীকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন প্রিপেইড মিটারে টাকা না থাকলে কিভাবে গ্যাস সাশ্রয় করে রান্না করতে হয়। আর রাষ্ট্র এবং বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞজনেরা তো প্রতিনিয়তই এব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপ নিয়ে ও পরামর্শ দিয়ে ধন্য করেই চলেছেন। আমরা যারা মুসলিম বলে দাবি করি তাদের দায়িত্বের কথা তো বললামই। তাহলে অন্যদের কী হবে?
অন্যরা যাদের কাছে ইসলামের বাণী গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারা অন্তত জন্মভূমির ঋণ পরিশোধ করার এই সুবর্ণ সুযোগের সৎ ব্যবহার করুণ! লড়াইটা সবাই মিলে একসাথে করতে না পারলে জ্বালানির জ্বলনি অচিরেই সব ঘরে পৌঁছে যাবে।
মনে রাখতে হবে এ লড়াই আমাদের অস্তিস্ত রক্ষার, মর্যাদা রক্ষার, পাপ থেকে বাঁচার, পূণ্য অর্জনের, পাপ মোচনের লড়াই। সর্বোপরি দেশমাতৃকার সম্ভ্রম রক্ষার লড়াই, আমাদের সন্তানদের সোনালি স্বপ্নগুলো সংরক্ষণের লড়াই। উন্নয়শীল দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে অবিচল থাকার দৃঢ় প্রত্যয়। যে যেভাবেই চিন্তা করুন দলমত নির্বিশেষে লড়াইটাকে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের করে নিতে হবে।
আলোকিত প্রতিদিন/২২ জুলাই ২০২২/জ কা তা