তাঁর ওই ফেসবুক পোস্ট দেখে অনেকেই চিনে ফেলেন, তিনি বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি রবিউল ইসলাম। ফেরারি একজন আসামি দুবাইয়ে গিয়ে কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন রবিউল ইসলাম।

দুবাইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়া একজন বাংলাদেশি। কারণ এর আগে কেউ দুবাইয়ে গিয়ে এত বিলাসী জীবন যাপন করতে করেননি।

যেভাবে পুলিশ পরিদর্শককে হত্যা
পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির আমন্ত্রণে ঢাকার বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মামুনকে ফাঁদে ফেলে বনানীর ওই বাসায় ডেকে নেওয়া হয়। তাঁকে ফ্ল্যাটে নিয়ে বেঁধে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মামুন মারা যান। পরে গাজীপুর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।

আদালতেও প্রতারণা করেন রবিউল
পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাঁকে জেলে পাঠান। প্রায় ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তাঁর আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউল ইসলামের কথামতো তাঁর নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।
এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রাম। তাঁর বাবা নুরুজ্জামান, মা হালিমা বেগম।
রবিউলের গ্রামের বাড়ি কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলমের কাছে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আপনারা যাকে রবিউল বলছেন, সে আমাদের কাছে রবিউল নামে বেশি পরিচিত নয়। আমরা তাকে আরব, হৃদয় বা সোহাগ নামেই চিনি। গ্রামে সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে একদিন সন্ধ্যায় এসেছিল, পরে ওই রাতেই চলে যায়।’
তবে দুই থেকে আড়াই মাস আগে সৌদি আরবে রবিউলের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে জানান চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমি হজ করতে গিয়েছিলাম। সেখানে রবিউলও এসেছিল। আমাকে বলল, কাকা, আপনি সৌদি আসছেন, এখান থেকে দুবাই চলেন। আমি দুই দিনের জন্য সৌদি আসছি। আমার সঙ্গে দুবাই চলেন, আপনার যাওয়া-আসার বিমান টিকিট এবং যাওয়ার সময় কিছু স্বর্ণালংকার দিয়ে দেব।’ তবে রবিউলের সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া হয়নি বলে জানান মাজহারুল আলম।
রবিউলকে ফেরাতে ইন্টারপোলের দ্বারস্থ পুলিশ
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলামের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। সেখানে নাম ব্যবহার করা হয়েছে হৃদি খান। ওই পাসপোর্টের নম্বর ০৩৮৫১৮৮। হত্যা মামলার পর তিনি ভারতে গিয়ে আরাভ খান নাম দিয়ে আরেকটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। জালিয়াতি করে বানানো ওই পাসপোর্টে তাঁর বাবার নাম লেখেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। সূত্র জানায়, রবিউল ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আপন আরাভ নাম নিয়ে দুবাই যাতায়াত শুরু করেন। ওই পাসপোর্ট দিয়ে ইউরোপেও ভ্রমণ করেন।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (খিলগাঁও জোন) শহিদুর রহমান বলেন, জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে।
রবিউলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান জানিয়েছেন।
ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, নিজেকে বাঁচাতে প্রতারণার মাধ্যমে আবু ইউসুফ নামের আরেক যুবককে রবিউল সাজিয়ে আদালতে আত্নসমর্পণ করানো হয়। রবিউলের নাম–ঠিকানা ব্যবহার করে আবু ইউসুফ ২০২০ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাঁকে জেলে পাঠান। প্রায় ৯ মাস জেলে থাকার পর সেই তরুণ একপর্যায়ে সত্য প্রকাশ করে দেন তিনি।
আলোকিত প্রতিদিন/এপি