জুন মাইগ্রেন সচেতনতার মাস: মাইগ্রেনের সঙ্গে মানিয়ে নিন

0
182

ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন:

মাইগ্রেন এক ধরনের মাথা ব্যথা। ভুক্তভোগীরাই জানেন এ ধরনের ব্যথা কত দুর্বিষহ হতে পারে। মাইগ্রেন মাথা ব্যথার প্রকৃতি কেমন? মাইগ্রেনের ব্যথা সাধারণ মাথা ব্যথা থেকে আলাদা। সাধারণত মাথার একদিকে হয়, তবে দুই দিকেও হতে পারে।যাদের মাইগ্রেন হওয়ার প্রবণতা আছে, তাদের শব্দ, আলো, গন্ধ, বাতাসের চাপের তারতম্য ও কিছু খাবারের প্রভাবে পুনরায় নতুন করে ভয়ংকর মাথা ব্যথা শুরু হতে পারে। তবে মাইগ্রেনে শুধু মাথা ব্যথাই হয় না, এর সঙ্গে আরো কয়েকটি স্নায়বিক উপসর্গ হয়ে থাকে (যেমন—কিছু আলো বা শব্দের অনুভূতি)। উপসর্গ অনুযায়ী মাইগ্রেনের মধ্যেও অনেক রকমফের আছে। কারো কারো মতে, সে রকম কয়েকটি মাইগ্রেনের উপসর্গ থাকলে মাথা ব্যথা না থাকলেও মাইগ্রেন হয়েছে বলা যেতে পারে এগুলোকে ‘এটিপিক্যাল মাইগ্রেন’ বলে। কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের মাথা ব্যথার আগে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়, যাদের ‘অরা’ বলে। যেমন—চোখে ভিন্ন রকম কিছু দেখতে পাওয়া, কথা বলায় অসংগতি, মুখের এক পাশে বা হাতে বা পায়ে ভিন্ন অনুভূতি হওয়া। মাইগ্রেনের সঙ্গে অরা থাকলে সেটিকে ‘ক্লাসিক মাইগ্রেন’ বলে। মাইগ্রেনের ব্যথা বুঝবেন কিভাবে? কিছু উপসর্গ জানা থাকলে অন্যান্য মাথা ব্যথা থেকে এটিকে আলাদা করা যায় সহজেই। ♦ ব্যথা দুই থেকে ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে। ♦ বমি বমি ভাব হতে পারে। ♦ আলোর দিকে তাকাতে অসুবিধা হতে পারে। ♦ অতিরিক্ত শব্দের কারণে ব্যথা বাড়তে পারে। ♦ ঘন ঘন হাই ওঠা ও কাজে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হতে পারে। ♦ অরা বা পূর্বলক্ষণ থাকতে পারে। কারণ: বংশগত সমস্যা : আমাদের দেহের বেশির ভাগ রোগের ক্ষেত্রে জন্মগত সমস্যা একটি কারণ হয়ে থাকে। মাইগ্রেন এটির ব্যতিক্রম নয়। ♦ মানবদেহের সব কিছু জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই জিনগত সমস্যার কারণে আমাদের মস্তিষ্কে সেরেটোনিন নিঃসরণের পরিমাণ কমে যায়। এ কারণে মস্তিষ্কে ব্যথা নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু উত্তেজিত হওয়ার মাধ্যমে ব্যথার উৎপত্তি হয়। ♦ কিছু খাবার রয়েছে, যা গ্রহণের পর মাইগ্রেনের ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যায় বা হালকা ব্যথার ভাব থাকলে তা পরিপূর্ণ মাইগ্রেনের ব্যথায় রূপ লাভ করে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাবারগুলো হচ্ছে—চকোলেট, পনির, মদ, কোলাজাতীয় পানীয়। ♦ মাইগ্রেনের রোগী যদি সাইনাসের প্রদাহে বা প্রচণ্ড সর্দিকাশি বা ঠাণ্ডায় ভোগে, তাহলেও মাইগ্রেনের ব্যথার প্রকোপ বাড়তে পারে। ♦ প্রচণ্ড ও ভাপসা গরমে মাইগ্রেনের রোগীর মাথা ব্যথার প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ে। অন্যদিকে শীতকালে ঠাণ্ডা বাতাস বেশি লাগলে বা পরিবেশে কুয়াশা বেড়ে গেলে মাইগ্রেনের প্রকোপ বাড়তে পারে।

হরমোনের প্রভাব : মাইগ্রেনের মাথা ব্যথা সাধারণত মেয়েদের বেশি হয়। বয়ঃসন্ধিকালে মাসিক নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের তারতম্য হলে মাইগ্রেনের ব্যথা উঠতে পারে। যাঁরা দীর্ঘদিন জন্ম বিরতিকরণ পিল খাচ্ছেন, তাঁদের ইস্ট্রোজেন সাধারণত বেশি থাকে। তাঁরা মাইগ্রেনের ব্যথার ঝুঁকিতে থাকেন। অনেকের ক্ষেত্রে মাসিকের পূর্বাবস্থায় মাইগ্রেনের ব্যথা উঠতে পারে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ : অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের কারণে শরীরে হরমোনের তারতম্য হলে মাইগ্রেনের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ রক্তচাপ, নিদ্রাহীনতা, হতাশাও মাইগ্রেনের ব্যথার ট্রিগার হতে পারে।অতিরিক্ত চিনিজাতীয় খাবার খাওয়া : হঠাৎ বেশি মিষ্টি খাবার খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়, যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত ইনসুলিনের উৎপাদন হতে থাকে। এর ফলে রক্তের সুগারের মাত্রা নেমে যায়। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ রক্তে সুগারের মাত্রার তারতম্যের কারণে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতে পারে। অতিরিক্ত আওয়াজ : একটানা অতিরিক্ত আওয়াজ, খুব জোরে গান শোনা ইত্যাদির কারণেও মাইগ্রেনের সমস্যা শুরু হয়ে যেতে পারে। মাইগ্রেনের ব্যথায় ব্যায়াম করার নিয়ম: ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর থেকে এন্ডরফিন নামক পদার্থ নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা শরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা কমাতে পারে। ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা যে মরফিন বা পেথিডিন ব্যবহার করি, তা এন্ডরফিন সমগোত্রীয়। ♦ ব্যায়ামের সময় রক্তে গ্লুকোজের সংকট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগে হালকা কিছু খেয়ে নিতে পারেন। ♦ ব্যায়ামের সময় পানিশূন্যতা তৈরি হতে পারে। তাই ব্যায়ামের আগে পরিমাণমতো পানি পান করা ভালো। ♦ প্রথমেই অতিরিক্ত চাপের ব্যায়াম না করাই ভালো। ♦ মাইগ্রেনের অ্যাটাক ব্যায়ামের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে কি না, তা নোট করে রাখতে পারেন। কোন ব্যায়াম মাইগ্রেনের জন্য উপকারী? ♦ ঘাড় ও মাথার ব্যায়াম ♦ জগিং ♦ সুইমিং ♦ সাইকেল চালনা

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন ♦ লাগাতার চোখে দেখতে সমস্যা হলে। ♦ খিঁচুনি থাকলে। ♦ শরীরের কোনো অংশ অবশ অনুভব করলে। ♦ জ্বর ও ঘাড় শক্ত হওয়া থাকলে। ♦ স্মরণশক্তি, শরীরের ব্যালান্স কমে গেলে।মাইগ্রেন ব্যথার চিকিৎসা কী? মাইগ্রেন ব্যথার কোনো অনুমোদিত মেডিক্যাল চিকিৎসা নেই। বিভিন্ন ধরনের পেইনকিলার ব্যবহার করা হয়। এসব পেইনকিলার দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে পেটে আলসার, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার করা ঠিক নয়। মাইগ্রেন ব্যথার রোগীদের করণীয়: ♦ ব্যথা উদ্রেককারী বিষয়গুলো এড়িয়ে চলুন। ♦ চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। যেকোনো বিষয় পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করুন। ♦ দেখানো ব্যায়ামগুলো নিয়মিত করার চেষ্টা করুন। ♦ নিয়মিত সঠিক সময় ঘুমাতে যান এবং সঠিক সময় ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন। ♦ ঘুমের সময় ঘাড়, মাথা স্বাভাবিক পজিশনে রাখার অভ্যাস করুন। শুধু মাথার নিচে বালিশ না দিয়ে ঘাড়ের নিচে বালিশ ব্যবহার করুন। সোফা বা চেয়ারে ঘুম পরিহার করুন। ♦ খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন। যেসব খাদ্যে মাইগ্রেন ট্রিগার হতে পারে, সেগুলো পরিহার করুন। ♦ অবসর সময়ে আপনার প্রিয় জিনিসগুলো উপভোগ করুন। যেমন—বাগান করা, গান, কবিতা, লেখালেখি। ♦ অতিরিক্ত টিভি বা স্ক্রিন দেখা থেকে বিরত থাকুন। আপনার নিয়ম নয়, বরং মাইগ্রেনের নিয়মে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলে মাইগ্রেন আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। ধীরে ধীরে মাইগ্রেন ব্যথার চক্র পরিবর্তিত হবে। মাইগ্রেন আপনার নিয়ন্ত্রণে আসবে।

লেখক : চিফ কনসালট্যান্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, ঢাকা

ঘাড় ও মাথার ব্যায়াম: এই ব্যায়ামে মাথা ও ঘাড়ের মাংসপেশি ও জয়েন্টগুলো সচল এবং রক্ত চলাচল ভালো থাকবে, ঘুম ভালো হবে। ঘাড় ও মাথার সাধারণ ব্যথাগুলো ধীরে ধীরে চলে যাবে। আপনি স্ট্রেস ফ্রি অনুভব করবেন। ♦ ঘাড়ের একটি খুবই কার্যকর ব্যায়াম চিন টাগ। মাথা ও ঘাড় সোজা রেখে এক আঙুল দিয়ে নিজের থুতনি স্পর্শ করুন। এবার ঘাড় শক্ত করুন। একই সঙ্গে থুতনি পেছনের দিকে একটু সরে আসবে। এভাবে পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ড থাকুন। পদ্ধতিটি পাঁচ থেকে ১০ বার করুন। ♦ দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে থুতনিকে নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে চাপ দিন এবং থুতনিকে নিচের দিকে চাপ দিন, যাতে ঘাড় ও মাথা সোজা থাকে। ♦ মাথার ডান পাশে ডান হাত দিয়ে চাপ দিন এবং একই সঙ্গে মাথা দিয়ে হাতের ওপর চাপ দিন, যাতে মাথা সোজা থাকে। পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। একইভাবে বাঁ পাশে করুন। ♦ যেকোনো এক হাতের তালু দিয়ে কপালে চাপ দিন এবং একই সঙ্গে কপাল দিয়ে হাতের ওপর চাপ দিন, যাতে মাথা ও ঘাড় সোজা থাকে। এভাবে পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। ♦ দুই হাতের আঙুলগুলো লক করে তালুর দিকের অংশ দিয়ে মাথার পেছনের দিকে চাপ দিন এবং একই সঙ্গে মাথার পেছন দিক দিয়ে হাতের ওপর চাপ দিন, যাতে মাথা ও ঘাড় সোজা থাকে। এভাবে পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। ♦ পুরো পদ্ধতিগুলো সকাল ও বিকেলে করার চেষ্টা করুন।

আলোকিত প্রতিদিন/ ১৮ জুন ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here