প্রাক্তন / সাহিদা আক্তার

0
1293
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

             প্রাক্তন

        সাহিদা আক্তার

 

_ প্রিয়ন্তী হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে রুমে ঠুকেই ওয়াশরুমে চলে গেলো। কি যেনো লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা। বুকের গভীরে জমে থাকা অভিমান চোখের জলে আর শরীরে বহু বছরের জমে থাকা যন্ত্রণা ঘাম হয়ে ঝরে যাচ্ছিলো ওর। ঘাম বলা যায় না মনে হচ্ছিলো শিরা উপশিরায় এক অজানা কম্পন চলছিলো প্রিয়ন্তীর । জীবন এতো নিষ্ঠুর কখনো কখনো মনভরে কাঁদতেও দেয়না।
প্রিয়ন্তীর চিৎকা কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো খুব। পারলোনা তাই নিঃশব্দে হৃদয়ের পারগুলো ভেঙে গেলো তার। এক জীবনের রহস্যের গোলকধাঁধার বেড়াজালে আঁটকেই ফুরিয়ে যায় জীবননামক ধার করা সময়। নিয়তির মুচকি হাসির খেয়ালী আলো আঁধারে অচেনাকে চিনতে গিয়ে আমার আমিটাকে হারিয়ে ফেলেছি। অথচ বয়ে চলেছি মিথ্যা অপবাদ আমার আমিকে ভালোবাসবার পাপ । কথাগুলো বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত চোখে মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। একি হাসি নাকি বিদ্রূপ। হায়রে ভালোবাসা! ভালো থাকা।
যার জন্য সব ছেড়ে দিয়ে যাকে ঘিরে একটু ভালো থাকতে চেয়েছিলাম সেই একদিন আমার সবটুকু ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছিলো।

প্রিয়ন্তীর নিয়মিত ডাইরি লেখার অভ্যাস। ডাইরি লেখা প্রিয় নেশাও বলা যায় তার। নিয়ম করে প্রতিদিন ডাইরি লেখে সে আজ একটু সময় নিয়ে বেশ গুছিয়ে লিখলো।
প্রথম থেকে শুরু করে –
আজকের দিনটা একটু অন্যরকম ছিলো আজকে একটা বিশেষ দিন । আমার একটা একদিনের কর্মশালা ছিলো যেখানে একজন বহিরাগত প্রশিক্ষকের কো প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবো আমি। তাই সকাল সকাল হাতে সময় রেখেই একটু আগে আগেই বেড়িয়ে পড়লাম। অফিসে পৌঁছে অফিসের গেঁটে হঠাৎ ধাক্কা খেলাম কারো সাথে! ফিরে উঠে দাঁড়াতেই আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম! পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলাম আমার হাত থেকে ব্যাগ ফাইল সব পড়ে গেলো।
_কেমন আছো প্রিয়ন্তী? এখনো তুমি সেই আগের মতোই আছো একটুও বদলে যাওনি দেখছি ……
_আমি কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তি হয়ে রইলাম আমার হাতে ব্যাগ ফাইল উঠিয়ে দিয়ে বললো তুমি ব্যথা পাওনিতো। আমি নিজেকে সামলে নিলাম বললাম না ব্যথা পাইনি।
তুমি এখানে তবে কি তুমিই?
_হ্যাঁ আমিই থাকবো তোমার সাথে।
বললে নাতো কেমন আছো?
_এই তো আছি। তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো এখনো কি রাত জেগে পড়াশোনা করো?
_বাঁধা দেবার আরতো কেউ নেই।
_এইতো ভালো আছো তবে পরাধীনতার ছিন্নশিকলে। রক্ষণশীল নজরদারি থেকে মুক্তি পেয়েছো বলো।নিয়মিত খাবার খাওয়া, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা মনে করে অফিসে আসার সময় সব নিয়ে আসা এগুলো কি তুমিই করো নাকি করে দেয় ?
_সময় জীবনটাকে খুব করে বদলে দিতে জানে। এখন নিজের সব কাজ নিজেই করার চেষ্টা করি।
_তোমার বউ বুঝি খুব লক্ষ্মীমন্ত, খুব শান্ত। ভীষণ স্বাধীনতা দেয় তোমাকে তাইনা? তোমার খুব খেয়াল রাখে ভালোবাসেও খুব তাইনা।
_জানিনা ভালোবাসে কিনা তবে খেয়াল রাখে নিশ্চয়ই আর স্বাধীনতার কথা যাকে স্বাধীনতা ভেবেছিলাম সে আসলে উদাসীনতা, স্পর্শহীনতা হারিয়ে যাবার প্রচণ্ড অস্থিরতা।_কতোদিন পরে দেখা হলো আমাদের প্রায় একযুগ হলো বুঝি।_না এখনো দুমাস বাকী।

_তুমি হিসেব করে রেখেছো?

_হিসেব না রেখে উপায় কি বলো এতো শুধু অতীত নয় এ আমার জীবনে আমৃত্যু কারাবাসের রায় শুনানি বিচারিক সময়। আমার জীবন প্রবাহ বদলে দেওয়া ইতিহাস। বাকী জীবনের নির্ঘুম রাতের দুঃস্বপ্নের উৎস। যেই দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে আটকে আছি আমি।

কথাগুলো বলেই প্রসঙ্গ বদলাতে হাসনাত হঠাৎ বললো-
তুমি কি সব সময় শাড়ী পড়ো? শাড়িতে তোমাকে অপূর্ব সুন্দর লাগে! নীল শাড়িতে তুমি মোহনীয় সৌন্দর্যের অপ্সরা।
_না শাড়ি সব সময় পড়িনা তবে মাঝে মাঝে ওর জন্য পড়তে হয়।
_শেষবার তোমাকে শাড়িতে কবে দেখেছি বলতে পারো।
_আমার বিয়ের দিন সন্ধ্যায় তুমি এসেছিলে আমাদের জামরুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলে।
_তুমি কি আমাকে দেখেছিলে?
_না, আমি বোধ হয় তোমার উপস্থিতি অনুভব করেছিলাম। আমি যেনো জানতাম তুমি আসবেই আমাকে নীল শাড়িতে দেখবে, এটা যে আমি তোমার জন্যই পড়েছিলাম লাল শাড়ির বদলে নীল শাড়ি।
_তুমি কি এখনো আগের মতোই গান করো, নিয়ম করে গান শোনাও তোমার বউকে।
_না আগের মতো আর গান করিনা আমার সূরগুলো যে বড্ড অচেনা হয়ে গেছে।
_আমি যেনো আর শুনতে পারছিলাম না তাই কথার প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম আজকে আমাদের যে যে কর্মসূচি দিনব্যাপী তা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
_এড়িয়ে যেতে চাইছো নাকি আমাকে খুব ঘৃণা করো?
_তুমি কেনো আমার সামনে এলে বলতো? আমি যে তোমাকে ভুলে থাকতে চাই।
_ভুলে থাকতে চাও তার মানে মনের কোথাও আছি তাহলে।
_জানি না বাদ দাও এসব ।
_বাদ দিয়েই তো দিয়েছিলাম বেঁধে রাখতে যখন পারিনাই ।
_তোমার কয়জন ছেলেমেয়ে? বউ কি জব করে?
_একমাত্র মেয়ে, না ও জব করেনা ওর চাকরি ভালো লাগেনা আমিও জোর করিনি।
_জোর করতে তুমি জানো নাকি। তুমিতো ভেঙে দিতেই জানো শুধু!

_তোমার কজন ছেলে মেয়ে প্রিয়ন্তী?সাহেব কি করেন?
_এক ছেলে, সাহেব ব্যাংকে আছে।
এই হাসনাতকে আমি চিনতেই পারলামনা। অন্য এক মানুষ। ভীষণ কেয়ারিং, সিরিয়াস। বাস্তববাদীও খুব। একেবারে ভেঙেচূরে নতুন এক মানুষের জন্ম হয়েছে।
_প্রিয়ন্তী তুমি এক নীলা পাথর সবার কপালে যা সহ্য হয়না। তোমাকে আমি সবটুকু পেয়েছি যেদিন তোমাকে হারিয়েছি। আমি উপলব্ধি করেছি ভালোবাসবার জন্য পাশে থাকাটা জরুরি নয় জরুরি তার ভালো চাওয়াটা ভালো রাখার চেষ্টা তোমার থেকে আমি দূরে থাকলেই তুমি ভালো থাকবে সেটা জেনেই আমি দূরে থাকার অভিনয় করে চলেছি আসলে কি পেরেছি……. বিধাতার কাছে এটুকুই চাওয়া পরের জন্মে আমি যেনো তোমাকে নিজের কাছে রাখতে তোমাকে ধারন করার সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করতে পারি।
_ আমি কোনো কথা বলতে পারলাম শুধু তাকিয়ে রইলাম ফ্যাল ফ্যাল করে এই মানুষ কি সেই যাকে ভালোবেসে অল্প বয়সেই সবার অমতে বিয়ে করেছিলাম। দুবছরের সংসারে এতো এতো অভিযোগ আর ঘৃণার পাহাড় জমেছিলো যে লক্ষ জনম দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো। বন্ধুত্বটাও একদম শেষ হয়ে গিয়েছিলো। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আলাদা হওয়ার। কিন্তু মনে মনে কোথাও ভালোবাসার কিছু স্মৃতিচিহ্ন ছিলো যা আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি ক্রমশ নিঃশেষ হচ্ছিলাম ভেতর থেকে কি ঝড় উঠেছিলো বলতে পারবোনা। সারাদিন এক মোহমায়ায় কেটে গেলো। আমাকে কোনো কষ্টই করতে দিলো না হাসনাত সব একা করলো আর আমাকে সোপিচের মতো আগলে রাখলো। আমি পালিয়ে এলাম দ্রুত আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো মরে যেতাম।
আমি যে তোমার পর অন্য কেউ তোমার আপন
অনন্তকাল আমি তোমার শুধুই প্রাক্তন।

আলোকিত প্রতিদিন /২ অক্টোবর -২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here