প্রতিনিধি,গাইবান্ধা:
গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের আব্দুল মান্নান ৬৫ বছর বয়সে কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
সুত্র জানায়, পারিবারিক অভাবের কারণে আব্দুল মান্নান কোনোদিন স্কুলে যায়নি। কিন্তু পারিপার্শ্বিক সকল কাজেই এখন শিক্ষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই সব সময় তিনি ভাবতেন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মনে মনে ভাবতেন লেখা পড়া না শেখায় তিনি পদে পদে ঠকছেন। তাই বৃদ্ধ বয়স হলেও আব্দুল মান্নান নাতির ছেলে কাওসার (৫) এর সাথে এ বছর স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর এই নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি উক্ত কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সহপাঠী শিশুদের সাথে বেঞ্চে বসে আছেন আব্দুল মান্নান। শিক্ষকরাও তাকে আন্তরিকতার সাথে সব কিছু শেখাচ্ছেন। প্রথম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর হয়েছে ৩৭। জানা গেছে, বই হাতে নিয়ে নাতি মাহফুজারের ছেলে কাওসারের হাত ধরে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া আসা করেন আব্দুল মান্নান।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে ছয় ভাই, এক বোনের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। সংসারে সব সময় অভাব লেগেই থাকতো। অনেক কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। তখন কখনো লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। সেই দিনগুলোর কথা আজও মনে পড়লে চোখে পানি চলে আসে। বৃদ্ধ বয়সে জীবিকার তাগিদে নিরুপায় হয়ে কিশোরগাড়ি বাজারে ছোট দোকানে পান বিক্রি শুরু করেছি।
তিনি আরো বলেন, গ্রাম অঞ্চলে দোকানগুলোতে বেশিরভাগ বিক্রি হয় বাকিতে। বয়স হওয়ার কারণে, কে কত টাকার বাকি নিলো স্মরণ না থাকায় হিসাব মেলাতে পারি না। তাছাড়া স্মরণ শক্তি কমে যাওয়ায় মনেও থাকে না বেশিক্ষণ। শুধু ইচ্ছে হতো, আমি যদি লিখতে পারতাম তাহলে বাকির খাতায় হিসাব গুলো লিখে রাখতে পারতাম। মূলত বাকি লেনদেনের হিসাব লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরে কাশিয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের সবার সাথে আলোচনা করে আমাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে নেন। এই বয়সে স্কুলে ভর্তি হতে পেরে আমি অনেকটা আনন্দিত। সকালে পুতি কাওসারের সাথে স্কুলে আসি। স্কুল ছুটির পর দোকানে বসে ব্যবসা করি।
ব্যাক্তিগত বিষয়ে আব্দুল মান্নান জানান, কিশোর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। মালেকা ও জান্নাতি নামে দুই মেয়ে ও মমিরুল নামে এক ছেলেসহ তিনি তিন সন্তানের জনক। অনেক আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে মমিরুল পলাশবাড়ী সরকারি কলেজে স্নাতক পরীক্ষার্থী। বড় মেয়ের ছেলে মাহফুজার রহমান বিয়ে করেছেন। এই মাহফুজার রহমানের ছেলের নাম কাওসার। এই কাওসার সম্পর্কে আব্দুল মান্নানের পুতি হয়। সেই পুতির সাথেই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন আব্দুল মান্নান।
এছাড়াও সদ্য শেষ হওয়া বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন আব্দুল মান্নান। সেখানে এই বয়সে মঞ্চে দাড়িয়ে মাইকে বলেছেন একটি কবিতা।
শ্রেনী শিক্ষিকা সুরভী আকতার বলেন, আমার ১২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এত বেশি বয়সী কাউকে আমি শিক্ষা দেয়নি। তাছাড়া আব্দুল মান্নান চাচার শেখার আগ্রহ অনেক। তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন। একজন বৃদ্ধ মানুষকে শেখাতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
মানিক মিয়া নামের আরেক শিক্ষক জানান, শিক্ষার যে কোন বয়স নেই, তা আব্দুল মান্নান চাচা প্রমাণ করেছেন। আমরা শিক্ষকরা খুবই খুশি ।
প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ওরফে মিথুন মন্ডল জানান, আব্দুল মান্নান চাচা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অনুরোধ করে আসছিলেন। আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে চলতি বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি নিয়েছি। তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে এসে শিশুদের সাথে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছেন। সবাই মজা করে ক্লাশ করছে।
আলোকিত প্রতিদিন/ ৮ ফেব্রুয়ারি -২০২৩/মওম