আলোকিত ডেস্ক:
রাজধানী ঢাকাজুড়ে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। কোনো কোনো এলাকায় গত কয়েক দিন চুলা জ্বলেনি। কোথাও কোথাও আবার গভীর রাতে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা চুলা জ্বলে। সাধারণত শীতে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। তবে এবার শীত আসার আগেই এই পরিস্থিতি আতঙ্কগ্রস্ত করেছে রাজধানীবাসীকে। কেবল ঢাকা-ই নয়, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অবস্থাও একই রকম। প্রাকৃতিক গ্যাসের এই সংকট কেবল আবাসিকেই নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, সিএনজি স্টেশনেও ভোগান্তি বাড়িয়েছে। হুমকিতে ফেলেছে ব্যবসা-বাণিজ্য, রপ্তানি ও উৎপাদন খাতকে। বেশ কয়েক দিন ধরে এ সংকট চললেও সমাধানের দেখা নেই। গ্যাস না থাকায় অনেকের রান্নাঘরে চুলা জ্বলেনি। তাই পরিবারের জন্য রান্না করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীর শাহীনবাগের বাসিন্দা সানজিদা খানম বলেন, গ্যাসের সমস্যার কারণে তিনি ঠিক মতো রান্না করতে পারছেন না। অনেক সময়ই পরিবারের সদস্যদের জন্য নাস্তা বাইরে থেকে আনাতে হচ্ছে। অতিথি আসলে ঘটছে আরো বিপত্তি। পাশেই তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা বিউটি আকতার বলেন একই কথা। তিনি বলেন, মধ্য রাতে গ্যাস আসে। রাতেও রান্না করা যাচ্ছে না। ভোর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে। মাঝখানে টিমটিম করে জ্বললেও সে আগুনে রান্না করা যায় না। গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বলছে, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) থেকে চাহিদামতো গ্যাস না পাওয়ায় কমাতে হচ্ছে সরবরাহ। ঢাকার প্রায় পুরো এলাকায় চলছে গ্যাস সংকট। তবে মগবাজার, ইস্কাটন, মৌচাক, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, ডেমরা, নন্দীপাড়ায় গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান এলাকাতেও একই অবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারসংকট, স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বৃদ্ধি, এলএনজি টার্মিনালে ত্রুটি, মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সেলারেটের টার্মিনাল মেরামত এবং ঘোড়াশাল সার কারখানা উৎপাদনে যাওয়ায় রাজধানীতে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শীতে এ সংকট আরও বাড়তে পারে। আসন্ন নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে অস্বস্তিতে পড়েছে সরকার। এই সংকট নিরসনে আপাতত এক্সেলারেটকে তাদের টার্মিনাল মেরামত দুই মাস পেছানোর অনুরোধ করেছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত সোমবার মন্ত্রণালয়ে ডেকেছিলেন এক্সেলারেট বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. হাবিবুর রহমান ভুইয়া ও পরিচালক প্রকৌশলী কাজী মো. আনোয়ারুল আজিমকে। মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই জরুরি বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে তাদের নিয়মিত টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ কাজ দুই মাস পেছানোর অনুরোধ করেন। এ জন্য জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা তুলে ধরা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের আগে এলএনজি সরবরাহ দুই মাস বন্ধ থাকলে ক্ষমতাসীনদের জন্য তা বুমেরাং হবে। অন্যদিকে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কারিগরি ত্রুটির জন্যই তারা টার্মিনাল মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে। টার্মিনাল সূত্র জানায়, ১০-১২ দিন ধরে এলএনজি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। আগামী ১ নভেম্বর থেকে টার্মিনালটির মেরামতকাজ শুরু হবে এবং শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত দুই মাস। এ সময়ে টার্মিনাল দিয়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। ফলে আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাস সংকট থাকবে। একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা বলেছেন, চলমান গ্যাস সংকটের কারণে তারা শিল্পের উৎপাদন ঠিক রাখতে পারছেন না। এমনিতেই টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ কমায় দেশে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। এতদিন এলএনজি টার্মিনাল থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হলেও গত শনিবার থেকে তা কমিয়ে ৬০০ মিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এলএনজি মজুতেও কিছুটা সংকট আছে। পরবর্তী শিডিউলের সঙ্গে ব্যালান্স করে এখন কিছুটা কমিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই পিক আওয়ার সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কিছুদিন সংকট থাকবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা লং টার্মে যে কার্গোগুলো আনি, সেগুলোর একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। চাইলেই চুক্তির বাইরে বেশি গ্যাস আনা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা স্পট মার্কেট থেকেও গ্যাস কিনে থাকি। মাসে তিনবার স্পট মার্কেট থেকে কার্গো আসে। এ মাসে পেয়েছি মাত্র একটি কার্গো। আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরের জন্য পেয়েছি আরেকটি। এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজার চড়া থাকায় আমরা সমন্বয় করে গ্যাস কিনছি। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলারসংকটের কারণেই মূলত স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না। ঘাটতি মেটাতে দেশীয় গ্যাসের জোগান বৃদ্ধির ব্যবস্থা শিগগিরই করা যাচ্ছে না। মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে পেট্রোবাংলার সঙ্গে এক্সেলারেট এনার্জি চুক্তি করেছিল ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। ১৫ বছর মেয়াদি এ টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। তবে এক্সেলারেট এনার্জি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে চুক্তির মেয়াদ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশে দিনে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করেছে ২ হাজার ৬৯১ মিলিয়ন ঘনফুট। গত মাসেও দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ছিল ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। এর আগের মাসে ছিল প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘১ নভেম্বর থেকে এক্সেলারেট এনার্জির টার্মিনাল মেরামতে যাবে বলে আমাদের জানিয়েছে। যার কারণে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস গ্রিডে দেওয়া হবে। ১ নভেম্বর থেকে এলএনজির সরবরাহ আরও কিছুটা কমে যাবে। এতে গ্যাসের সংকট বাড়তে পারে। তবে সামনে শীত মৌসুম, বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কম হবে। সব মিলিয়ে সেই সময়ের গ্যাস সরবরাহ দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে। এদিকে নরসিংদীর ঘোড়াশালে নতুন ইউরিয়া সার কারখানার একটি ইউনিট চালু হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর এই সার কারখানায় বিপুল সরবরাহ বাড়ায় চাপ পড়েছে অন্যদিকে। ফলে শিল্পকারখানার সঙ্গে ঢাকার আবাসিকে সরবরাহ কমেছে। তাই সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে। তিনি আরো বলেন, এক্সিলারেট এনার্জির শিডিউল রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে জন্য দেড় মাস এবং সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরো ১৫ দিন, মোট দুই মাস এলএনজি সরবরাহের বাইরে থাকবে। এ সময় একটি টার্মিনাল দিয়ে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাবে। এ সময় কিছুটা গ্যাসের সংকট থাকবে। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান বলেন, নিয়মিত মেরামতে অংশ হিসেবে একটি এফএসআরইউ কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। ফলে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ঘনফুট থাকবে দেড় থেকে দুই মাস। এ পরিস্থিতি আগামী দেড় থেকে দুই মাস গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হবে। তবে টার্মিনাল পুনরায় প্রতিস্থাপন করা গেলে ধীরে ধীরে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। দেশে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। এর একটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি সামিট গ্রুপ, অন্যটি মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। দুটি টার্মিনালের সক্ষমতা দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট। তবে দুটি টার্মিনাল থেকে সর্বোচ্চ সরবরাহ পাওয়া যায় দৈনিক ৯০ কোটি ঘনফুট। যদিও এলএনজি আমদানি সংকটে সারা বছরে গড়ে ৭০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ পাওয়া যায়। গত ২২ অক্টোবর সরবরাহ অনুযায়ী বর্তমানে স্থানীয় গ্যাস ও এলএনজি মিলিয়ে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ২৬৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে। এরমধ্যে ৬০ কোটি ঘনফুট এলএনজি। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনে (বিটিএমএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানাগুলোর অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ। কোনো ভাবেই ১২ ঘণ্টার বেশি কারখানা চালানো যাচ্ছে না। গ্যাসের প্রেশার শূন্যে নেমে আসছে কখনো কখনো। বেশিরভাগ কারখানা মালিকরা এ পরিস্থিতিতে আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লাহ বলেন, গ্যাস ছাড়া সিরামিক শিল্প কল্পনাই করা যায় না। বর্তমানে ঢাকা ও গাজীপুরে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সিরামিক কারখানা গ্যাসের অভাবে উৎপাদন সংকটে পড়েছে। সিরামিক শিল্প অবর্ণনীয় ও ভীতিকর পরিস্থিতির ভিতরে রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, নভেম্বর থেকে দুই মাস গ্রিডে ৫০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ হবে। স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে বাড়তি সরবরাহ যোগান দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ স্থানীয় ফিল্ডগুলোরও উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তবে শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা যেহেতু কমে যায়, ফলে সেখানে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা কম দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হবে।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২৭ অক্টোবর ২৩/ এসবি