মুহাম্মদ আবু আবিদ:
হাসানুর জামান অভি, বয়স ২ বছর। চারদিকে কান্নার আওয়াজ, কিন্তু কেন? নানা বাড়িতে এর আগেও সে অনেকবার বেড়াতে এসেছে। সবাই পরিচিত। তবু ছোট্ট এই শিশুর অবুঝ মনে অশান্তির ছাপ। সে খোঁজে তার সবচেয়ে আপন মানুষটাকে। তার মাকে সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। সংবাদ সংগ্রহেও কেউ গেলে তাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের খোঁজ করে।
চলতি বছরের ৩০ শে এপ্রিল চট্টগ্রাম পটিয়ায় গৃহবধূ জেরিন আক্তারের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। ২ মে মঙ্গলবার গৃহবধূর মামা উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মো. রিদওয়ান বাদী হয়ে পটিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এতে জেরিনের স্বামী দিদারুল আলমকে (৩৫) প্রধান আসামি করা হয়। এদিকে ঘটনার পর থেকেই দিদারুল ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা পলাতক। পটিয়া থানায় রিদওয়ানের করা মামলায় দিদারুলের বড় ভাই আবু তৈয়ব (৩৭), তাদের ভাগনে মো. হৃদয়সহ (২২) তিনজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতপরিচয় তিন-চারজনকে আসামি করা হয়।
ঘটনার দিন, ৩০ শে এপ্রিলঃ আনুমানিক সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ জেরিন আক্তারের মা জেসমিন আক্তারের কাছে তার মেয়ের জামাই (দিদারুল আলম) কল দিয়ে জানান, তিনি যেন তাড়াতাড়ি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে আসেন। সেসময় মেয়ের মা(জেসমিন আক্তার) ও মেয়ের বাবা (আমির আলমদার) এক আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য পথে ছিলেন। মেয়ে জামাইয়ের কল পেয়ে দ্রুত ছুটে যান মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। ঢুকে মাত্র বৈঠকখানায় তারা তাদের মেয়েকে মাটিতে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পান। এসময় চিৎকার করে মেয়ের মা বেহুশ হয়ে যান। এলাকার মুরুব্বিরা লাশ দাফনে তাড়াহুড়ো করতে থাকেন। এমতাবস্থায় মেয়ের মামা মো: রিদওয়ান সেখানে উপস্থিত হন। তিনি সবার তাড়াহুড়ো দেখে সন্দেহ করেন। তিনি ভাগিনির শ্বাশুড়িকে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, জেরিন আক্তার স্ট্রোক করে মারা গেছেন। একই উত্তর দেন, জেরিন আক্তারের জা। তারপর জেরিন আক্তারের লাশের দিকে তাকালে রিদওয়ান দেখতে পান,তার গলায় ফাঁসের দাগ রয়েছে। সবার নজরে যখন তিনি এ বিষয়টা আনেন, তখন মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন জানান, জেরিন আক্তার আত্মহত্যা করেছেন। বৈঠকখানার পাশের একটি রুমে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় তারা। অথচ সে রুমের দরজা, জানালা কোন কিছুই নেই। আসলে রুমটিতে কনস্ট্রাকশন কাজ চলছিল। তাদের কথায় মেয়েটির মামা আপত্তি করেন। তিনি তার বন্ধুদের সহযোগিতায় লাশ দাফন করানো থেকে সকলকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। বলা বাহুল্য, ওই রুমটিতে একটি দড়ি ঝুলানো অবস্থায় দেখা যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে আসলে লাশকে ময়নাতদন্তে পাঠায়।
ঘটনার পরের দিন, ১লা মেঃ ময়নাতদন্তের জন্য মেয়েটির নির্ঘুম মামা অপেক্ষা করছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায়। প্রাথমিক রিপোর্ট পাওয়ার পরই ছুটে যান পটিয়া থানায়। অবশেষে রাতে এজহার নেওয়াতে সক্ষম হন মেয়েটির হতভাগ্য মামা। ২রা মে এজহার টি রেকর্ড করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, জেরিন আক্তারের (২২) সঙ্গে ২০২০ সালে দিদারুল আলমের বিয়ে হয়। করোনার কারণে তখন দেশে লকডাউন থাকায় উভয়ের পরিবারের সম্মতিতে ছোট পরিসরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। পরে জেরিনকে শ্বশুরবাড়িতে তুলে আনা হয়। এরপর থেকেই বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী খাওয়ানোর বিষয় নিয়ে জেরিনের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে স্বামীপক্ষ। বিয়ের ১১ মাস পর তাঁর স্বামী কর্মসূত্রে বিদেশে চলে যান। দিদারুলের অনুপস্থিতিতে শ্বশুরবাড়ির লোকজন জেরিনকে বরযাত্রী খাওয়ানোর বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে। বিষয়টি গৃহবধূ তাঁর বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে অবগত করেন। গত ৬ এপ্রিল জেরিনের স্বামী দেশে ফিরে এলে উভয় পরিবার আলোচনা করে আগামী ১৪ মে বরযাত্রী খাওয়ানোর দিন ধার্য করে। কিন্তু গত ৩০ এপ্রিল বিকেলে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থানকালে জেরিনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
এজহারের ৮ দিন কেটে গেলেও গ্রেফতার হয়নি একজন আসামিও। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কারো কারো মতে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আসামী রয়েছেন, তাই তাদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। এদিকে পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ প্রিটন সরকার গত ৮ দিন ধরে একই উত্তর দিচ্ছেন। তিনি জানান, তাদের অভিযান চলছে। খুব তাড়াতাড়ি আসামিরা ধরে পড়বে।
সমাজবিশ্লেষকরা মনে করেন, এজহারের ৮ দিন কেটে যাওয়ার পরও আসামি গ্রেফতার না হওয়ার বিষয়টা ভবিষ্যতে অপরাধীর সংখ্যা বাড়াতে পারে। আর সাধারণ মানুষেরও আস্থা উঠে যেতে পারে আইনের উপর থেকে।
আলোকিত প্রতিদিন / ১০ মে ২০২৩/ দ ম দ