আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গাজা শহরের মাটির নিচে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের তৈরি করা গোপন সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের একাংশে আক্রমণের কথা জানিয়েছে ইসরায়েল। শনিবারের হামলার ঘটনার পর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে হামাসকে লক্ষ্য করে নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘গাজা উপত্যকার একটি স্তর বেসামরিক নাগরিকদের এবং আরেকটি স্তর আছে হামাসের জন্য। আমরা হামাসের তৈরি করা সেই দ্বিতীয় স্তরটিতে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি। তাদের দাবি, ‘এসব বাংকার গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য নয়। এটা শুধু হামাস আর অন্য সন্ত্রাসীদের জন্য, যাতে করে তারা ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে রকেট হামলা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিংবা এ ধরনের অভিযানের পরিকল্পনার জন্য ব্যবহার করতে পারে। এই সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের আকার সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন, যাকে ইসরায়েল বলছে ‘গাজা মেট্রো’। কারণ মনে করা হয়, এটা এমন একটা এলাকার নিচে বিস্তৃত, যা লম্বায় প্রায় ৪১ কিলোমিটার আর প্রস্থে ১০ কিলোমিটার। ২০২১ সালের সংঘাতের পর আইডিএফ বিমান হামলা করে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি সুড়ঙ্গ ধ্বংসের দাবি করেছিল। হামাস তখন বলেছিল, তাদের সুড়ঙ্গ ৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এর মাত্র পাঁচ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে। সুড়ঙ্গসংক্রান্ত এসব তথ্য বোঝার জন্য যেটা উল্লেখ করা যায়, তা হলো পুরো লন্ডন শহরের আন্ডারগ্রাউন্ডের দৈর্ঘ্য ৪০০ কিলোমিটারের মতো। গাজায় সুড়ঙ্গ নির্মাণ শুরু হয় ২০০৫ সালে ইসরায়েল সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহারের আগে থেকেই। তবে এর গতি বাড়ে দুই বছর পর হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর। ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে ইসরায়েল ও মিসর পণ্য পরিবহন ও মানুষের আসা-যাওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে। একপর্যায়ে মিসর সীমান্তে প্রায় আড়াই হাজার সুড়ঙ্গ হামাস ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ব্যবহার করেছে বাণিজ্যিক পণ্য, তেল ও অস্ত্র চোরাচালানের জন্য। ২০১০ সালের পর গাজায় চোরাচালানের গুরুত্ব কমে যায়। কারণ ইসরায়েল তাদের ক্রসিং ব্যবহার করে বেশি পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া শুরু করে। পরে মিসর কিছু সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে বা বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়। হামাস ও অন্য গ্রুপগুলোও তখন ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলার জন্য নতুন করে সুড়ঙ্গ খনন শুরু করে। ২০০৬ সালে ইসরায়েল সীমান্তে এমন সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে দুজন ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে এবং আরেকজনকে তুলে নেওয়া হয়, যাকে পরে পাঁচ বছর জিম্মি রাখা হয়েছিল। ২০১৩ সালে আইডিএফ ১.৬ কিলোমিটার লম্বা ও ১৮ মিটার গভীর সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে, যার ছাদ ও দেয়াল ছিল কংক্রিটের তৈরি। এটি গাজা উপত্যকা থেকে শুরু করে ইসরায়েলের কিবুতজ এলাকার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্থানীয় অধিবাসীরা বিচিত্র শব্দ শোনার পর ইসরায়েলিরা এটিকে চিহ্নিত করে। পরের বছর নিজেদের প্রতি হুমকি দূর করতে এ ধরনের ‘সন্ত্রাসী সুড়ঙ্গ’গুলো নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজন বোধ করে ইসরায়েল। আইডিএফ পরে ৩০ কিলোমিটারের বেশি সুড়ঙ্গ ধ্বংসের দাবি করে। কিন্তু তার পরও একটি সশস্ত্র গ্রুপ এমন একটি সুড়ঙ্গ থেকে হামলা চালিয়ে চার ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে। ইসরায়েলের রিচম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞ ড. ডাফনে রিচমন্ড বারাক বলেন, ‘আন্তঃসীমান্ত সুড়ঙ্গগুলো অনেকটা দুর্গের মতো। মূলত ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালাতে একবার ব্যবহারের জন্য এগুলো খোঁড়া হয়। নেতারা সেখানে লুকিয়ে থাকে। তাদের কমান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার আছে। তারা এগুলো ব্যবহার করে ট্রান্সপোর্ট ও যোগাযোগের জন্য। এগুলোতে রেলট্র্যাক, আলো ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকে। বারাকের মতে হামাস সিরিয়ার আলেপ্পোতে বিদ্রোহী যোদ্ধা ও মসুলে ইসলামিক স্টেট জিহাদিদের কৌশল পর্যবেক্ষণ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুড়ঙ্গ নির্মাণ ও যুদ্ধকৌশলে আরো দক্ষতা অর্জন করেছে। ধারণা করা হয়, গাজায় যে সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হয়েছ, সেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ১০০ ফুট গভীরে এবং এর প্রবেশপথগুলো সাধারণ ঘর-বাড়ি, মসজিদ, স্কুল কিংবা এমন ভবনে, যেখানে সাধারণ মানুষের সমাগম হয়। মূলত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের যেন চিহ্নিত করা না যায় সে জন্য এগুলো ব্যবহার করে তারা। স্থানীয় মানুষজনকেও এমন নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য মূল্য দিতে হয়। আইডিএফের অভিযোগ, গাজার মানুষের জন্য ত্রাণ হিসেবে দেওয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সুড়ঙ্গ তৈরি ও আগের যুদ্ধগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ি নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলে যে হামলা হয়েছে তাতেও সুড়ঙ্গ ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। ওই হামলায় এক হাজার ৩০০ মানুষ মারা গেছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। জিম্মি করা হয়েছে আরো অন্তত ১৫০ জনকে। এদিকে কাফার আজার কাছে একটি সুড়ঙ্গ বের হওয়ার পথের সন্ধান পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওই এলাকায়ই অনেক বেসামরিক মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। ওই সুড়ঙ্গটি নির্মাণ করা হয়েছে এন্টি সুড়ঙ্গ সেন্সরসহ নির্মিত ভূগর্ভস্থ দেয়ালেরও নিচ দিয়ে। ২০২১ সালে এ ধরনের দেয়াল তৈরির কাজ শেষ করেছিল ইসরায়েল। ড. রিচমন্ড বারাক বলছেন, ‘সুড়ঙ্গ চিহ্নিত করার কোনো পদ্ধতিই পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। এ জন্যই যুদ্ধে সব সময় সুড়ঙ্গ ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই, কারণ এটা ঠেকানোর উপায় নেই। তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজায় হামাসের পুরো সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে পারবে—এটা বিশ্বাস করাটা হবে অবাস্তব বিষয়। ‘নেটওয়ার্কটির কোনো কোনো অংশ থেকে নানা কারণে অনেককে সরানো যাবে না। আবার কিছু অংশ থাকবে অজানা। আবার কিছু অংশের জন্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে গিয়ে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনাও আছে, যার মধ্যে ইসরায়েলি সেনা, ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিক ও জিম্মিরাও থাকতে পারে বলে এ বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘হামাস মানব ঢাল ব্যবহারে খুবই দক্ষ। আক্রমণ অনিবার্য হলে তারা এটি করতে জানে। নিরীহ বেসামরিক মানুষজনকে তারা ভবনের ওপরে রাখে। এগুলো অনেকবারই ইসরায়েলকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছে। কৌশলটিতে ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করা হামাস এটিকে সুড়ঙ্গের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারে এবং যেসব আমেরিকান ও ইসরায়েলিদের জিম্মি করা হয়েছে তাদেরও সেখানে রেখে দিতে পারে। ২০২১ সালের সংঘাতের সময় গাজা শহরে ভয়াবহ বিমান হামলায় তিনটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছিল, যাতে ৪২ জন মারা গিয়েছিল। আইডিএফ বলেছিল, ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলো ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু যখন এসব সুড়ঙ্গ ধ্বংস হয়, তখন যেসব ভবনের নিচের এই সুড়ঙ্গ সেগুলোর ফাউন্ডেশনও ধ্বংস হয়ে যায়। ড. বারাক বলছেন, শহরাঞ্চলে যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতা ও ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী হুমকি ছাড়াও সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কাছে অনেক সময় অকার্যকর হয়ে পড়ছে আইডিএফের প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা কার্যক্রমও। তিনি বলেন, ‘প্রথমত পুরো নেটওয়ার্ককে ফাঁদে পরিণত করার মতো অনেক সময় হামাসের আছে। তারা এমনকি সেনাদের সুড়ঙ্গে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে তারপর পুরোটাই উড়িয়েও দিতে পারে। তারা অপহরণ করতে পারে। এরপর সব ধরণের ঝুঁকি তৈরি হবে—অক্সিজেন দ্রুত কমে যাওয়া, শত্রুর সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান লড়াই। এমনকি আহত সেনাদের উদ্ধারও কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তার মতে, ‘সুড়ঙ্গের ভেতরে না গিয়েও একটি এলাকা চিহ্নিত করলেন, যেখানে মনে করা হচ্ছে যে সুড়ঙ্গ থাকতে পারে। সেখানেও আপনি এমন কিছু পেতে পারেন যা মূলত অদৃশ্য। ইসরায়েলি সেনাদের অবশ্য এসব ঝুঁকি মোকাবিলারও কিছু পদ্ধতি থাকবে। সৌফান গ্রুপ সিকিউরিটি কনসালটেন্সির গবেষণা পরিচালক কলিন ক্লার্কের মতে এ ক্ষেত্রে ড্রোন কিংবা মানববিহীন কিছু পাঠিয়ে সুড়ঙ্গের ম্যাপ কিংবা ফাঁদ সম্পর্কে ধারণা নেওয়া সম্ভব হতে পারে। যুদ্ধবিমান থেকে বাংকারবিধ্বংসী বোমা ফেলা হতে পারে, যেগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই মাটির অনেক গভীরে যেতে সক্ষম। তবে শহরে ঘনবসতির কথা চিন্তা করলে এগুলোতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১৭ অক্টোবর ২৩/ এসবি