স্বপ্নের হাতছানিতে মৃত্যুযাত্রা

0
176

 

উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই, যাত্রাপথে শিকার হতে হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতনের, নির্যাতনের মুখে মুক্তিপণ হিসেবে দেশ থেকে স্বজনদের পাঠাতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা

 

আলোকিত ডেস্ক:

ইউরোপে কোনোভাবে পা রাখতে পারলেই হলো। কিছুদিন চেষ্টা করলেই থাকা ও কাজের অনুমতিপত্র মিলে যাবে। কাগজ পেয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই। যাত্রাপথে শিকার হতে হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতনের। দিতে হচ্ছে মুক্তিপণ। সবশেষ জেলও খাটতে হচ্ছে। লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন একটি পথ বেছে নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা। বাংলাদেশ থেকে দুবাই, ইরান হয়ে তুরস্ক যাচ্ছে শত শত মানুষ। আর যাওয়ার পথে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি সঙ্গে থাকা সর্বস্ব হারাচ্ছেন বিদেশগামীরা। নির্যাতনের মুখে মুক্তিপণ হিসেবে দেশ থেকে স্বজনদের পাঠাতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। গড়ে ৮-১০ লাখ টাকা খুইয়ে তুরস্কে পৌঁছার পর কেউ কেউ অবৈধ পথে প্রবেশ করছেন ইউরোপের অন্যান্য দেশে। আবার অনেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জেল খেটে শূন্য হাতে ফিরছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ৮-১০টি জেলার মানুষের মধ্যে অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রার প্রবণতা প্রবল। এর মধ্যে শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ একটি জোন। সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার আরেক জোন। আরেকটা জোন হলো ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো- নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অন্যতম। মানব পাচারকারী চক্রে ফাঁদে পড়া অসংখ্য তরুণ-যুবকের একজন হারিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা নাঈম (ছদ্মনাম)। দেশ ত্যাগের প্রায় এক বছরে সবকিছু হারিয়ে তুরস্ক থেকে শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন তিনি। ২০২২ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় দেশে ফেরা সম্ভব হয়েছে তার। গত এক বছরে নাঈমের মতো আড়াই হাজার অবৈধ অভিবাসী বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সিআইডির বিশেষায়িত একটি টিমের সংগ্রহ করা তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে। এক থেকে ৫-৭ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থাকার পর তাদের দেশে ফেরার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। বাংলাদেশ-দুবাই-ইরান হয়ে তুরস্কে যাওয়ার পথে শতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে নাঈমের। সেসব ঘটনা ও নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তিনি জানিয়েছেন নিউজবাংলাকে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে অবৈধ উপায়ে ইউরোপ যাত্রায় ব্যবহৃত দুবাই-ইরান-তুরস্ক রুটের ঝুঁকির চিত্র। এদিকে বাংলাদেশ-ভারতে এ চক্রের সদস্যরা ভুয়া ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি দেখিয়ে তরুণদের কৌশলে ফাঁদে ফেলে। প্রথমে দেশে কয়েক দফা তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। পরে তাদের পাঠানো হয় ভারত। বলা হয়, সেখান থেকে তাদের ইউরোপ পাঠানো হবে। এরপর সেখানেও ধাপে ধাপে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে হোটেল রুমে জিম্মি করে রাখা হয়। টাকা না দিলে নেমে আসে নির্যাতন। গত বছরের শুরুতে ভারত থেকে কোনোমতে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন ৯ তরুণ। এদের মধ্যে দুজন মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সিলেট ও যশোর থেকে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুদেশের এ চক্রের দেওয়া জাল ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট, আর্থিক লেনদেন, চুক্তিপত্র ও অডিও কথোপকথনসহ বিভিন্ন তথ্য হাতে এসেছে। আল-আমিনের বাড়ি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। তিনি ওই চক্রের কাছে ১৫ লাখ টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সম্প্রতি ভারত থেকে পালিয়ে এসেছেন তিনি। ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন আল-আমিন। এজন্য জমি বিক্রি করে সব প্রস্তুতি নেন। এ সময় তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে সিলেটের ‘এ ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মাসুক আহমদ মাসুম ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে ক্রোয়েশিয়ার ভিসা প্রসেসের চুক্তি করেন। ১৫ দিনের মধ্যেই ক্রোয়েশিয়ার ওয়ার্ক পারমিটও করে ফেলেন। একপর্যায়ে আল-আমিনকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে ইন্ডিয়ান দূতাবাসে ভিসার জন্য। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা। এরপর আখাউড়া হয়ে ভারতের দিল্লিতে পৌঁছেন আল-আমিন। ইতোমধ্যে তার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মাসুক আহমদ মাসুমসহ চক্রের অন্য সদস্যরা। ভারতে যাওয়ার পর একই চক্রের সদস্যরা তাকে ইউরোপের ভুয়া ভিসা দেখিয়ে ফের টাকা আদায় করে। কিন্তু তার ইউরোপ যাওয়া তো দূরে থাক, বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানের কাছে দেশে ফেরাই অনিশ্চিত পড়ে। চক্রের সদস্যরা তার পাসপোর্টও কেড়ে নেয়। একপর্যায়ে আল-আমিন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। প্রায় ৬ মাস পর গত  ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর নিঃস্ব হয়ে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি। ইউরোপের দেশ ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন নবাবগঞ্জের যুবক সাইদুর রহমান। ১৫ লাখ টাকায় ইতালিতে পাঠানোর চুক্তি হয় তুহিনুজ্জামান ভূঁইয়ার সঙ্গে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় থাইল্যান্ডে। সেখান থেকে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া হয়ে টোগোতে নিয়ে আটকে রাখা হয় সাইদুর রহমানকে। করা হয় চরম নির্যাতন। এরপর পরিবারের কাছ থেকে দুই কিস্তিতে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় তুহিনুজ্জামান ভূঁইয়ার চক্র। গত ২ এপ্রিল দেশে ফেরেন সাইদুর। এরপর তিনি ১৩ জুন গুলশান থানায় মানব পাচারকারী তুহিনুজ্জামান ভূঁইয়াসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সাইদুর বলেন, টোগোতে তাঁর সঙ্গে একই হোটেলে ২৫ জন বাংলাদেশিকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাঁদের ভাগ্যে কী জুটেছে, তা বলতে পারেন না। ভাগ্য ফেরাতে চাঁদপুরের যুবক ইয়াসিন যেতে চেয়েছিলেন স্পেনে। পাচারকারী নুরুল আলম সুমনকে তিনি ৪ লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা স্পেনে যাওয়ার পর দেবেন বলে চুক্তি হয়। কিন্তু তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হয় টোগোতে। বিদেশের মাটিতে তাঁকে নির্যাতন করে দেশে আরও ৬ লাখ টাকা আদায় করা হয় পরিবারের কাছ থেকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে তিনি দেশে পালিয়ে আসেন। এরপর দেশে ফিরে গুলশান থানায় গত ১৩ জুন নুরুল আলম সুমনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আর পোল্যান্ডে নেওয়ার কথা বলে ময়মনসিংহের মাসুম সরদারকে মানব পাচারকারীরা নিয়ে গিয়েছিল উজবেকিস্তানে। তিনি ৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা দেশে থাকতেই দিয়েছিলেন মানব পাচারকারী ইয়াসির বারীকে। উজবেকিস্তানে একটি জঙ্গলে আটকে রেখে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয়। গত ৩ জুন দেশে পালিয়ে এসে ইয়াসির বারীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। এভাবে অনেক তরুণ ভাগ্য ফেরানোর আশায় বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতাও করুণ। এদিকে পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পড়ে দেশ ছেড়েছেন এই তরুণ-যুবকেরা। তাঁরা রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন দুবাইয়ের বৈধ টুরিস্ট ভিসা–তারপর লিবিয়া আর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ। এই দুর্গম পথ তাঁরা পাড়ি নিচ্ছেন নৌকায় করে। এভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছেন। ট্রলারস্পিডবোটে পারস্য উপসাগর পাড়ি: গাড়িতে করে নেয়ার পর হান্নান চার বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেন। পরে নাঈমসহ অন্যদের গাড়িতে করে সমুদ্র বন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সমুদ্র বন্দরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদেরকে জোর করে একটি মাছ ধরার ট্রলারে উঠানো হয়। ওই ট্রলারে তারা একসঙ্গে ৫৩ জন বাংলাদেশি ছিলেন। যাওয়ার পথে তাদের ট্রলার নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ৪টি স্পিডবোটে ভাগ করে সবাইকে তুলে ইরানের সীমান্তে নিয়ে যায় পাচারকারীরা। ইরানের বন্দর আব্বাসে নেমে আসে আমানুষিক নির্যাতন: স্পিডবোটে বন্দর আব্বাসে পৌঁছার পর সেখান থেকে ৫-৬টি মাইক্রোবাসে করে সবাইকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে দুটি রুমে আটকে রাখে চক্রটি। এরপর পালাক্রমে ৫-৬ জন মিলে দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। বেধড়ক মারধর করে চাওয়া হয় মুক্তিপণ। নাঈম বলেন, ‘ওদের কথামতো মুক্তিপণ দিতে না চাওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে আলী হোসেন ও হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা একটি একাউন্ট নম্বর দিলে সেখানে আমার ভাই ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠায়। টাকা দেয়ার পর ইরানিরা আরও টাকা চায়। আলী ও হান্নানকে অনুরোধ করে নিজের অপারগতা প্রকাশ করলে ইরানিরা তিন দিন পর আমাদেরকে গাড়িতে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।’ দুর্গম মরুযাত্রা: বন্দর আব্বাস থেকে গাড়িতে করে ৫৩জনকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। মরুভূমিতে সারাদিন আটকে রাখার পর রাতে শুরু হয় সিরাজ শহরের উদ্দেশে যাত্রা। নাঈম বলেন, ‘মরুভূমিতে সারাদিন আটকে রাখার পর আফগান, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি নারী-পুরুষ মিলে ১০০ জনের মতো লোককে ৬টি গাড়িতে একটি স্থানে নেয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে ৬ ঘণ্টা হেটে ও দৌড়ে আমাদেরকে মেইন রোডে নিয়ে তোলে পাচারকারীরা। আরও ৩-৪ ঘণ্টা পর দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমাদেরকে গাড়িতে করে ইরানের সিরাজ শহরে নেয়া হয়। সিরাজ শহরে নাঈমসহ অন্যদের রিসিভ করে আলীর ছেলে সাব্বির। নাঈম জানান, সিরাজ শহরে এশিয়ান, আফ্রিকান অনেককে নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে দুই-একদিন এখানে রেখে নিয়ে যাওয়া হয় ইরানের রাজধানী শহর তেহরানে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি: তেহরানে নাঈমসহ তিনজনকে আলাদা আলাদা রুমে রাখা হয়। পরদিন হান্নানের পরিচিত এক বাংলাদেশি মিজাদুলের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় নাঈমকে। নির্যাতন আর দুর্গম যাত্রার ধকলে সেখানে যাওয়ার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নাঈম বলেন, ‘আলী হোসেনকে টাকা দেয়ার পর আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর সহ্য করতে না পেরে মিজাদুলকে বলি আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু মিজাদুল জানিয়ে দেন- সেজন্য দেড় লাখ টাকা লাগবে। আর তেহরান থেকে তা সম্ভব নয়। প্রথমে তুরস্কে পাঠিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।’ তুরস্কে পৌঁছে পুলিশের হাতে ধরা: মিজাদুলের কথায় রাজি হলে একটি গাড়িতে করে নাঈমসহ চারজনকে তুরস্কে পাঠানো হয়। রাতের আঁধারে তারা তুরস্কে প্রবেশ করেন। সেখানে তাদেরকে একটি ‘সেফ হোমে’ রাখা হয়। সেখানে দেড় লাখ টাকা দেয়ার পর তাকে দালালদের মাধ্যমে পাঠানো হয় তুরস্কের তাৎবান শহরে। নাঈমের ভাষ্য, ‘১৮ মে মিজাদুলকে দেড় লাখ টাকা দেয়ার পর গাড়িতে করে আমাদেরকে একটি নদীর পাড়ে নামিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে জাহাজে ৪ ঘণ্টা যাওয়ার পর দুটি পাহাড়ের মাঝে আমাদের নামিয়ে দেয় দালাল। সারারাত হাঁটার পর তাৎবান শহরে পৌঁছাই। একটি রুমে রাখা হয় ৩ ঘণ্টা। পরে মিজাদুল একটি প্রাইভেট কার পাঠায়। কারে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নামিয়ে দিয়ে বলা হয় আমাদেরকে নিতে বাস আসবে। কিন্তু বাস আর আসেনি। চার ঘণ্টা পর মিজাদুল একটি ট্যাক্সি পাঠায়। ট্যাক্সিতে করে তাৎবান শহরে পৌঁছাই। দুদিন পর মিজাদুল ও আলী হোসেন একটি গাড়ি পাঠান। তাতে উঠিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় তুরস্কের আদানা শহরে। সেখান থেকে ইস্তাম্বুল যাওয়ার পথে চেকপোস্টে পুলিশ আমাদের আটক করে। ১১ দিন কারাগারে থাকার পর মুক্তি পাই।’ বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি আইওএমএর সহায়তায় দেশে ফেরা: তুরস্কের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলাদেশ অ্যাম্বেসিরর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন নাঈম। কিন্তু বাদ সাধে তার সঙ্গে কোনো কাগজ না থাকা। বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করে আউট পাস ম্যানেজ করে দেশে ফিরতে আরও ছয় মাস লেগে যায় তার। ২০২২ সালের ২৮ মার্চ দেশে ফেরেন নাঈম। দেশে ফেরার পর আলী ও তার চক্রের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেন তিনি। উপায় না পেয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। আসামি করা হয় চক্রের প্রধান আলী হোসেন, দুবাইয়ে বসবাসকারী আব্দুল হান্নান, ইরানে থাকা মিজাদুল, আলী হোসেনের স্ত্রী রাশিয়া বেগম, শাহাদাৎ হোসেন ও সাব্বিরসহ অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনকে। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের প্রবণতার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ১৮টা রুট আছে। সবচেয়ে প্রচলিত রুট হচ্ছে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি বা গ্রিসে যাওয়া। গত ১৩-১৪ বছরে ৬৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি এভাবে ইউরোপে ঢুকেছে। তাদের অর্ধেকের বেশি ঢুকেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে। দুবাই থেকে ইরান, তুরস্ক বা গ্রিস হয়ে ইউরোপে প্রবেশও এখন কমন একটি রুট। অনেক বছর ধরেই এই রুটে অবৈধভাবে লোকজন যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বর মাসে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিনিধিসহ অন্য কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে তারা জানান, অনেক বাংলাদেশি এভাবে তুরস্কে গিয়ে আটক হচ্ছেন। যারা অবৈধভাবে ইউরোপ যেতে চাচ্ছেন, তাদেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তারা সচেতন না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়। শরিফুল হাসান বলেন, ‘ভিজিট ভিসা কাজের নিশ্চয়তা দেয় না। তারপরও এসব জেনে-বুঝেই ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়ে অনিয়মিত পন্থায় অনেকে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এই সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে: লাশ পাওয়া না গেলে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে মৃত বলা যায় না। এ কারণে এঁদের নিখোঁজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আইওএম বলছে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ বা মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে সমুদ্রে ডুবে। ২৫ হাজার ৯৩০ জন ডুবে গেছেন। এ ছাড়া নৌযান দুর্ঘটনা, কঠিন পরিবেশ ও খাবারের সমস্যা, সহিংসতা, অসুস্থতাসহ নানা কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এখানে। সর্বশেষ আগস্টে সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন ১৭ জন আর হারিয়ে গেছেন অন্তত ৩০ জন। তবে এঁদের সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রতি মাসেই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো মাসে একাধিকবার দুর্ঘটনার খবর আসছে। জুলাইয়ে ৫৮ জন হারিয়ে গেছেন। এর আগে শুধু জুনেই হারিয়ে গেছেন ৭৪৯ জন। আইওএম প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৮৪৫ জন হারিয়ে গেছেন সমুদ্রের পানিতে। ২০১৪ সালে হারিয়ে যান ৩ হাজার ২৮৯ জন। এরপর সর্বোচ্চ নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে। ওই বছর হারিয়ে যান ৫ হাজার ১৩৬ জন। এরপর এটি কমে আসে। ২০২০ সালে নিখোঁজ হন ১ হাজার ৪৪৯ জন। তবে ২০২১ সাল থেকে এটি আবার বাড়তে শুরু করেছে। ওই বছর ২ হাজার ৪৮ জন ও ২০২২ সালে ২ হাজার ৪১১ জন হারিয়ে যান সমুদ্রে। আর এ বছরের ৮ মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন ২ হাজার ৯৬ জন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছেন যেসব দেশের নাগরিকেরা, তাদের মধ্যে শীর্ষ দেশগুলো আফ্রিকার। এসব দেশ যুদ্ধসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সিরিয়াও আছে এ তালিকায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামটাও থাকছে নিয়মিত। বেসরকারি খাতের অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, দারিদ্র্য বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে এসব অভিবাসন হচ্ছে না। এটি হচ্ছে মূলত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এতে ওপরে ওঠার স্বপ্ন আরও তীব্র হয়েছে। ইউরোপে গেলেই জীবন বদলে যাবে; তাই নির্যাতন, নিপীড়ন, মুক্তিপণ বা মৃত্যুর শঙ্কা অতটা মাথায় নেয় না। আর অবৈধ শ্রমিকদের দিয়ে কম টাকায় কাজ করাতে ইউরোপের দেশগুলোর শিথিল নীতিও এমন অভিবাসনে উৎসাহ দেয়। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানব পাচার নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ১২-১৪টি রোডও পেয়েছি। প্রায় তিন শতাধিক মানব পাচারকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। পাশ্বর্বর্তী দেশের যারা আমাদের দেশের মানব পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত, তাদের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ওই দেশে সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়েছি। তারা তাদের দেশের মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 

 

আলোকিত প্রতিদিন/ ২২ আগস্ট ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here