৬ ‘শ বছরের পুরানো আগর আতর শিল্প মৌলভীবাজারে

0
1410

এস.এম. জালাল উদদীন:

সবুজ উচু নিচু টিলায় টিলায় সারি সারি করে সৃজিত গাছের চারা। নাম তার আগর। সবুজ অরণ্যে একাধারে চলছে পূর্ণ হওয়া গাছগুলো কর্তন এবং নতুন চারা রোপণের কাজ। সুনিপুণ হাতে এ কাজটি সম্পাদন করতে রয়েছেন কয়েক হাজার দক্ষ শ্রমিক। সবার প্রচেষ্টায়ই গড়ে উঠেছে প্রকৃতিনির্ভর আগর শিল্প। বিশ্বের প্রাচীন শিল্প হওয়া সত্ত্বেও বড়লেখার আগর শিল্পটি সরকারি খুব একটা পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও বর্তমান সরকারের আমলে এই আসনের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আলহাজ মো. শাহাব উদ্দিন এমপি আগর আতরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আগর আতর শিল্পে রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায় ৬ ‘শ বছর ধরে চালু রয়েছে এ শিল্প। আগর শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন দেড় লক্ষাধিক নারী ও পুরুষ। বৈদেশিক আয়ের উৎস হিসেবে আগর শিল্প একটি স্বকীয় অবস্থান দীর্ঘ দিন থেকে তৈরি করেছে। কিন্তু প্রাচীন এ শিল্প হালে শিল্পের মর্যাদা পাচ্ছিলো না। এর জন্য সংশ্লিষ্টরা সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন। এ শিল্পের সাথে জড়িতদের অভিযোগ, অনেক আবেদন-নিবেদনের পর চুলোয় গ্যাস সংযোগ পাওয়া গেলেও গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিল্পের মর্যাদা পাচ্ছে না। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হয়। ফলে ইউনিট প্রতি প্রায় ১০ টাকা বাড়তি বিল গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। আগর শিল্প গড়ে ওঠায় বড়লেখার সুজানগর আগর গ্রাম হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে সেই কবে থেকে। এ সুখ্যাতির অংশীদার দক্ষিণভাগ এলাকাও। সারা বিশ্বে বড়লেখার আগর ছড়িয়ে পড়ায় ব্যবসায়িকভাবে শিল্প সংশ্লিষ্টরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর এ শিল্পকে নিয়ে তেমন আগ্রহী হয়ে উঠেনি এতো বছর পরও। ফলে আর্থিক দিক দিয়ে কারখানা মালিকপক্ষ লাভবান হলেও সরকারের সম্পৃক্ততা না থাকায় বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা এসব কারখানায় প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এ শিল্পের জন্য বড়লেখায় নির্দিষ্ট একটি শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলে আরও অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান অনায়াসে করা সম্ভব। বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত এ শিল্পের উন্নতির জন্য সকল প্রকার চেষ্টা করা হচ্ছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে। সরকারও আন্তরিক এটি নিয়ে। বর্তমান সরকার এটিকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে। আগর-আতর কুটির শিল্প রক্ষা কমিটির দায়িত্বশীল ও প্রতিষ্ঠিত সফল ব্যবসায়ী কবির আহমদ জানান, প্রায় ৬০০ বছর ধরে আমাদের এ অঞ্চলে আগর থেকে আতর উৎপন্ন করা হচ্ছে। সুজানগরের আগর এখন ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বে সর্বোৎকৃষ্ট মানের আতর একসময় একমাত্র সুজানগর এলাকায় উৎপন্ন হলেও এখন সুজানগরসহ বড়লেখার বিভিন্ন এলাকায় এবং পার্শ্ববর্তী জুড়ী, কুলাউড়া, বিয়ানীবাজারেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে-জালালাবাদ গ্যাস এ শিল্পকে শিল্প হিসেবে গণ্য করছে না। ফলে প্রতি মাসে দ্বিগুণ গ্যাস বিল দিতে হয়। মজুরির বিষয়টি শুধু নারী শ্রমিক নয়-সবার ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আগর আতর শিল্পের বিখ্যাত সুজানগরকে আগর আতরের রাজধানী বললেও ভুল হবে না। নার্সারিতে বীজ বোনা, আগর গাছের চারা উত্তোলন ও বিক্রি থেকে শুরু করে কারখানার চুলোয় যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ শিল্পের সাথে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। বিবাহিত ও মধ্যবয়সী এসব নারী শ্রমিক পারিবারিক কাজের ফাঁকে কারখানায় ও কাজ করে থাকেন। পরিত্যক্ত ঝোঁপ-ঝাড়বেষ্ঠিত টিলা ও উঁচু সমতলভূমি একসময় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল থাকলেও আজ তা শিল্প কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ দু’ইউনিয়নের এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, বাড়ির লোকজন আগর শিল্পের সাথে জড়িত নন। এ শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে গাছ ক্রয় করে রাখেন। অভাব-অনটনে পড়ে দরিদ্র এলাকাবাসী ১/২ বছরের চারা গাছও হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন। কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক দুই উপায়েই আগর থেকে সুগন্ধিজাতীয় আতর বা পারফিউম উৎপাদন করা হয়। মোগল আমলে বৃহত্তর সিলেটে আগর শিল্পের সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। যদিও পরবর্তীতে সে শিল্পটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে সিলেটের বড়লেখা, সুনামগঞ্জ ও ছাতকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আতর উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও অনেকেই আগর চাষ করছে। তবে সুজানগর এলাকার প্রায় ৯৯% পরিবারে এ শিল্পের সংশ্লিষ্টতা থাকায় সুজানগরকে আগর আতরের রাজধানী ও বলা চলে। সুজানগর ইউপি চেয়ারম্যান বদরুল ইসলাম দৈনিক আলোকিত প্রতিদিনকে জানান, সুষ্ঠু  তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবসায়ীদের সাইটিস প্রদান এবং সকলের সমন্বয়ে ব্যবসায়ীদের সুযোগ প্রদানসহ শিল্পের রেটে গ্যাস প্রদানের দাবি সরকারের প্রতি। তিনি এ শিল্পকে বিশ্ববাজারে জায়গা দখলে নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

আলোকিত প্রতিদিন/ ১০ জুলাই ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here