৪ দশকেও জুড়ীর ইউরেনিয়াম উত্তোলনের উদ্যোগ নেই

0
1437

এস. এম. জালাল উদদীন:

দেশের একমাত্র তেজস্ক্রিয় পদার্থ মূল্যবান খনিজ সম্পদ ইউরেনিয়াম আবিস্কৃত হয়েছে দেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায়। খনিজ সম্পদ নিয়ে প্রায় ৬ বছর আগে বিস্তারিত রিপোর্ট জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও ৪১ বছরেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সরকার। একাধিক সূত্র জানায়, মূল্যবান খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ জেলার জুড়ী উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নের হারাগাছা (ষাড়েরগজ) পাহাড়ে প্রায় ৪৮ বছর আগে আবিষ্কৃত হয় মূল্যবান খনিজ সম্পদ ইউরেনিয়াম। যখন তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইউরেনিয়াম আবিষ্কৃত হয় তখন সাগরনাল ইউনিয়নটি কুলাউড়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ২০০৪ সালে জুড়ী উপজেলার সীমানা নির্ধারণকালে সাগরনাল ইউনিয়নটি জুড়ী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। জেলা সদর থেকে প্রায় ৬১ কিলোমিটার দূরে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ হারাগাছা (ষাড়েরগজ) পাহাড়ে এর অবস্থান। ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়ার ৪৮ বছর পরও উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে মূল্যবান এ খনিজ সম্পদটি চরম অবহেলায় পড়ে আছে। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজার জেলার তৎকালীন কুলাউড়ার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাগরনাল ইউনিয়নের হারাগাছা পাহাড়ে সন্ধান পাওয়া যায় ইউরেনিয়ামের। পরবর্তীকালে তৎকালীন সিনিয়র ভূ-তত্ত্ববিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে কমিশনের একটি দল হারাগাছা পাহাড়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেন। কমিশনের অনুসন্ধানে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির সম্ভাবনাও নিশ্চিত হয়। তারপরও খনিজ পদার্থ আহরণ বা উত্তোলনের ব্যাপারে তখনও কোনো পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। ১৯৮০ সালে পুণরায় দেশের একমাত্র ইউরেনিয়াম প্রকল্প এলাকা হারাগাছা পাহাড়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা হয়। সেইসাথে অন্যান্য খনিজ সম্পদের ব্যাপারেও ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়েছিলো। পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে প্রকল্পটির কার্যক্রমগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে আবারও অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়। সে সময়ে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের সিনিয়র ভূত্ত্ববিদ ড. ইউনূস জাপানের আণবিক জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাগারে হারাগাছা এলাকা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার পর এখানে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব পুণরায় নিশ্চিত করেন। সেই সাথে এ পাহাড়ে তেল, গ্যাস ও কয়লা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হারাগাছা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামের আরও প্রায় তিন শতাধিক স্থানে প্রতি ১০ লাখ মাটিকণার মধ্যে ৫০০-১৩০০ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম কণা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এসব স্থানে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির হার ৫০০-১৩০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। আণবিক শক্তি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পারমাণবিক বোমা তৈরি এবং পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহৃত হয়। ২০০৯ সালের শেষ সময়ে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উপাদান ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রয়োজন। ২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এনামুল হক সিলেট সফরকালে বলেছিলেন, জুড়ী উপজেলায় আবিষ্কৃত ইউরেনিয়াম আকরিক প্রকল্পটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে আণবিক শক্তি কমিশন। প্রাথমিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবার পর জুড়ীতে আবিষ্কৃত ইউরেনিয়াম আকরিক প্রকল্প থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু অদ্যাবধি বাস্তবে এ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর এবং পারমাণবিক শক্তি কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ১৯৮৫ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া (বর্তমানে জুড়ী) উপজেলার সাগরনাল এবং সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম অনুসন্ধানের জন্য গত ৩০ বছরে ওইসব এলাকায় ৩০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সহাতায় এ কাজ করে পারমাণবিক শক্তি কমিশন। পরবর্তীতে পারমাণবিক শক্তি কমিশন খনন কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে আর নতুন কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- দেশে যখন নতুন করে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে তাই সরকার জুড়ীর হারাগাছায় ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ শুরু করবে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, ইউরেনিয়াম, কাঁচবালি, চীনামাটি, কঠিন শিলা, পিট কয়লা, ভারি মেটাল ও লাইম স্টোন। মূল্যবান এসব খনিজ সম্পদের প্রায় সবক’টিরই অস্তিত্ব রয়েছে সিলেট বিভাগে। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে বড়লেখার হাকালুকি হাওরে পিট কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। খনিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হলে মাথাপিছু এ দেশের জাতীয় আয় দাঁড়াবে ৮২৫ ডলার থেকে সাড়ে ৩ হাজার ডলারে। শুধু ইউরেনিয়াম নয় মাধবকুণ্ডের পেছনে বিওসি টিলায় তেল উত্তোলন শুরু করার পরও তৎকালীন সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল হঠাৎ করে তেল উত্তোলন বন্ধ করে দেয় রহস্যজনক কারণে। বাপেক্সও কোনো উদ্যোগ নেয়নি অদ্যাবধি। তবে বাপেক্স বোবারথলসহ বিভিন্ন এলাকায় একাধিকবার তেল-গ্যাসের সম্ভাব্যতা যাচাই করে গেলেও কোনো লাভ হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হারাগাছা পাহাড়ই নয় সিলেট জেলার জৈন্তাপুরে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়াম আহরণ করলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হবে। এমনকি বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াতে পারবে। এছাড়া বড়লেখা উপজেলার সীমান্তবর্তী বোবারথল, সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা, সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার কৈলাশটিলায়ও ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এবিষয়ে ২০১২ ও ২০১৭ সালে জুড়ী অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক এস. এম. জালাল উদদীন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি লিখিত আবেদন করেছিলেন মহামূল্যবান এ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক বরাদ্দ, যন্ত্রপাতি ও জনবল না থাকার কারণে এ এলাকার খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলেও রহস্যজনক কারণে সরকারের সংশ্লিষ্টমহল এ বিষয়ে তেমন কোনো গুরুত্বারোপ করেননি। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মী আলোকিত প্রতিদিনকে জানান, মৌলভীবাজারের জুড়ীতে ইউরেনিয়াম, মাধবকুণ্ডের পেছনে সীমান্তবর্তী বিওসি টিলা ও ফুলছড়া চা বাগানে তৈলসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করা হবে। মৌলভীবাজার-২ কুলাউড়া-কমলগঞ্জ আসনের এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ আলোকিত প্রতিদিনকে জানান, মূল্যবান খনিজ সম্পদের সন্ধান লাভ বা আবিষ্কারই বড় কথা নয়, সেই সম্পদ আহরণ ও দেশ বিনির্মাণে তা ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। ষাড়েরগজ পাহাড়ে প্রাপ্ত খনিজদ্রব্য উত্তোলন সম্ভব হলে তা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। জানা যায়, মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-জুড়ী) আসনের সাবেক এমপি ও ঠিকানা গ্রুপের চেয়াম্যান এম এম শাহীন ২০০৪ সালের ১১ অক্টোবর এ অঞ্চলেন খনিজ দ্রব্য উত্তোলনের প্রসঙ্গ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। তৎকালীন স্পিকার কার্যপ্রণালী বিধির ৭১বিধি অনুসারে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে এটি গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে স্পিকার, বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিদের সমর্থন থাকার পরও রহস্যজনক ভাবে শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত হয়ে যায়। বন, পরিবেশ ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রী আলহাজ শাহাব উদ্দিন আহমদ এমপি আলোকিত প্রতিদিনকে বলেন, ষাড়েরগজ এলাকার মূল্যবান খনিজদ্রব্য উত্তোলন সম্ভব হলে অর্থনীতির দ্বার উন্মোচিত হবে। মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের সাবেক এমপি থাকাবস্থায় তিনি খনিজদ্রব্য উত্তোলনে জাতীয় সংসদে ডিউলেটার দিয়েছিলেন।

আলোকিত প্রতিদিন/ ১৯ জুলাই ২৩/এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here