কুমিল্লায় ৩০ বছর পর মুক্তি পেল ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি

0
282

নাজমুল হাসান (কুমিল্লা) প্রতিনিধি :

কুমিল্লা দেবিদ্বার উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে মৃত অক্ষয় চন্দ্র নাহার ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার (৭৭)। ১৯৯৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে জমি জমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জেরে জেঠাতো বোনের জামাই দীনেশ চন্দ্র দত্তকে হত্যার অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহা ও তার ভাই নেপাল চন্দ্র নাহার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে দীনেশের পরিবার। মামলার পর রাখাল চন্দ্রকে আটক করা হলেও নেপাল চন্দ্র নাহা কয়েক বছর পলাতক থাকার পর মারা যান। ওই মামলায় ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিল রাত ১১টায় জেঠাতো বোনের জামাই দীনেশ চন্দ্র দত্তকে হত্যার মামলায় ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষও ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। রাখাল চন্দ্র নাহা গোসল করে হালকা শুকনো খাবার খেয়ে ফাঁসির সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। পরে ওই মৃত্যুদন্ড মওকুফ করার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ কাছে দাবি জানান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির, সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা। রাত ১১ টায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাত্র দেড় ঘন্টা পূর্বে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির দন্ডাদেশ মওকুফের ওয়ারলেস বার্তা পান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিনের নিকট আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফ করে ৩০ বছর সাজা বহাল রাখেন। এরপর ২০০৮ সালের ৩০ জুন তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ সংশোধিত হয়ে যাবজ্জীবন সাজা হয়। তার অর্জিত রেয়াত ছিল ৫ বছর ৭ মাস ২ দিন। সংশোধিত তারিখ অনুযায়ী রাখাল চন্দ্র নাহার দীর্ঘ ২৪ বছর অন্ধকার কারাগারে থাকার পর গত রোববার (২ জুলাই) সকালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার মুক্তির খবরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে।
মুক্তি পেয়ে গতকাল সোমবার সকালে রাখাল চন্দ্র নাহার বাড়িতে গণমাধ্যম কর্মীরা ছুটে গেলে সাক্ষাৎকারে বলেন, যেদিন দীনেশ কে হত্যা করা হয় সেদিন আমি বাড়ি ছিলাম না, আমার সম্পত্তি ভোগ দখল করার জন্য আমাকে দীনেশ হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। সবাই জানত রাতে আমার ফাঁসি কার্যকর হবে। এজন্য দিনের বেলাও অনেক আসামী ও কয়েদী পুলিশ আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। রাত ১১ টায় আমার ফাঁসির সময় দেওয়া হয়েছে। আমি গোসল ও হালকা শুকনো খাবার খেয়ে সেলে বসে ছিলাম। বুক তখন ধরফর করে কেপে উঠছিল, চোখে মুখে বাঁচার আকুতি ছিল, সেলে কেউ আসলেই মনে হতো এই বুঝি আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যেতে এল। মৃত্যুদন্ডের দেড় ঘন্টা আগে এক কারা পুলিশ এসে আমাকে জানায় রাষ্ট্রপতি নাকি আমার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছে। সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার মৃত্যুদন্ড মওকুফের খবর পেয়ে পুরো কারাগারেও আনন্দ করেছে অন্য কয়েদী ও সাধারণ আসামীরা। আমি সে দিন আনন্দে চিৎকার দিয়েছিলাম। কান্না করতে করতে তিনি আরও বলেন আমি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এ দেশই আমাকে বিনা কারণে ৩০ বছর কারাগারে রেখেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহারের স্ত্রী গীতা রানী নাহা বলেন, যখন আমার স্বামী জেলে যায় তখন আমার বয়স ছিল ২৫ বছর। এখন আমার বয়স ৬৫ বছর। আমার ৪ ছেলে ১ মেয়ে রয়েছে। একটি মিথ্যা মামলায় আমার সংসার জীবন কে উলটপালট করে দিয়েছে। আমি আমার ৫ সন্তান কে ছেড়ে কোথাও যায়নি। আমি সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি যেন এই মিথ্যা সাজানো মামলা থেকে আমার স্বামীকে মুক্ত করে দেয়। আর আমার স্বামী কবে মুক্তি পাবে সে অপেক্ষা পহর গুনছিলাম। এ বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আরও বলেন, আমার চার সন্তানের মধ্যে কেউ শিক্ষিত নয়। তাদের বাবা জেলে যাওয়ার পর অর্থের অভাবে পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করেছি, ঠিক মত ছেলে-মেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারিনি। আমার সন্তানদের কাউকে লেখা পড়া করানোর মত অর্থ না থাকার কারণে তাদের পড়া লেখা করাতে পারেনি। দীর্ঘ ২৪ বছর পর আমার স্বামী জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে আমি অনেক খুশি।

আলোকিত প্রতিদিন/ ৪ জুলাই ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here