নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি
আলোকিত প্রতিবেদক:
একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়ে। একবার বাড়লে আর কমে না। দাম বাড়ানোর সময় সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে না। কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই আলোচনায় আসে সিন্ডিকেট। তবে এই সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। সম্প্রতি চাল, তেল, পিয়াজ ও আলুসহ বাজারে অনেক পণ্যের দাম লাগামহীন। এতে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ ক্রেতাদের। দ্রব্যমূল্য নিয়ে চারপাশে হৈ চৈ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ পণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে। প্রশ্ন হলো বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ নিলেও তা তেমন কার্যকর হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা কমিশন করে হলেও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে এর মূলত কিছু কারণ আছে। বাজারে পণ্যের চাহিদা বেড়েছে তা নয়। এখানে মূলত কারসাজি আছে। এটা সব সময় হয়ে আসছে, কখনো কমে না। মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট করে কিছু জরিমানা করা হয়। কিন্তু এতে সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফায়দা হয় না। মজুতগত এবং সিন্ডিকেটের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এখন এর জন্য দরকার বাজার মনিটরিং। এটা করা উচিত সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার। এর ওপর এখন করোনার সময় ট্রান্সপোর্ট খরচটা বিভিন্ন জায়গায় বেড়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে আবার চাঁদাবাজিও চলে। এছাড়া টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হয়ে থাকে। তিনি বলেন, মহামারির সময় অনেকের আয়ের উৎস নেই। অনেকের বেতন-ভাতা কমে গেছে। দেখা যাচ্ছে একটা পরিবারে একজন কর্ম করে, তার আয়-রোজগারও কমে গেছে। এ অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বেশি পড়েছে। এজন্য নিত্যপণ্যের বাজার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এটা যেন আরো উপরে উঠে না যায়। সরকার পণ্যের দর নির্ধারণ করে দিলেও কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ট্রেডবডি বা বিভিন্ন সমিতি আছে। মালিক সমিতি, রিট্রেইলার সমিতি। এরা প্রত্যেকে কিন্তু বিগ এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। সরকারও এদের ওপরে বিভিন্ন কারণে ডিপেন্ড করে। সরকারি লোক, সরকারি কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়ে থাকে। এ কারণে তারা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এখন দরকার হলো মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারকে খুব শক্ত একটা অবস্থান নিতে হবে। শুধু বাজারে একটু অভিযান, দু’একজন খুচরা ব্যবসায়ীকে জরিমানা- এগুলো করে কোনো লাভ হবে না। মূল সিন্ডিকেটধারীদের শক্ত হাতে ধরতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দিতে হবে। এর জন্য তারা আবার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সেটাও শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এখানে সরকারের দুর্বলতা আছে। তাদের দুর্বলতা এবং সুশাসনের অভাবেই এরা এসব করতে সাহস পায়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বা এটা খুবই কঠিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। এর জবাবে সাবেক এই গভর্নর বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থিওরি মানেতো সব অবাধে চলবে তা নয়। এটাকে অবশ্যই কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হবে। কোল্ড স্টোরে যদি একটা পণ্য ২৩ টাকা হয় আপনি সেটা বাইরে গিয়ে ৫০ টাকায় কেন বিক্রি করবেন। এগুলোকে নজরদারি করতে হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে একেবারে ছেড়ে দেবেন তা উচিত না। আরেকটা বিষয় হলো বাংলাদেশে যদি টিসিবি ভালো থাকতো বা অন্য সরকারি সংস্থাগুলো যদি ভালোভাবে কাজ করতো তাহলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কিছু নয়। টিসিবিতো নামে মাত্র। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিুজল ইসলাম বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট থাকে এটা ঠিক। কিন্তু সরবরাহ না বাড়ালে শুধু দর নির্ধারণ করে দিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এই মুহূর্তে পণ্যের দাম কমাতে হলে অবশ্যই সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। সরকার বলছে, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন পণ্যের সংকট। সরকারের তথ্য যদি সত্য হয় তবে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন? এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন এবং বাস্তবে এটা করা যায় না। মন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন চেষ্টা করে, তবে বাস্তবে এটা করা যায় না। বাজারে চাহিদা ও তাদের ব্যবসায়ী নানান কারসাজির কাছে- এটা করা খুব কঠিন একটা কাজ। তবে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি না। এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণ করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা সহজ নয়। সাধারণত আমরা যেটা জানি, যখন চাহিদা কম থাকে এবং সরবরাহ বেশি থাকে তখন পণ্যের দাম কমে। অপরদিকে, চাহিদা বেশি থাকলে সরবরাহ কম থাকলে মূল্য বাড়ে। এখন সাম্প্রতিককালে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। বন্যায় ফসলি জমির ক্ষতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে সরবরাহ কমেছে। উৎপাদনও কমেছে। এ কারণে শাক-সবজির দাম বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা তো আর কমেনি, সে কারণে শাক-সবজির দাম বেড়েছে। আর শাক-সবজির দাম বাড়ায় বাজারে আলুর চাহিদা বেড়েছে। যদিও সরকারি হিসেবে চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন অনেক বেশি। এরপর করোনাকলে আলু ত্রাণ হিসেবেও বিতরণ হয়েছে। তবু সরকারি হিসাব যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আলুর দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। ক্যাব সভাপতি আরো বলেন, যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকে, কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেসব পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে সেগুলোরও দাম বাড়ানোর প্রবণতা থাকে। এটা তারা বাড়তি মুনাফা লাভের আশায় করে থাকে। এর প্রেক্ষিতে সরকার পাইকারি ও খুচরা বাজারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে দুই একটি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তারা কিছু শুনছে না। সেজন্য আমি প্রথমেই বলেছি, শুধু দাম নির্ধারণ করে দিয়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এখন এ ক্ষেত্রে সরকারকে যেটা করতে হবে, সত্যিকারেই যদি কোল্ড স্টোরে আলুর পর্যাপ্ত মজুত থেকে থাকে, তাহলে যারা এই মজুত ধরে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া এবং বিক্রি করতে বাধ্য করতে হবে। বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তখন মূল্য স্বাভাবিক হবে। কিন্তু এমন যদি হয় যে, কিতাবে আছে, বাস্তবে নাই তাহলে এসব করেও কোনো কাজ হবে না। বাজারের এমন অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিনের। বাজারে অভিযানও চালানো হয়। ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করা হয়। কিন্তু কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে গোলাম রহমান বলেন, সব রোগের চিকিৎসায় যেমন একই ওষুধ নয়, তেমনি সব পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ একই ব্যবস্থায় হতে পারে না। মূল কথা হলো- সরবরাহ বাড়াতে হবে। তাহলেই দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে, স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু যারা মজুত ধরে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ধরে শাস্তি দেয়া হোক, জেলে দেয়া হোক, তাহলেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? তারা তো সরকারের চেয়ে শক্তিশালী না। আসলে সরকার যদি কাউকে আইনের আওতায় না আনতে চায় তখনই সংকট সৃষ্টি হয়। কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এ ক্ষেত্রে দু’টি কারণ থাকতে পারে; হতে পারে এখানে সরকারের তথ্য ভুল, অথবা সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী না। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নাই। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয় না- তা নয়। বাজারে অভিযান চালানো হয়, ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়। কিন্তু সার্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কেবল শাস্তি দিয়ে কাজ হয় না। এটার জন্য নানা রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা অভিজ্ঞ সরকারের তারা সবই জানে। এটা শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এটা ঠিক, তবে সরকার চাইলে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। দেখা যায়, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং যথাযথ তদারকির অভাবে বাজারে পণ্যমূল্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশি। যে কারণে ক্রেতাদের চড়া মূল্যে পণ্য কিনতে হলেও উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য পাননি। এ কারণে শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। এজন্য বছরের বেশির ভাগ সময় সাধারণ ক্রেতাদের সংসার চালাতে নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়। এর মধ্যে বেশি কষ্টে ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষ। জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়াতে অসাধুরা সব সময় সুযোগ খোঁজে। বছরের শুরু থেকেই এটি অব্যাহত ছিল। গত বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছে। অন্যান্য দেশে দুই থেকে তিন মাস পর যুদ্ধের প্রভাব পড়লেও দেশে ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে অজুহাত দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। জ্বলানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পর আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের দাম আজ বাড়লে আজই আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। সেই বাড়তি ডলারে আমদানি করা পণ্য দেশে এলে দাম বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উলটো। মূলত এসব ক্ষেত্রে সরকারসংশ্লিষ্টদের তদারকিতে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যে কারণে ক্রেতাকে বাড়তি দরে পণ্য কিনতে হয়েছে। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত সবজি কৃষক কম দামে বিক্রি করে দিলেও ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি নতুন বছরে অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। চাল নিয়ে চালাকি : বছরজুড়ে চাল কিনতে ক্রেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ ছিল। কারণ বিদায়ি বছরে বাজারে চালের কোনো ধরনের সংকট না থাকলেও মিল মালিকরা একাধিক সময় চালের দাম বাড়িয়েছে। জুনে মিলারদের কারসাজিতে দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে বাজার স্বাভাবিক রাখতে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। আমদানি শুরু হলে দেখা যায়, ডলারের কারণে ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম বেশি হয়। ওই সুযোগে আগস্টে মিলাররা সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ চাল নিয়ে চালাকির সব ফর্মুলা ব্যবহার করেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। প্রতি কেজি মোটা চাল ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। সরু চালের দাম দাঁড়ায় ৮৫-৯০ টাকা। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং জোরদারের সঙ্গে দুদফায় আমদানি শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্পমূল্যে ওএমএস শুরু হয়। এতে চালের দাম কমতে থাকে। তবে আবারও নভেম্বরে চাল তৈরিতে খরচ বাড়ার অজুহাতে ভরা আমন মৌসুমে নভেম্বরে প্রতি কেজি চালের দাম ৮-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। যদিও চাল উৎপাদনের সরকারি তথ্য বলছে, টানা কয়েক বছর দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে। ডালের দামে দিশেহারা মানুষ : বছর শেষে আমদানিনির্ভর পণ্য ডালের বাজারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নভেম্বর থেকে বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। খুচরা বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডালের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়তি ধরে বিক্রি হচ্ছে। বছর শেষে বাজারে প্রতি কেজি মসুর ডাল মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা, যা বছরের শুরুতে ৯০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রেহাই পায়নি সয়াবিন তেল : জুনে দেশের খুচরা বাজারে প্রথমবারের মতো সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। লিটার প্রতি বিক্রি হয় ২০৫-২১৫ টাকা। বেশি মুনাফার জন্য সয়াবিন তেলের বাজার চলে যায় সিন্ডিকেটের খপ্পরে। চক্রটি বাজার থেকে তেল একপ্রকার উধাও করে ফেলে। ভোক্তার পকেট কাটতে হাঁকানো হয় চড়া দাম। ক্রেতারা ১০ দোকান ঘুরে শেষ পর্যন্ত বেশি দামে তেল কিনতে বাধ্য হন। চিনির দামেও সর্বকালের রেকর্ড : বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারও বারবার দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা কার্যকর হয়নি। বছরের শুরুতে এক কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা। বছর শেষে বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকা। সম্প্রতি সরবরাহ সংকটের অজুহাতে প্রতি কেজি চিনি ১৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এছাড়া প্রতি কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে ৪২ টাকা, যা আগে ৩৫ টাকা ছিল। আটার বাজারও অসহনীয় : ২০২২ সালের শুরুতে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। বছরের শেষদিকে বিক্রি হয় ৬০-৬৫ টাকায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি আটা ৭০ শতাংশ এবং ময়দা ৫৭ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। বছরের শুরুতে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটার বাজারমূল্য ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বর্তমানে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত ময়দার দাম ছিল ৫৫ টাকা। দাম বেড়ে এখন ৭৫-৮৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ডিমের বাজারও অস্থির : জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ডিম ব্যবসায়ীরাও একহাত নিয়েছেন। পরিবহণ খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে হঠাৎ করেই ডিমের বাজারে অস্থিরতার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়। আগস্টে ঢাকার খুচরা বাজারে এক হালি (৪ পিস) ফার্মের ডিমের দাম ওঠে ৫০-৬০ টাকা। দেশি হাঁস ও মুরগির ডিমের দর ছিল প্রতি হালি ৬৫-৮০ টাকা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পাইকারি ডিমের আড়তদারদের কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাদের অনিয়ম ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। মাংসের দাম বাড়তি : কৃষিশুমারির তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় ৩৭ লাখ ৭৪ হাজার গরু এবং ৩১ লাখ ২৬ হাজার ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে গরু, ছাগল ও মুরগির কোনো সংকট নেই। চাহিদার তুলনায় বেশি। তারপরও দেশের বাজারে প্রতিবছরই মাংসের দাম বাড়ছে। বছরের শেষে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৭০০ টাকা। ৮০০ টাকার খাসির মাংস বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বছরের মাঝামাঝি সময় বিক্রি হয়েছে ১৯০-২১০ টাকা। রামপুরা বাজারের রিকশাচালক মকবুল বলেন, ‘এক কেজি গরুর মাংস ৭০০ টাকা। খেতে খুব ইচ্ছা করলেও কিনতে পারি না। যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষ মাংস খাওয়া ভুলে গেছি। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। টুথপেস্ট থেকে শুরু করে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডারসহ অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্যের দামও এখন স্বল্প-আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে বিদায়ি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। তবে এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই। গত বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে নতুন করে বিপদে পড়েছে ২৯ শতাংশ মানুষ। যেখানে বছরের শুরুতে দেশের ১৮ শতাংশ মানুষের জীবনমানের ওপর সেই চাপ ছিল। এখন বছর শেষে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি চাপ নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে। ক্যাবের গোলাম রহমান মনে করেন, সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকি পরিচালনা করছে। নতুন বছরে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। সবকটি সংস্থার সমন্বয়ে বাজারে তদারকি করতে হবে। পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানি কত করতে হবে, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য মাঠ থেকে বাজারে আসতে সব ধরনের বাধা দূর করতে হবে। জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘এ বছর বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজারে সার্বিক তদারকি করেছি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নিয়ে অধিদপ্তরে সভা করেছি। নানা অনিয়ম পাওয়ায় যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে জনবল সংকট ও আইনের দুর্বলতার কারণে অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখাও কষ্টকর। তাই ব্যবসায়ীদের আরও আন্তরিক হতে হবে। সব মিলে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নতুন বছরের প্রথম থেকেই তিন স্তরে তদারকি করা হবে। যাতে পণ্যের দাম নিয়ে কেউ অসাধুতা করতে না পারে।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২০ অক্টোবর ২৩/ এসবি