আলোকিত ডেস্ক:
হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে গাজায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে বলে মন্তব্য করে ফিলিস্তিনিদের এই ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতির দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সামনে এক বক্তৃতায় গুতেরেস এ কথা বলেন বলে জানায় বিবিসি। তিনি এই সংঘাত থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়ে আরো বলেন, সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে দবানলের গতিতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর গাজায় ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগঠন হামাস অতর্কিত এক হামলা চালিয়ে ইসরায়েলে ১৪শ’র বেশি মানুষকে হত্যা করে। যার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল ওই দিনই গাজার উপর রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামাসকে নির্মূল করতে একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে তারা গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। গত ১৮ দিন ধরে ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলায় গাজা যেন এখন নরকে পরিণত হয়েছে। সেখানে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। বরং সেটা দিন দিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সোমবার পর্যন্ত সেখানে ৫,৭৯১ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১১ লাখের বেশি মানুষ। গাজার উপর নির্বিচারে এই হামলার বৈধতা দিতে ইসরায়েল বলছে, আত্মরক্ষা করা তাদের মৌলিক অধিকার এবং আত্মরক্ষার স্বার্থে তারা হামাসকে নির্মূল করতে চায়। ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররাও কমবেশি একই সুরে কথা বলেছে। তবে মঙ্গলবার ভিন্ন মন্তব্য করে রোষের মুখে পড়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। নিরাপত্তা পরিষদের সামনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, হামাসের এই হামলা যে একেবারে বিনা কারণে হয়নি সেটা স্বীকার করে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিনি জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদায়িত্বের শিকার হয়ে রয়েছে। তবে ফিলিস্তিনি জনগণের এই ক্ষোভ হামাসের ভয়ঙ্কর হামলাকে ন্যায্যতা দিতে পারে না। একই সঙ্গে ওই হামলার কারণে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নেমে আসা সম্মিলিত শাস্তিও কোনোভাবেই ন্যায্যতা পেতে পারে না। এদিন নাম উচ্চারণ না করে ইসরায়েলের সমালোচনা করে গুতেরেস আরো বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা করার অর্থ এই নয় যে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া যায়। যেখানে তাদের জন্য না আছে কোনো আশ্রয়, না আছে খাবার, পানি, ওষুধ ও জ্বালানির ব্যবস্থা। এবং তারপর দক্ষিণাঞ্চলেও অব্যাহত বোমা হামলা। গুতেরেসের এই বক্তব্যকে ‘জঘন্য’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ এক পোস্টে তিনি লেখেন, তিনি ‘হামাসের হামলা বিনা কারণে হয়নি’ বলে বিবৃতি দিয়ে সন্ত্রাসবাদ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এক ধরণের সমঝোতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক যে, হলোকাস্টের পরে যে সংস্থার জন্ম হয়েছে তার প্রধান এই ধরনের ভয়ঙ্কর দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করছেন। গুতেরেস তার বক্তৃতায় হামাসের হামলাকে ‘ভয়ঙ্কর ও নজিরবিহীন’ বলে বর্ণনা করে ইসরায়েল থেকে হামাসের জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া ২২২ জন বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় হামাস এরইমধ্যে চার জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের পদত্যাগ দাবি ইসরায়েলের: গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে অভিযোগ তোলা এবং অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোয় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের পদত্যাগ দাবি করেছে ইসরায়েল। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, আপাতত গুতেরেসের সঙ্গে তারা কোনো বৈঠকও করবেন না। গত মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে গুতেরেস বলেছেন, এই সংঘাত এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। গাজা উপত্যকায় আমরা যা দেখছি, তা থেকে স্পষ্ট যে, সেখানে আন্তর্জাতিক আইন মানা হচ্ছে না। এখানেই শেষ করেননি জাতিসংঘ প্রধান। বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারির অধীনে রয়েছে। হামাস যে আক্রমণ চালিয়েছে, তা শূন্য থেকে তৈরি হয়নি। সরাসরি ইসরায়েলের নাম উল্লেখ না করে তিনি আরও বলেন, আমি পরিষ্কার বলছি, একটি সশস্ত্র সংঘাতে কোনো পক্ষই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়। গুতেরেসের এই মন্তব্যের পর তার কড়া সমালোচনা করেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাড এরডান বলেছেন, শতাধিক মানুষকে যারা হত্যা করেছে, পুরুষ, নারী, শিশু কাউকে রেহাই দেয়নি, সেই হামাসকে সমর্থন করেছেন গুতেরেস। জাতিসংঘের প্রধান থাকার আর কোনো অধিকার তার নেই। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। এলি কোহেন বলেছেন, ৭ অক্টোবর যারা নির্বিচারে হত্যা করলো, গুতেরেস কার্যত তাদের সমর্থন করেছেন। তার কথায়, ‘গুতেরেস, আপনি কোন বিশ্বে থাকেন জানি না, তবে এটি আমাদের বিশ্ব নয়, এটুকু বলতে পারি।’ জাতিসংঘের প্রধানের সঙ্গে বৈঠকও বাতিল করেছেন তিনি। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ২২০ জনকে জিম্মি করেছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। তারই জেরে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরায়েল। নির্বিচার বিমান হামলায় গাজা উপত্যকাকে কার্যত ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছে তারা। এতে এরই মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে দুই হাজারের বেশি শিশু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানিয়েছে বহু দেশ ও সংগঠন। গুতেরেসও সেই কথাই বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এর জন্য সরাসরি তার পদত্যাগই দাবি করলো ইসরায়েল।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২৫ অক্টোবর ২৩/ এসবি