নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতিদিন কতনা গল্প-কবিতা, তথ্য ভিত্তিক আলোচনা লিপিবদ্ধ করি।”মা নেই” একথা কিভাবে লিখি ! লিখতে গেলে হাত চলে না, চোখের কোণে বেদনার অশ্রু জল বেয়ে আসে। মনে হয় ” মা আছে ” হৃদয়ের মনিকোঠায়। মা নেই একথা লিখতে যেয়ে লিখতে পারিনি ! মার কথা ভেবে ভেবে কত না বিনিদ্র রজনী কেটেছে ! কখন যে ভোর হয়ে গেছে ! আবার কখনও মার প্রতিচ্ছবি লালন করে আঁখি নীরবে-নিভৃতে একাকী ঘুমিয়ে গেছি। এখনও অফিস থেকে আসলে মনের ঘোরে মার মোবাইলে রিং দিতে যাই মার কাছে , কি যে কষ্ট ! কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়। আজ মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী।
প্রায় প্রতিদিনই আমার সঙ্গে তাঁর কথা হতো এক / দুইবার মোবাইলে। আনন্দ-বেদনার ও বিভিন্ন দিক নির্দেশনার কথা ভাগ করে নিতাম পরস্পর। কতকথা মায়ের সাথে ! কথার মালা শেষ হতো না ! প্রতিবছর রোজার ঈদ আমার শিকড়ের কাছে তথা যশোরে করতাম। ঢাকা থেকে ঝুক্কি ঝামেলা যানজটের কষ্ট আর থাকতো না , যখন পরিচিত আপনজন দেখতাম তার একটা আলাদা আনন্দ ছিল ! যখন যশোরে মার কাছে পৌছাতাম, বাড়ির কাছ থেকে” ও মা ! মা !” ডাকলেই মা দেখতাম তড়িঘড়ি করে উঠত আর এক দৃষ্টিতে দেখতো আর বলতো ” বাবা পথে বেশ কষ্ট হয়েছে ! কখন গাড়ীতে উঠেছিস যা হাতমুখ ধুয়েনে, ভাত খেয়েনে বাবা।” মার সাথে দেখা মাত্রই পথের সব কষ্ট কোথায় যেন চলে যেত ! প্রশান্তির শীতল ছায়া পেতাম। কতনা কথা বলতো–” মুখটা শুকনা চুল নখ গুলো কতোবড় হয়েছে বাবা” । সবকিছু পরখ করে দেখতো তার কাছে যেন সেই ছোট্ট বাবু ! বাবু ! আজও আছি । মা পান খেতে খুবই পছন্দ করতো। আসার পথে ভুল হতো না , আরিচার নগরকান্দা থেকে মার জন্য পানের খিলি আনতে । হাজার জিনিসের ভিড়ে পান পেলে খুবই খুশি হত । অনেক সময় দেখতাম মা গভীর রাতে হামানদিস্তা দিয়ে পান বেটে খাচ্ছে ! আবার দেখতাম রাতে আমার বুকের উপর কাঁথা ও মশারি ঠিক করে দিয়ে যাচ্ছে – সেতো মা ! এখন যেন সবই স্মৃতি । পিছন থেকে পিছনে সেই বেদনা বিধূর কতনা মধুর স্মৃতি দোলাচলে ঘুরে ! তার কিছু বিষয় আলোকপাত করলামঃ– চিকেনপক্সঃ একবার শৈশবে চিকেন পক্সের আলামত দেখা দিয়েছিল গায়ে জ্বর জ্বর অনুভূত হচ্ছিলো ! এখন যেমন করোনাভাইরাস , তখন কলেরা বসন্ত, ডায়রিয়া, এক অঞ্চলে হলে ঐ অসুখে বহু লোক মারা যেত। সেই রোগের প্রকোপে আক্রান্ত হয়েছিলাম। বাসার সবাই ভাইরাস থেকে নিরাপদ দূরত্ব থাকতো ,ওই সময় সবাই দরজা দিয়ে উঁকি মেরে চলে যেত । কিন্তু মা সমস্ত বাধা ব্যারিকেড ভেঙে নিজের জীবনের পরোয়া না করে ঝুঁকির মধ্য দিয়ে ঘরে আসতো। তখন বয়স অল্প গভীর রাতে কবরস্থান থেকে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক ! আর আমি শৈশব থেকে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক বরাবরই মতোই তখন ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠতাম। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো “বাবা আমি আছি, তুমি ঘুমাও।” নিজের নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিবানিশি সেবা শুশ্রূষার মধ্যে দিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুলেছিল। সে তো আর কেউ না আমার বট বৃক্ষ আমার মা ।
ঈদের সময়ঃ ঈদের সময় আসলে ! মারে কত জ্বালাতাম ! মার সাথে কত মান অভিমান চলতো ! বাসার কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ার সুবাদে আমার প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। মায়ের আঁচলের তলে থাকতাম। ঘুরতাম, ফিরতাম আবার মায়ের সান্নিধ্যে চলে আসতাম। ১৯৫০ দশকে আমার বাবা পাকিস্তান সিভিল সাপ্লায়ার বিভাগে পরিদর্শক পদে চাকুরীতে যোগদান করেন। কিন্তু বিধি বাম সেখানে বসে স্বাধীন চেতা প্রগতিশীল মানুষ মনোভাব এবং কৃষক জনতার ভালোবাসা । পাকিস্তানে দ্বিমুখী নীতি, পুর্বপাকিস্তানের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণের কথা সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় বলায় পাকিস্তান সরকার লাহোর থেকে ট্রাম্পকলের মাধ্যমে তাকে চাকুরীচ্যুত করে । তখন বাবা নাম মাত্র বেতনে খড়কির বেসরকারি কারবালায় স্কুলের চাকরি করতেন এবং বাবা শোষন মুক্ত নতুন সকালের স্বপ্ন দ্রষ্টা ছিলেন ! নিঃস্বার্থভাবে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। আর সমস্ত সংসারের জোয়াল মার কাঁধে। কি নিদারুন কষ্ট ! এদিকে আমরা চার ভাই, সংসার হাড়ি উনুনে চড়ানো থেকে শুরু করে আমাদের ওষুধ পত্র বই খাতা জামা কাপড় সব দায়িত্ব যেন সব মার উপর ! সব কিছু চাওয়া পাওয়া মার কাছে । ঐ দৈন্যতার মধ্যে ঈদের সময় চলে আসলে ! মাকে না কত জ্বালাতাম ! মার সাথে কত মান অভিমান চলত ! একবার ঈদে ,- মা বলত-“বাবা মুখটা ভার কেন। দুদিন পর তো ঈদ।” আমি বলতাম – “কই নাতো মা, আমার কিছু হয়নি ! আমি ঠিক আছি ” মা -“আমার বাবার মুখ টা কালো ! আজকে মার কাছে আসছিস না গলা জড়ায় ধরছিসনা। কি হয়েছে, বাবা ? বাবা বল কি হয়েছে ? ” সেতো মা ! মা সব বুঝে যেত ! ছল ছল চোখে বলতাম, মা ওমা ! “বন্ধুরা সবাই জামা-কাপড় কিনেছে। তখন রেওয়াজ ছিল ঈদের একদিন আগে তথা চাঁদ রাত বন্ধুরা প্রত্যেকে নতুন নতুন আগে জামা কাপড় দেখাত। আর অভিমান করে বলতাম – আর আমারতো মা – জামাই কেনা হয়নি , আমি আর ঈদের দিন বাইরে যাব না। আমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন শ্রদ্ধেয়া মা সব কিছু যেন তার নখদর্পণে । বাবা! ঈদেরতো বাকি আছে ! একটা ব্যবস্থা হবে , দেখতাম মা ঈদের আগের দিন দৈন্যতার মধ্যেও মার্কেট থেকে জামা নিয়ে আসত ! মা বলতো,” আমার বাবা ঈদে দিন জামা পড়ে ঘুরবে না তা কি হয় ! তাহলেতো আমাদের ঈদ হবে না , আদরে সোহাগে কাছে টেনে নিত । শৈশবে যখন যশোর জেলা স্কুলে যেতাম, বই খাতা কলম ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি ঠিকমতো দেখে বলতো ” বাবা স্কুল ছুটি হলে সোজা বাসায় চলে আসবা! আর শিক্ষকের কথা মতো চলবা, কারোর কাছে কোন কিছু গ্রহণ করবা না, সহপাঠীদের নামে নালিশ করবা না। মাথায় হাত বুলিয়ে, শাড়ির আঁচল থেকে আট আনা পয়সা দিয়ে বলতো ক্ষুধা লাগলো টিফিনের সময় কিছু খেয়ে নিও! বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত! তারপর দেখতাম আমার যতদূর দেখা যায় ততক্ষণ দাড়িয়ে থাকত। কোনদিন যদি স্কুল থেকে বাড়ি যেতে দেরি হতো! মা দেখাতাম দাঁড়িয়ে আছে গলির মাথায়।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২৫ জানুয়ারি -২০২৩/মওম