সাতক্ষীরা শ্যামনগরে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে  হাজারঅধিক ম্যানগ্রোভ  গাছ কর্তন

0
269
মোঃ ইব্রাহিম খলিল:
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। এদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা ঘিরে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য নদ নদী। অতীতে বাংলাদেশে নদ নদীর সংখ্যা ছিল ৭০০টি, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০৫ টি। বাংলাদেশের  দক্ষিণ – পশ্চিমঅঞ্চলে  সাতক্ষীরা জেলা অবস্থিত। আর এই জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘিরে রয়েছে  ২৭ টি নদ নদী। এসব নদ নদীর মধ্যে ইছামতী – কালিন্দী নদী অন্যতম গুরুত্ব বহন করছে। ইছামতী – কালিন্দী নদী বাংলাদেশ- ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ৩৭০ মিটার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কতৃক ইছামতী – কালিন্দী নদীর পরিচিতি নম্বর ০৭।  সাতক্ষীরা জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ উপজেলা শ্যামনগর। এই উপজেলার আয়তন ১৯৬৮.২৪ বর্গকিলোমিটার যার মধ্যে বনভূমি এলাকা ১৫৩৪.৮৮ বর্গকিলোমিটার। শ্যামনগর উপজেলা ১২ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইতি পুর্বে সবশেষ ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের বাংলাদেশ – ভারত সীমান্তবর্তী ৫ নং পোল্ডারের কালিন্দী নদীর বেশ কিছু অংশের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরই প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ সংস্কার কাজের অজুহাতে  ঠিকাদারের বিরুদ্ধে হাজারঅধিক কেওড়া, বাইন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ কর্তন করার অভিযোগ উঠেছে। পাউবো সুত্রে জানা গেছে , শ্যামনগর উপজেলার ৫ নং কৈখালী ইউনিয়নের ৫ নং পোল্ডারের শৈলখালী মন্দির অভিমুখ থেকে মুনছুর দফাদারের বাড়ির অভিমুখ পর্যন্ত প্রায় ২,০৭০ মিটার কালিন্দী নদীর ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ সংস্কার  কাজে বরাদ্দ আসে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ ৬১ হাজার নয়শত ৪১ টাকা ৪৬ পয়সা। এ কাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান  গ্যালাক্সি এসোসিয়েট, গ্যালাক্সি হাউস, পূর্ব মজমপুর, ওস্তাদ ভাই সড়ক, কুষ্টিয়া – ৭০০০। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানের সত্বাধিকারী একে এম সামছুজ্জামান ( রবি)। প্যাকেজ নং “ডি আর এম ই পি” সাত-০১/০১/২০২০-২১, ই টেন্ডার আইডি নং ৫৫৫৭৯১। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি নম্বর ৫১,০১, ০০০০,০৪৪,৪০,০০১,২০২০-২১/৭৬৫ তারিখ ০৭/০৩/২০২১। উল্লেখিত কাজের তদারকির দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা পওর বিভাগ ০১ এর উপসহকারী প্রকৌশলী ও শ্যামনগর উপজেলার পাউবো সেকশন অফিসার মাসুদ রানা। কৈখালীর  শহিদুল ইসলাম, আব্দুল জলিল সহ একাধিক ব্যক্তি জানান, কৈখালী কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের শুরু থেকে মুল ঠিকাদারের উপস্থিতি তাদের চোখে পড়েনি। তারা জানান, মুল ঠিকাদারের হাত বদল হয়ে চুক্তিতে কাজটির দায়িত্বভার নেন ৫ নং কৈখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ আব্দুর রহিম। তিনি শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের জয়াখালি গ্রামের মৃত দাউদ শেখের ছেলে। অভিযোগ উঠেছে,  বেড়ীবাঁধ সংস্কার কাজে শ্রমিক দিয়ে নদীর পাড় থেকে হাতে কোদালে মাটি কেটে বাঁধের কাজ সম্পন্ন না করে অধিক লাভের আশায় বশিভূত হয়ে ভ্যেকু মেশিনের মাধ্যমে মাটি উত্তোলন করে বাঁধের কাজ করান। ভ্যেকু মেশিনের মাধ্যমে কাজ করার ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন কালিন্দি নদীর বেড়িবাঁধের চর থেকে এবং বাধেঁর উপরিভাগ থেকে নির্বিচারে হাজার, হাজার  বন্য গাছ কর্তন করেন। কাজের শুরুতে ভেক্যু মেশিন দিয়ে কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের অজুহাতে প্রথমে ২ শতাধিক কেওড়া, বাইন নামিও ম্যানগ্রোভ গাছ কর্তন করেন। নির্বিচারে গাছ কর্তনের ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও সামাজিক বনায়ন বন সংরক্ষণ কর্তাদের গাফিলতির কারনে ২ য় ধাপে ঠিকাদার কর্তৃক হাজার, হাজার ম্যানগ্রোভ গাছ তথা কেওড়া ও বাইন গাছ কর্তনের নিয়মবহির্ভূত অপরাধে লিপ্ত হয়। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কালিন্দী নদীর বেড়ীবাঁধের পাড় থেকে অবাধে গাছ কর্তনের বিষয়টি ইতিপূর্বে শ্যামনগর উপজেলা সামাজিক বনায়ন (বন বিভাগ) কর্মকর্তা মোঃ শহিদুর রহমানকে অবহিত করা সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে তিনি নীরব ভুমিকা পালন করেছেন বলে তারা জানান। তারা আরও বলেন, কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই দ্বিতীয় দফায় বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে হাজারঅধিক কেওড়া, বাইন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ কর্তন করেন। স্থানীয়রা জানান, গাছ আমাদের অকৃতিম বন্ধু। ম্যানগ্রোভ গাছ যুগ যুগ ধরে বেড়ীবাঁধ সুরক্ষায় অনন্য ভুমিকা পালন করে আসছে। তারা আরও বলেন, কর্তনকৃত প্রতিটি কেওড়া ও বাইন গাছের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। এসব বন্য প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ অবাধে কর্তন করায় বর্ষা মৌসুমে বাতাসে সামান্য পানির ঢেউয়ে  বেড়ীবাঁধে ভয়াবহ ধস নামার পাশাপাশি নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হবে। এর প্রভাবে অবাধে লবণ পানি প্রবেশে হাজার হাজার ফসলি জমি ক্ষতি সাধিত হওয়ার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়বে।  যার খেসারত দিতে হবে উপকুলীয় এলাকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। এর দায়ভার নিবে কে  বলে তারা প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্ন রাখেন। তারা আরও বলেন, শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়ন ভাঙ্গন  কবলিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সরকার প্রতিবছর টেকসই বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে বেড়ীবাঁধ  সংস্কার কাজে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। কিন্ত একাধিক হাত বদল হওয়ার কারণে কাজের গুনাগত মান ভালো না হওয়ায় কিছুদিন পরেই বাঁধ ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সরকারি টাকার অপচয় ঘটছে। সত্তর উর্ধে বয়স আবু সাইদ জানান অতীতে কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে হাতে কোদালে মাটি কেটে বাঁধে মাটির কাজ করা হয়েছে। তাতে কোন প্রকার গাছ কাটার প্রয়োজন হয়নি। এখন দেখছি হাজার হাজার বন্য গাছ কেটে ভ্যেকু মেশিনের মাধ্যমে বেড়িবাঁধে মাটি দিচ্ছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভ্যেকু মেশিন দিয়ে মাটি না কেটে শ্রমিক দিয়ে হাতে কোদালে মাটি কাটলে হাজার, হাজার কেওড়া ও বাইন গাছ রক্ষা পেতো। সরেজমিনে  পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কৈখালী কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধের চর থেকে  এবং বাধেঁর উপরিভাগ থেকে  দুই হাজার অধিক কেওড়া ও বাইন গাছ ঠিকাদার কতৃক অবাধে বাঁধ সংস্কারের নামে কর্তন করেছে যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত করলে উপযুক্ত প্রমান মিলবে৷ এ বিষয় শ্যামনগর উপজেলার ৫ নং কৈখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সাব ঠিকাদার শেখ আব্দুর রহিমের সাথে মুঠো ফোনে আলাপ কালে কৈখালী কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধের পাড় থেকে অবাধে হাজার অধিক কেওড়া, বাইন গাছ কর্তনের ব্যাপারে একাধিকবার আলাপের চেষ্টাকালে আলাপ কলটি গ্রহণ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয় গ্যালাক্সি এসোসিয়েট এর স্বত্বাধিকারী রবির সাথে মুঠো ফোনে একাধিকবার আলাপের চেষ্টাকালে আলাপ কলটি গ্রহণ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা পওর বিভাগ ০১ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও শ্যামনগর উপজেলা পাউবোর সেকশন অফিসার মাসুদ রানার সাথে মুঠো ফোনে আলাপকালে গ্যালাক্সি এসোসিয়েট এর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান  কর্তৃক বেড়ীবাঁধের চর এবং উপরিভাগ
থেকে  হাজার হাজার বন্য গাছ কর্তনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাছ কর্তনের বিষয়টি আমি জানিনা।  এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আক্তার হোসেন এর  সাথে মুঠো ফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, গাছ কর্তনের  বিষয়টি আমি শুনেছি। ইতিমধ্যে আমি শ্যামনগর উপজেলা বন কর্মকর্তা কে চিঠি দিয়েছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।  বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা পওর বিভাগ ০১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবুল খায়েরের সাথে মুঠো ফোনে একাধিকবার আলাপের চেষ্টাকালে তিনি আলাপ কলটি গ্রহণ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয় বাংলাদেশ পানি পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা পওর বিভাগ বিভাগ ০১ এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ জাকির হোসেনের সাথে মুঠো ফোনে আলাপকালে, কৈখালী কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক হাজার, হাজার বন্য গাছ কর্তনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাছ কর্তনের বিষয়টি আমি জানিনা বলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা সামাজিক বনায়ন (বন বিভাগ) এর কর্মকর্তা মোঃ শহিদুর রহমানের সাথে মুঠো ফোনে আলাপকালে কৈখালী কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে ঠিকাদার কতৃক অবাধে হাজার অধিক কেওড়া ও বাইন গাছ কর্তনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোন বক্তব্য না দিয়ে নীরাবতা পালন করেন।  এ বিষয় সাতক্ষীরা সহকারী বন সংরক্ষক (বন বিভাগ) কর্মকর্তা নুরুন্নাহার এর সাথে মুঠো ফোনে আলাপকালে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক হাজার হাজার বন্য গাছ কর্তন করার ব্যাপারে তিনি জানেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আজকে অফিসে যোগদান করেছি, অনুমতি ছাড়া গাছ কর্তনের কোন সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন সামাজিক বনায়ন আইনের ২০০৪ সালের নীতিমালা সংশোধন হয়ে ২০১২ সালের আইন অনুযায়ী গাছের বয়সকাল পুর্ন হলে টেন্ডারের মাধ্যমে বন বিভাগ গাছ বিক্রি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সাথে মুঠো ফোনে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী কালিন্দী নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে ঠিকাদার কর্তৃক হাজার, হাজার কেওড়া ও বাইন গাছ টেন্ডার ছাড়াই গাছ কর্তনের ব্যাপারে  আলাপকালে  তিনি বলেন,  টেন্ডার ছাড়া গাছ কর্তনের কোন সুযোগ নেই। বন নীতিমালা অনুযায়ী আইন অমান্য করে যদি কেউ গাছ কর্তন করে থাকে তা হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত  ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ঘটনায় সুশীল সমাজ ও এলাকাবাসী   পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২৫ আগস্ট ,২০২২/ মওম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here